পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সুদীর্ঘকাল ধরে দেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। নদীপথে যাতায়াত থেকে শুরু করে এর তীরবর্তী এলাকায় শহর, বন্দর, বাজার, গঞ্জ সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চলে আসছে। ১৬১০ সালে ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে বেছে নেয়ার মুল কারণই ছিল এর চারপাশের নদ-নদী এবং অভ্যন্তরে অসংখ্য খাল ও ঝিলের সমাহার। বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর গোড়াপত্তন হয়। কালক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধির কারণে রাজধানীর বিস্তৃতি ঘটে। সেই সাথে সমান তালে চলতে থাকে নদ-নদীর তীর এবং খাল-ঝিলের অবৈধ দখল এবং দূষণ। এর ফলে রাজধানীর চারপাশের চার নদী মৃত অবস্থায় উপনীত হয়েছে। অভ্যন্তরে খাল-ঝিল এবং জলাধার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু টঙ্গী খালসহ যে চার নদী রয়েছে দখল-দূষণে সেগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। অবৈধ দখল তো রয়েছেই, রাজধানী এবং এর আশপাশের এলাকার যত ধরনের বর্জ্য রয়েছে, সবই এসব নদীতে ফেলে ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। যে সিটি করপোরেশন রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অপসারণের দায়িত্বে রয়েছে, তার ত্রু টিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে এসব নদ-নদীতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় নিয়োজিত ওয়াসাও একই কাজ করে চলেছে। ফলে রাজধানীর চারপাশের নদ-নদীর দূষণ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
ঢাকার মতো চারপাশে নদীবেষ্টিত রাজধানী বিশ্বে আর একটিও নেই। দখল ও দূষণমুক্ত রেখে নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে পারলে এটি হতো বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর নগরী। দুঃখের বিষয়, রাজধানীর সব ধরনের ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত কোনো কর্তৃপক্ষই¡ যথাযথভাবে এ দায়িত্ব পালন করেনি। বছরের পর বছর ধরে প্রভাবশালীরা নদীর দুই তীর অবৈধ দখল করে তাদের রাজত্ব কায়েম করেছে। নদীগুলোকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। মাঝে মাঝে আভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ নদীর তীরবর্তী অবৈধ দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম চালালেও পুনরায় তা দখল হতে দেখা যায়। গত বছর ২৯ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ৬ মাসে সংস্থাটি তিন নদীর তীর থেকে ৪৭৭২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ১২১ একর তীরবর্তী জমি উদ্ধার করে। পরে আবার দখল হয়ে যাওয়ায় অভিযান চলাতে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, একদিকে উচ্ছেদ, অন্যদিকে পুনরায় দখল হওয়া নিয়ে এক ধরনের লুকোচুরি খেলা চলছে। এতে কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। নদীর এই অবৈধ দখলের পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে চলছে দূষণ। রাজধানীর যত ধরনের বর্জ্য রয়েছে, তার বেশিরভাগই ফেলা হচ্ছে চার নদীতে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্য অপসারণ এবং ডাম্পিংয়ের কাজ করে সিটি করপোরেশন। এই বর্জ্যরে কিছু অংশ নদীতে পড়ছে। গবেষণা অনুযায়ী, রাজধানীর চারপাশের নদীতে ৪০০টি পয়েন্ট দিয়ে কঠিন বর্জ্য এবং ৩৬০টি পয়েন্ট দিয়ে পয়োবর্জ্য পড়ছে। জরিপকারি সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার দেখেছে, বুড়িগঙ্গায় ২৩৭টি এবং তুরাগ নদীতে ১৩১টি বর্জ্যেে ভাগাড় রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নদীর অবৈধ দখলের প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছে, বর্জ্য ফেলা। বর্জ্য ফেলে ভরাট করে সেখানে দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে অবৈধ দখল করা হয়। অথচ সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসা এসব বর্জ্য নিষ্কাশনের দায়িত্বে থাকলেও নদীদূষণের দায়িত্ব নিতে চায় না। ফলে নদী দুষণ কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। কয়েক বছর আগে বুড়িগঙ্গার নাব্য ফেরাতে খনন কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, নদীটির তলদেশে ৬ ফুট স্তরের পলিথিন জমা হয়েছে। পলিথিনের এই স্তর সরানো অসম্ভব হয়ে পড়ায় খনন কাজ স্থগিত করা হয়। এখন বুড়িগঙ্গাকে সচল করতে এর আদি চ্যানেল উদ্ধারসহ নানা পদক্ষেপের কথা শোনা যাচ্ছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র এসব উদ্যোগের কথা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। তার এসব উদ্যোগ আশা জাগালেও পর্যবেক্ষকরা তা দ্রুত বাস্তবায়নের তাকিদ দিয়েছেন।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর চার নদীসহ সারাদেশের নদী বাঁচাতে না পারলে সরকারের নেয়া ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। এ আশঙ্কা অমূলক নয়। চোখের সামনেই নদ-নদী মেরে ফেলার অপকর্ম চলেছে। কোনোভাবেই তা থামানো যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং তা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে একটা সময় নদ-নদীর অস্তিত্ব বলে কিছু থাকবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোকে যদি সচল ও স্বচ্ছ পানিধারায় পরিণত করা যায়, তবে তা বিশ্বের অন্যতম সৌন্দর্যের নগরীতে পরিণত হবে। এজন্য প্রয়োজন, সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ। সিটি করপোরেশনকে তার বর্জ্যব্যবস্থাপনা আধুনিক করতে হবে, যাতে কোনো বর্জ্য নদ-নদীতে না পড়ে। ওয়াসার পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও যুগোপযোগী করতে হবে। সংস্থাটির নদীমুখী পয়োবর্জ্যরে ড্রেনেজ সিস্টেম বন্ধ করতে হবে। দুই প্রতিষ্ঠানের কারণে নদী দূষিত এবং ভাগাড়ে পরিণত হবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা যদি তাদের অপসারণকৃত বর্জ্য নদীতে না ফেলে, তবে দূষণ অনেকটাই কমে যাবে। এছাড়া যেসব শিল্পকারখানার বর্জ্য নদ-নদীতে পড়ছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশবাদী যেসব সংগঠন ও সংস্থা রয়েছে, তাদের উচিৎ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নদীভাবনা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে, এ স্লােগানকে জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।