পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একমাত্র মনোনীত দ্বীন ইসলামের অপ্রতিরুধ্য বিস্তার ও অগ্রগতিতে পাশ্চাত্যের ইসলাম বিদ্বেষী উগ্রবাদী চরমপন্থীরা ক্ষোভে, রোষে হতাশায় অন্ধ হয়ে লিপ্ত হয়েছে একের পর এক ধ্বংসাত্মক তৎপরতায়। কখনো নিষিদ্ধ করছে হিজাব, কখনো বন্ধ করছে আজান, কখনো বাধা সৃষ্টি করছে নামাজে, ইবাদতরত মুসল্লীদের উপর চালাচ্ছে সশস্ত্র আক্রমণ, করছে নির্বিচারে হত্যা, কখনো অঙ্কন করছে আল্লাহর প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাঙ্গ চিত্র, আবার কখনো করছে আল্লাহর পবিত্র কালাম পবিত্র কুরআনের অবমাননা, জ¦ালিয়ে দিচ্ছে এই মহাগ্রন্থ। তারা মেতে উঠেছে মরণ খেলায়। তারা থামছে না, থামানোর যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ২০১৯ সালে ডেনমার্কের একটি উগ্র দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠি পবিত্র কুরআনের কপির সাথে শূকরের মাংস পেঁচিয়ে পৈশাচিক উল্লাসের সাথে আগুন লাগিয়ে তা পুড়িয়ে ফেলে। রামসোপ পেলুদান নামের এক নরাধম ছিল তাদের অন্যতম নেতা। ঐ পাপিষ্ঠই আবার এই ২০২০ সালের ২৮ আগস্ট সুইডেনে আসছিল পবিত্র কুরআন পোড়ানোর আর এক নারকীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। যদিও সুইডেন কর্তৃপক্ষ তাকে আসার অনুমতি প্রদান করেনি, তবুও বন্ধ থাকেনি ঐ পাপানুষ্ঠান। সুইডেনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর মালামেতে যথাসময় অনুষ্ঠিত হয়েছে ঐ উৎসব। উগ্রদক্ষিণপন্থী নরাধমরা সেখানে যোগদান করেছে। পবিত্র কুরআনের কপিতে লাথির পর লাথি মেরেছে। অতঃপর তাতে অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে সেখানকার মুসলমানরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে এবং সেখান থেকে ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে সুইডিশ পুলিশ। এর আগে ২০১২ সালে আমেরিকাতে ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম’ নামের এক চলচিত্র নির্মিত হয়। শ্যামবাসিল নামের এক নরকের কীট ছিল ঐ ছবির প্রযোজক ও পরিচালক। সে ছিল ইয়াহুদি বংশোদ্ভূত এক মার্কিন নাগরিক। ঐ কুখ্যাত ছবিতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আল্লাহর প্রিয় হাবীব, তাঁর সহধর্মিনী মা আয়শা রা., কন্যা ফাতিমা রা. সহ নবীজীর আরও অনেক সঙ্গী-সাথীর চরিত্র কুৎসিত রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। আমেরিকায় বসবাসরত ১০০ জন ইয়াহুদির অর্থানুকূল্যে ৫০ লাখ ডলার ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল ঐ ছবি। বিশ^ব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এর বিরুদ্ধে। এমনকি জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বানকি মুন পর্যন্ত মন্তব্য করেছিলেন, ‘চলচিত্রটি লজ্জাজনক ও অসম্মানজনক।’ ওদিকে ফরাসী রম্যসাময়িকী ‘শার্লি এবদোর’ সাম্প্রতিক সংস্করণের মলাটে আবার ছাপা হয়েছে বিশ^নবী সা. এর বিতর্কিত ১২টি কার্টুন চিত্র। ১৫ বছর আগে ঐ কার্টুন ছাপা হয়েছিল ঐ পত্রিকায় এবং তা নিয়ে হয়েছিল অনেক কিছু, যার জের চলছে এখনো। ২০১২ সালেই আফগানিস্থানের বাগরাম ঘাঁটিতে আমেরিকান সেনারা জ¦ালিয়ে দিয়েছিল পবিত্র কুরআন। আমেরিকান ইসলাম বিদ্বেষী সৈন্যদের এরূপ ঘৃণ্য অপরাধের ঘটনা আরো অনেক আছে।
কিউবার দক্ষিণ পূর্বে ক্যারিবিও সাগরে কিউবার মাটিতেই রয়েছে আমেরিকান নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটি। সেখানে রয়েছে ‘মর্তের নরক’ হিসেবে কুখ্যাত ‘গুয়ান তো নামো বে’ কারাগার। সেখানে বন্দিদের ওপরে যে লোমহর্ষক অত্যাচার চালানো হয় তার বর্ণনা দেয়া এখানে লক্ষ্য নয়, কেবল সেখানে পবিত্র কুরআনের অবমাননার ঘটনারই উল্লেখ করা হলো। আফগানিস্থান থেকে ধরে নেয়া ও পরে মুক্তি পাওয়া এক বন্দি বলেছে, আমাদের মুসলিম সৈন্যদের ওপর মানসিক নির্যাতন চালানোর জন্য পবিত্র কুরআনের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছড়িয়ে দিয়ে ওরা তার উপরে প্রশ্রাব করে দিত।
কুখ্যাত ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি ও ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার ‘স্যাটানিক ভার্স’ নিয়ে বিশ^ব্যাপী মুসলমানদের মধ্যে যে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল তা বোধহয় এখনো অনেকের মনে আছে। পবিত্র কুরআন, রাসুলুল্লাহ সা., নবীজী সা. এর সহধর্মীনী ও অন্যান্য সম্মানিত সহচর সম্পর্কে তার যে সব কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা তা আলোচনা করতেও শরীর সিউরে ওঠে। মুসলমানরা তা সহ্য করতে পারেনি। ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রূহুল্লাহ খোমেনী ১৯৮৯ সালের ১৪ ফেব্রæয়ারি তার বিরুদ্ধে জারী করেছিলেন মৃতদÐের পরোয়ানা। তারপর সেই পাপাত্মা এই যে খোড়লে আত্মগোপন করে, আর প্রকাশ্যে বের হয়নি।
১৯৩২ সালে ‘রঙ্গিলা রাসূল’ নামে এক বই প্রকাশ করে এই উপমহাদেশেরই ভোলানাথ সেন নামের এক দুরাত্মা। সে নিহত হয়েছিল এবং সেই হত্যার অপরাধ স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে স্বীকার করে নিয়ে আদালতের রায়ে মৃত্যুদÐ হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেন আবদুল্লাহ খান ও আমীর খান নামের দুই সহোদর পাঠান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁদের পক্ষে বিনা ফিতে কোর্টে মামলা লড়েছিলেন। এ রকম কুরআন ও বিশ^নবীর প্রতি বিষোদগার ও বিদ্বেষ ছড়ানোর উদাহরণ রয়েছে ইসলামের আবির্ভাব কাল থেকে যেমন বহু, তেমনি নিন্দা, ক্ষোভ ও ধিক্কার জানানোর উদাহরণও রয়েছে অসংখ্য।
কিন্তু কেন পবিত্র কুরআন, আল্লাহর হাবীব, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই অব্যাহত শত্রæতা? কারণ অনেক, তবে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে হিংসা-বিদ্বেষ, ইসলামের ক্রম সম্প্রসারণ ও পবিত্র কুরআনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অপারগতা। এই হিংসা ও বিদ্বেষ শুরু হয়েছে আবু জাহেল, আবু লাহাব থেকে, চলছে আজ পর্যন্ত। ইসলামের প্রধান শত্রæ ছিল আবু জাহেল। পবিত্র কুরআনের বিস্ময়কর ভাব-ভাষা, মর্ম, মাধুর্যে মুগ্ধ, মোহিত হয়ে তার প্রতি দুর্বার আকর্ষণে সে এবং আরও কয়েকজন রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে গিয়ে শুনত হযরত সা. এর তিলাওয়াত। আল্লামা সুয়ুতী রহ. বায়হাকী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন: একদা আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান ও আখনাছ বিন শরীত রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে একে অপরের অজান্তে তিনজনে তিন কোণে গিয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিলাওয়াত শুনতে শুনতে এমন বিভোর হয়ে পড়ল যে রাত শেষ হয়ে গেল। ঘরে ফিরার সময় তাদের দেখা হয়ে গেল একে অপরের সঙ্গে। জানতে পারল তিলাওয়াত শুনার খবর। বলল, আমাদের এরূপ করা ঠিক নয়। আরবের লোকেরা যদি একথা জানতে পারে তবে সকলেই মুসলমান হয়ে যাবে। কিন্তু রাত গভীর হতেই আত্মগোপন করে শুনতে লাগল তিলাওয়াত। আবার তিন জনের দেখা ফেরার পথে। আবার তিন জনের সিদ্ধান্ত এমনটা আর করবে না। কিন্তু রাত গভীর হতেই ভুলে গেল সেই সিদ্ধান্ত। কুরআনের মহাআকর্ষণে ছুটে গিয়ে তন্ময় হয়ে তিলাওয়াত শুনতে শুনতে প্রভাত হয়ে গেল। আবার তিন জনের দেখা হলো একই সাথে। এবার কঠোর প্রতিজ্ঞা করল তারা। না, এভাবে আর কেউ শুনবে না এবং ঘরে প্রত্যাবর্তন করল।
কুরআন স্বয়ং আল্লাহর বাণী। লওহে মাহফুজে তা সংরক্ষিত। সেখান থেকে এসেছে আল্লাহর রাসূলের কাছে। এই কুরআন, এর প্রতিটি সূরা, প্রতিটি আয়াত, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বর্ণ এমনভাবে হেফাজত করেছেন স্বয়ং আল্লাহ যে, তা পরিবর্তন, পরিবর্ধন, বিকৃত করার সাধ্য কারো নেই। অবিকল ও আসল রূপেই তা বিদ্যমান থাকবে মহাপ্রলয় কাল পর্যন্ত। রাসূলে পাকের জমানা হতে এ পর্যন্ত এবং ভবিষ্যতেও আসমানী লওহে মাহফুজের মতো অলেপনীয়ভাবে, অদর্শনীয়রূপে খোদিত হয়ে আছে ও থাকবে তা’ লক্ষ কোটি মানব-সিনার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লওহে মাহফুজে। এ যেমন পরিবর্তন করা যাবে না তেমনি এমনটা রচনা করতেও কেউ সক্ষম হবে না। এ স্বয়ং আল্লাহর চ্যালেঞ্জ। আল্লাহ ঘোষণা করেছেন: ‘যালিকাল কিতাবু লাÑ রাইবা ফীহি’ ‘এই সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই।’ (২:২) অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন: ‘তারা কি বলছে (হে নবী) আপনি নিজেই এই কুরআন রচনা করেছেন? (তবে) আপনি বলে দিন, তোমরা এর মত ১০টি সূরা রচনা করে দেখাও। এ কাজে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ যদি ক্ষমতা রাখে তাকেও ডেকে নাও, যদি তোমাদের দাবি সত্য হয়ে থাকে।’ (১১:১৩)
আরবের লোকেরা ছিল স্বভাব কবি। তাদের ভাষার লালিত্য, ছন্দের মাধুর্য ছিল বিস্ময়কর। তাদেরকে সেই উম্মীÑ নিরক্ষর নবী, যিনি জীবনে এক লাইন কবিতাও লিখেননি তিনি যখন ভাষাবিদ জাত-কবিদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন কুরআনের অনরূপ এক কিতাব রচনা করে দেখাবার; তা নাহোক, কুরআনের ১০টি সূরার মত ১০টি সূরা রচনা করে পেশ করার তাতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলে আল্লাহ চ্যালেঞ্জের মাত্রাকে শিথিল করে নাযিল করলেন: ‘এই কুরআন আল্লাহ ছাড়া আর কারো রচনা নয়। তারা কি বলে সে (মুহাম্মদ সা.) এটি আপনি রচনা করেছেন? আপনি বলে দিন, তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সূরা রচনা কর এবং (একাজে) আল্লাহ ছাড়া আর যাকে পার ডেকে নাও যদি তোমরা (তোমাদের কথায়) সত্যবাদী হয়ে থাক।’ (১০:৩৭, ৩৮) বহু চেষ্টা করেও আরবের ভাষাবিদ, কবি সাহিত্যিক কুরআনের অনুরূপ মাত্র একটি সূরাও রচনা করতে ব্যর্থ হলো এবং স্বীকার করতে বাধ্য হলো যে, এ কুরআন মানব রচিত কোন গ্রন্থ নয়।
যেখানে একটি মাত্র সূরা রচনা করে দেখাতে পারলেই মুহাম্মদ সা. তাদের নিকট পরাজিত হয়ে যান, সেখানে তা না করে তারা কেন উঠে পড়ে লেগে গেল, কেন মুসলমানদের ওপরে নির্যাতন নিপীড়নের পথ বেছে নিল, তাঁদেরকে দেশ ছাড়া করল, তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ চালিয়ে গেল, কারণ একটিইÑ হিংসা-বিদ্বেষ।
কুরআন আর শুনবে না এ শপথ নেয়ার পর আবু জাহেলের নিকট আখনাস বিন শরীত জিজ্ঞাসা করল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ নিঃসৃত বাণী সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? আবু জাহেল বলল, আমাদের খান্দান আর বনু আবদে মানাফের খান্দানের মধ্যে বরাবর প্রতিযোগিতা চলে এসেছে। নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের যে দিকেই তারা অগ্রসর হয়েছে আমরা সে দিক দিয়েই তাদের সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছি। কাউকে কেউ হারাতে পারেনি। ছিলাম সমানে সমান। এই দু’ খান্দানের কারো উপর ছিল না কারো শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু এখন বনু আবদে মানাফের খান্দানে একজন নবীর আবির্ভাব ঘটেছেÑ যার নিকট আসমান থেকে ওহী আসে। এ ক্ষেত্রে তাদের মোকাবেলা করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। তাই আমরা কখনো তাঁর উপর ঈমান আনব না, বরং আমাদের স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, শক্তির দ্বারাই আমরা তাঁর মোকাবেলা করব। কুরআন বলছে: ‘ওরা নিজ সন্তানের ব্যাপারে যেমন নিশ্চিত এ আমারই সন্তান, তেমনি আপনি যে খোদার প্রেরিত রাসূল সে সম্পর্কে তারা সংশয় সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত যে, সত্যিই আপনি আল্লাহর রাসূল।’
তবু অবিশ^াস, দুশমনী, যুদ্ধ-বিগ্রহের মূলে কাজ করেছে ঐ হিংসা ও বিদ্বেষ। এ রূপ হিংসা-বিদ্বেষ কোন মুসলমান কোনো নবী-রাসূল বা কোন আসমানী কিতাবের উপর পোষণ করে না। বরং সকল নবী-রাসূলের প্রতি সকল আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান রাখে। কিন্তু ওরা পোষণ করে শত্রæতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানের ১১৯নং আয়াতে বলেছেন: ‘দেখ, তোমরাই ওদেরকে ভালবাস কিন্তু ওরা তোমাদেরকে ভালবাসে না। অথচ তোমরা সমস্ত কিতাবে ঈমান রাখ। ওরা যখন তোমাদের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, আমরা বিশ^াস করি। কিন্তু ওরা যখন নিজেরা একান্তে মিলিত হয় তখন তোমরাদের প্রতি আক্রোশে ওরা নিজেদের অংগুলির অগ্রভাগ দন্তে কেটে থাকে। বল, তোমাদের আক্রোশেই তোমরা মর।’
হ্যাঁ, ওরা হিংসায়, বিদ্বেষে, আক্রোশে জ¦লতে থাকবে, মুসলমানদের মারতে থাকবে, তাদের ওপর পৈশাচিক জুলুম নির্যাতন চালাতে থাকবে, কুরআন জ¦ালাবে, পোড়াবে কিন্তু ইসলামের অগ্রাভিযান রোধ করতে পারবে না।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা ফাতহের ২৮নং আয়াতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন: ‘তিনিই (আল্লাহ) তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্যদ্বীনসহ পাঠিয়েছেন, অন্য সব দ্বীনের ওপরে এই দ্বীন (ইসলাম) কে জয়যুক্ত করার জন্য। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট।’
বিরোধিতা যতই হোক, আঘাত যতই আসুক শত্রæরা এর অগ্রাভিযান রোধ করতে পারবে না কিছুতেই। এ যে খোদায়ী নূর। এ নূরে সমগ্র বিশ^-ভূমÐল একদিন উদ্ভাসিত হবেই হবে।
আল্লাহপাক এরশাদ করেন: ‘ওরা আল্লাহর নূরকে ফুৎকার দিয়ে নেভাতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন, যদিও কাফিররা (অন্যত্র মুশরিকরা) তা অপছন্দ করে।’ (৬১:৮)
হযরত মিকদাদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন: দুনিয়ার বুকে এমন কোন কাঁচা বা পাকা ঘর থাকবে না, যেখানে ইসলামের প্রবেশ ঘটবে না। আল্লাহ যাদের সম্মানিত করবেন তারা ইসলাম কবুল করবে, আর যাদের লাঞ্চিত করবেন তারা ইসলাম গ্রহণে বিমুখ থাকবে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত প্রজায় পরিণত হবে।
আল্লাহ সত্য, আল্লাহর বাণী সত্য, আল্লাহর ঘোষণা অভ্রান্ত, চিরন্তন। এর উদাহরণ অসংখ্য। একদিন যে বাণী প্রচার করতে গিয়ে আল্লাহর হাবীব লাঞ্ছিত হয়েছেন, নিপীড়িত হয়েছেন, তায়েফে প্রস্তরাঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন, প্রিয় জন্মভূমি থেকে হিজরত করতে বাধ্য হয়েছেন, ওহোদের প্রান্তরে রক্ত¯œাত হয়েছেন, দান্দান মোবারক শহীদ হয়েছে, ৮০টির মত যুদ্ধের মোকাবেলা করেছেন, এমনকি জীবন হারাবার পর্যায়ে উপনিত হয়েছেন তবু সে দ্বীনের আলো এতটুকু ¤øান হয়নি, এর অগ্রাভিযান ব্যাহত হয়নি। একদা জন্মভূমির এক টুকরা মাটির অধিকার যার ছিল না, জীবদ্দশায়ই তাঁর অধিকারে এসে যায় প্রায় দশ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা। উর্দূ কবি সেই চিরন্তন বিশ^াসের আলোকেই বলছেন :
‘ইয়ে দ্বীনে হক হায় এসকো কাভি বুঝ না সাকেগা
জেতনাহি দাবাও গে উভারতাহি রাহেগা’।
এ হলো সত্য শ^াশত দ্বীন পারিবে না করিতে নির্বাপিত
যতই চাহিবে নেভাতে এ নূর হবে তত আরো উদ্ভাসিত।
ইসলাম বিদ্বেষীরা, কুরআন জ¦ালানোর উৎসব করনেওয়ালারা তাকিয়ে দেখুক, এ নূর এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার প্রান্ত ছাড়িয়ে প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে আমেরিকার জনপদে জনপদে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে দেশে বেড়েই চলছে কুরআন-অনুরাগীদের সংখ্যা। বর্ধিত হয়ে চলছে ইসলাম গ্রহণকারীদের সংখ্যা। মুসলমানদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের নাইন ইলেভেনে টুইন টাওয়ারে হামলার দায় তথাকথিত মুসলিম সন্ত্রাসীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে, ইসলামভীতি ছড়িয়ে দিয়ে, অপবাদ রটনা করে কুরআন ও ইসলামের প্রতি ঘৃণা-আক্রোশ সৃষ্টির যে লক্ষ্য তা তো অর্জিত হয়ইনি, বরং বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এর প্রতি আকর্ষণ, ইসলাম কবুল করনেওয়ালা ভাগ্যবানদের সংখ্যা বেড়ে গেছে পূর্বের তুলনায় ৬৭% হারে। মিশরে প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের ১৯৮৭ সালে মস্কোর কমিউনিস্টদের সম্মেলনে জগৎবিখ্যাত কারী আবদুল বাসেতকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের সঙ্গী করে। সম্মেলনের শেষের দিকে নাসের সেখানকার কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়ে কারী আবদুল বাসেতকে বললেন, কুরআন তিলাওয়াত করে শুনাতে। তিনি ২ রুকু পরিমাণ চোখ বুঝে তিলাওয়াত করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলেন শ্রোতারা সব ভাব-বিহবল, মন্ত্রমুগ্ধ যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন, তাদের অনেকের চক্ষু থেকে ঝরছে অশ্রæধারা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা তো গডে বিশ^াস করো না, তবু কেন আবেগাকুল হয়ে কাঁদলে? তারা বললেন, অদ্ভুত এই অনুভূতি। অবর্ণনীয় এ মুগ্ধতা। কারী বাসেত বললেন, এ হলো কুরআনের মুজেযা।
ফরাসী ভাষায় কুরআনের অনুবাদক খ্রিস্টান পÐিত ডা. সেল লিখেছেন: ‘কুরআনের ন্যায় অনন্য সাধারণ গ্রন্থ কোন মানুষ রচনা করতে পারে না। এটি একটি জীবন্ত মোজেযা বৈ আর কিছু নয়, যে মুজেযা মৃতকে জীবিত করার চাইতেও বিস্ময়কর।’ সকল নবী-রাসূলের মুজেযা তাদের ইন্তেকালের সাথে সাথে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ^নবীর শ্রেষ্ঠ মুজেযা আল কুরআন কোন দিনই শেষ হবে না, থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। যেমনটা মিশরের কবি ইমাম শরফুদ্দীন আল-বসিরী রহ. তাঁর সুবিখ্যাত কাসিদায়ে বুরদায় লিখেছেন :
অনাদি সেই সত্তা সম কুরান ‘কাদিমÑ শুরু বিহীন
অথচ তার অর্থমালা চির নতুন, চির নবীন।
সব কিতাবের শ্রেষ্ঠ কিতাব, শ্রেষ্ঠ এ যে সব মুজিযার
শেষ হয়েছে সব মুজেযা, হবে না শেষ এই মুজিযার।
তাই ওরা আগুনে পুড়িয়ে, এর পাতা ছাই, ভষ্ম করে, এর অবিনশ^রতা, এর আবেদন কোন দিন শেষ করতে পারবে না। তেমনি শত কুৎসা রচনা-রটনা করেও, শত ব্যাঙ্গচিত্র অঙ্কন করেও আল্লাহর হাবীব বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা বিন্দু-বিসর্গও ক্ষুণœ করতে পারবে না। ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লার’ সুর-ঝঙ্কার দিনরাতের ২৪ ঘণ্টার, প্রতিটি মিনিটে মিনিটে দুনিয়ার সর্বত্র, সর্বক্ষণ, আকাশে বাতাসে ধ্বনিত, রণিত হতে থাকবেই।
তবু আফসোস করে বলতে হয়, ইসলামী উম্মাহর আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসির পক্ষ থেকে, প্রায় ৬০টি মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই কুরআন অবমাননা, রাসূল অবমাননার যেমন বলিষ্ঠভাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করা কর্তব্য ছিল তেমনটা পরিলক্ষিত হয়নি। এটা ঈমানী দায়িত্ব। দেশের আইনের আওতায় থেকে, শরয়ী বিধান মেনে উম্মাহর সদস্যদের তা পালন করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।