শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কুতুবউদ্দিন আহমেদ
সুকান্ত পৃথিবীতে এসেছিলেন ১৯২৬এ; ব্রিটিশ আমলে; আজ থেকে নব্বই বৎসর পূর্বে। সেই সময়ে বাংলা ভাষার এই কিশোর কবি পৃথিবীর বিরাজমান জঞ্জাল দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। জঞ্জাল বলতে মানুষে মানুষে হানাহানি, যুদ্ধ, হত্যা, ত্রাস, পাপ, তাপ, হতাশা, ঘৃণা, ক্ষুধা। তিনি জানতেন পৃথিবীর এ সঙ্কটগুলো প্রাকৃতিক নয়; মানুষের তৈরি। কালে-কালে ক্ষমতাধর দুষ্ট মানুষগুলো ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য এই সঙ্কটগুলো তৈরি করেছেন। এই সঙ্কটগুলো মানুষের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে। মানুষ গিয়ে মানুষের কাছে নতজানু হয়। এই পৃথিবী তাই মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। এমন অনিরাপদ, অসম্মানজনক পৃথিবী বিবেকবান মানুষেরা প্রত্যাশা করে না। কবি সুকান্তও সর্বান্তকরণে একটি সুখী-সমৃদ্ধ পৃথিবীর ছবি এঁকেছেন। মানুষের জন্য শোষণমুক্ত, অনাচারমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত, সুন্দর-শোভন, সৌন্দর্যময় একটি সমাজ গড়তে তিনি সর্বান্তকরণে চেষ্টা করেছেন। এমনকি যে শিশুটি আজ ভূমিষ্ঠ হবে পৃথিবীতে সেই অনাগত শিশুটির জন্যেও তিনি একটি সুন্দর বাস উপযোগী পৃথিবী গড়ে যেতে চেয়েছেন। সুকান্ত সেই সময়ে বসে শিশুর জন্য সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন; যার আবেদন আজ আরো বেশি করে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সুকান্তের কণ্ঠে বেজে উঠেছে :
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম,
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে
-------------------------
এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
[ ছাড়পত্র : ছাড়পত্র ]
খুব দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয় সুকান্তের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি বরং হয়েছে আরো ঘনীভূত। পৃথিবীর দিকে-দিকে আজ অনাকাক্সিক্ষত জঞ্জাল আরো বেড়ে যাচ্ছে। আজ ভাগাড়ে পাওয়া যায় পরিত্যক্ত মানবশিশু। হায় পৃথিবী! হায় মানুষ! হায় মানবতা! কবি সুকান্ত কি এই পৃথিবী চেয়েছিলেন?
সুকান্ত মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। দাসত্বের চেয়ে মানবতার বড় অবমাননা আর হতে পারে না। দানবীয় ইংরেজশক্তি এদেশের মানুষের পায়ে যে শৃঙ্খল পরিয়েছিল, সুকান্ত তা মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন ইংরেজরাজের বিরুদ্ধে। তিনি চেয়েছিলেন এদেশের মানুষ মানুষের সম্মান নিয়ে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকুক। তাই প্রতিনিয়ত তিনি এদেশের মানুষকে ইংরেজ তাড়ানোর মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছেন :
‘হয় ধান নয় প্রাণ’ এ শব্দে
গারা দেশ দিশেহারা,
একবার মরে ভুলে গেছে আজ
মৃত্যুর ভয় তারা।
সাবাস বাংলা দেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়;
জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়!
[দুর্মর : পূর্বাভাস]
কবি সুকান্ত একজন খাঁটি জীবনাশ্রিত কবি। মাটি আর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক অতি নিবিড়। জীবনের পারিপার্শ্বিকতাকে পাশ কাটিয়ে তিনি কবিসুলভ ভাবালুতায় নিমজ্জিত হননি। সমসাময়িক রাজনৈতিক আলোড়ন এই কিশোর কবিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। কলকাতার ধর্মতলা স্ট্র্রিটে পুলিশের নির্বিচারে গুলি, জালিয়ানওয়ালাবাগের শাসকগোষ্ঠীর অমানবিক নৃশংস হত্যাকা- কবিকে ভীষণ ব্যথিত করে তুলেছিল। তাই তিনি সর্বান্তকরণে আমাদের স্বাধীনতা চেয়েছেন :
আর কতদিন দুচক্ষু কচলাবে,
জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু
সে পথে আমাকে পাবে,
জালালাবাদের পথ ধরে তাই
ধর্মতলার পরে
দেখবে ঠিকানা লেখা প্রত্যেক ঘরে
Ÿুব্ধ এদেশে রক্তের অক্ষরে।
বন্ধুু আজকে বিদায়!
দেখেছ উঠল যে হাওয়া ঝোড়ো,
ঠিকানা রইল,
এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা ক’রো।
[ ঠিকানা : ছাড়পত্র ]
সুকান্তের প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ছাড়পত্র’। এই ছাড়পত্র দিয়েই তিনি মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। ছাড়পত্র মধ্য দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যে এক ঈর্ষণীয় উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু কথা হলো ছাড়পত্রের বিষয়বস্তুটা কী? এককথায় বলতে গেলে বলতে হয় মানুষ। দু কথায় বলতে গেলে বলতে হয় মেহেনতি মানুষ। এ দেশের মানুষ ক্রমাগত মেহেনত করে যায় কিন্তু পায় না উপযুক্ত পারিশ্রমিক। ধনিকশ্রেণীর শোষণে এরা দিনকে দিন হাড্ডিসার হয়ে ওঠে। মেহনতি মানুষের কঙ্কালের ওপর গড়ে ওঠে ধনিকের বিলাসবহুল সৌধ। তার ভাষায় :
শোন রে মালিক, শোন রে মজুতদার!
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়
হিসাব কি দিবি তার?
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি
সে কথা কি আমি জীবনে-মরণে
কখনও ভুলতে পারি?
[ বোধন : ছাড়পত্র ]
সুকান্তের এ কবিতাটির বিষয়বস্তুর সঙ্গে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নি¤েœাক্ত কবিতাটির বিষয়বস্তুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় এ জন্যে যে, তাদের কাব্যসুর ও কাব্যভাবনা ছিল এক ও অভিন্ন :
দেখিনু সেদিন রেলে,
কুুল বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সাব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।
বেতন দিয়াছ Ñ চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোড় পেলি বল!
[কুলি-মজুর : কাজী নজরুল ইসলাম]
কবিতার ললিতকলায় সুকান্ত অভিভূত, বিগলিত বা মুগ্ধ হননি কখনও। কবিতাকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন মানব বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে। তাই তিনি উদাত্ত কণ্ঠে জানিয়েছেন :
হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্য আনো,
পদ লালিত্য ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!
প্রয়োজন নেই কবিতার ¯িœগ্ধতা
কবিতা তোমায় দিলেম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়;
পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
[ হে মহাজীবন : ছাড়পত্র ]
কবিতার ভাববিচারে সুকান্তের এ কবিতাটির সঙ্গে প্রায় সমসাময়িক আরেকজন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নিচের কবিতাটির সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় :
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
[ মে-দিনের কবিতা : পদাতিক ]
কবি সুকান্তের জীবন ছিল বরাবরই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। ধরাবাধা নিয়মে পড়াশোনা তার ভালো লাগতো না। তিনি পড়াশোনা করতেন; কিন্তু পরীক্ষা পাসের পড়া না; নিজেকে উদ্বোধিত করার জন্য পড়া। তাই তার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করা হয়নি। ১৯৪২ এ দশম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় এই অস্থিরমনা কিশোর রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেন। এত শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করে। ফলে সুকান্তকে অন্য স্কুলে ভর্তি হতে হয়। সেখান থেকে দুবার পরীক্ষা দিয়েও ম্যাট্রিকুলেশন পাস করা হয়নি। সুকান্তের লেখাপড়ার এখানেই সমাপ্তি ঘটে। যে কথাটি তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ করে লিখেছিলেন, সেই একই কথা তার নিজের জীবনেও খাটে। তিনি বলেছিলেন :
এক যে ছিল আপনভোলা কিশোর,
ইস্কুল তার ভাল লাগতো না,
সহ্য হতো না পড়াশোনার ঝামেলা
আমাদের চলতি লেখাপড়া শিখলো না সে কোনকালেই,
[ এক যে ছিল : মিঠেকড়া ]
পৃথিবীটাকে বড় বেশি ভালোবেসেছিলেন সুকান্ত। পৃথিবীর রূপ-রস- সৌন্দর্য তিনি উপভোগ করতে চেয়েছিলেন প্রাণভরে। কিন্তু শরৎচন্দ্রের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘ বড় প্রেম কেবল কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলতে জানে’ তার জীবনে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আরোপিত হয়েছে। তিনি অতি দ্রুত পৃথিবীকে বিদায় জানালেন। এতোটা সাততাড়াতাড়ি পৃথিবী তাকে দূরে ঠেলে দিল!
এতো দ্রুত বিদায় নেবেন বলেই এই কিশোর কবিকে মৃত্যু তাড়া করে ফিরছিল? যে বয়েসে একজন কিশোর জীবনের বীজ বোনে, স¦প্ন দিয়ে বাস্তবের মালা গ্রন্থন করে, সেই বয়েসে সুকান্ত মৃত্যুচিন্তায় বিভোর ছিলেন? ১৯৪২ এ লিখিত একটি চিঠিতে তার মৃত্যুচিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। “...বড় বেশি ভালো লেগেছিল পৃথিবীর ¯েœহ, আমার চোট্ট পৃথিবীর করুণা। বাঁচতে ইচ্ছে করে, কিন্তু নিশ্চিত জানি কলিকাতার মৃত্যুর সঙ্গেই আমিও নিশ্চিহ্ন হব। ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’।”
১৯৩৯-এর একটি লেখায় পাওয়া যায়, “আমার চারদিকের বিষাক্ত নিঃশ্বাসগুলো আমাকেই দগ্ধ করতে ছুটে আসে আর তার সে রোমাঞ্চকর নিঃশ্বাস আমাকে লুব্ধ করে। আমার মৃত্যুদিন সন্নিকট। তাই চাই আজ আমার নির্বাসন। তোমাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই, তোমাদের ভুলতে চাই; দীন হয়ে বাঁচতে চাই।
তাই সুখের দিনগুলোকে ভুলে তোমাদের কাছ থেকে শেখা মরণমন্ত্রকে ভুলে, ধ্বংসের প্রতিক স্বপ্নকে ভুলে, মৃত্যুমুখী আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু পারব না, তা আমি পারব না; আমার ধ্বংস অনিবার্য।”
কবি সুকান্ত নি:সন্দেহে বাংলাভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। সুকান্ত মানুষ ও মানুষের অধিকারের কথা নিঃসঙ্কোচে বলেছেন। তার আহ্বানে আজও মানুষ বিশেষ করে কিশোরেরা উদ্দীপ্ত হয়, প্রাণিত হয়। আজকাল তরুণদের ভেতরে যে একধরনের উগ্র মানসিকতার জন্ম হয়েছে সে কেবল একজন সুকান্তের অভাবে। সুকান্তকে পড়লে, জানলে আজকালকার তরুণেরা সুপথে ফিরে আসবে আশা করি। সুকান্তের জীবন থেকে, লেখা থেকে তরুণদের শিক্ষা নেয়ার অনেক উপাদানই রয়েছে। সুতরাং সুকান্ত ও তার কবিতার উপযোগিতা আজও কিছুমাত্র ম্লান হয়নি। বরং তার কবিতা আজ যেন এই দেশে, এই পৃথিবীতে আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেননা এই কবির স্বরে আমাদেরও জিজ্ঞাসা :
বলতে পারো বড় মানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?
বড় মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচিমিষ্টি,
গরীবেরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি?
[ পুরোনো ধাঁধা : মিঠেকড়া ]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।