Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভূমি ও মানচিত্র রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকা এবারের দীর্ঘস্থায়ী বন্যার শিকার হয়েছে। নদীর পানি বেড়ে ওঠার সময় বিভিন্ন জেলায় তীব্র নদীভাঙ্গণে অনেক গ্রাম জনপদ এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নদী গভে বিলীন হওয়ার চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পানি কমতে শুরু করার সাথে সাথে এখন নদীভাঙ্গনের তীব্রতা আগের চেয়ে গেছে। উজানে ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে একদিকে শুকনো মওসুমে দেশের অধিকাংশ নদনদী পানিশুণ্য হয়ে পড়ছে। কোথাও কোথাও মরুপ্রক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নদীতে পর্যাপ্ত পানির অভাবে বড় বড় সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে। আবার স্রােতহীন নদীতে পলি জমে নদীর পানিধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বর্ষার শুরুতেই খুলে দেওয়া ফারাক্কা-গজলডোবা বাঁধের পানিতে আকষ্মিক বন্যায় উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় আমাদের কৃষকরা। এরচেয়ে দু:খজনক বাস্তবতা হচ্ছে, নদীভাঙ্গনের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার পরিবার জমিজিরাত হারিয়ে নিস্ব ও উদ্বাস্তু জনগোষ্টিতে পরিনত হচ্ছে। এরাই আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের খোঁজে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে এসে বস্তি, বাঁধ ও রাস্তার পাশে বসবাস করে শহরের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে। নদীভাঙ্গনের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার গ্রামীন স্বচ্ছল কৃষক পরিবার অতিদরিদ্র শ্রেণীতে পরিনত হচ্ছে। আমাদের আভ্যন্তরীণ ডেমোগ্রাফি এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

কয়েকমাস ধরে দেশের অধিকাংশ নদনদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এখন নামতে শুরু করার সাথে সাথে বেড়ে গেছে নদীভাঙ্গন। পানিতে তলিয়ে যাওয়া বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে বা বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার মানুষ এখন নদীভাঙ্গনে নিজেদের পিতৃপুরুষের ভিটামাটি হারিয়ে নি:স্ব হতে বসেছে। পদ্মা, যমুনা, ধরলা, মধুমতি, ইছামতি, ধলেশ্বরীর ভাঙ্গনে ইতিমধ্যেই শত শত গ্রাম ও বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেই সাথে বিলীন হয়েছে অনেক বাঁধ, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদরাসাসহ অসংখ্য কাঁচা-পাকা বাড়িঘর, ইমারত ও প্রতিষ্ঠান। এসব ধ্বংসযজ্ঞের অর্থনৈতিক ক্ষতির অংক বিশাল। তবে শুধুমাত্র টাকার অঙ্কে বা অর্থনৈতিক মানদন্ডে এই ক্ষতির হিসাব শেষ করা যাবে না। নদীভাঙ্গনের ডেমোগ্রাফিক ক্ষতি আমাদের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নাগরিক জীবনকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। একদিকে দেশের অসংখ্য মানুষ সহায়-সম্পদ হারিয়ে নি:স্ব হচ্ছে, অন্যদিকে সীমান্ত নদীর ভাঙ্গনে স্থায়ীভাবে ভূমি হারাচ্ছে দেশ। প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, নদীভাঙ্গনে উপুকলীয় দ্বীপজেলা ভোলা গত ৫ দশকে প্রায় ৩৫ শতাংশ ভূমি হারিয়েছে। সত্তুরের দশকে ৫৫৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভোলা এখন ৪০০ বর্গকিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে হাতিয়া, সন্দ্বীপ, সোনাদিয়াসহ উপকুলীয় চরাঞ্চলের শত শত কিলোমিটার ভূমি নদী ও সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। শুরুতেই বাঁধ নির্মান করে ভূমি রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হলে এসব চরাঞ্চল সমৃদ্ধ জনপদে পরিনত হতে পারত। নদী ভাঙ্গনে দেশের সমৃদ্ধ জনপদগুলোর মানচিত্র বদলে যাওয়ার যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তার বিপরীতে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। তিস্তা, সুরমা-কুশিয়ারা, ফেনী ও খাগড়াছড়ির সীমান্ত নদীগুলোর ভাঙ্গনে ভারতের সাথে আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখায় বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। নদীভাঙ্গনে সীমান্তপিলারগুলো নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়ে সীমান্তরেখায় ভূমি বিরোধ নতুন বাস্তবতা লাভ করেছে। আন্তসীমান্ত রক্ষাকারী নদীগুলোর ভাঙ্গনে জমি হারানোর আশঙ্কা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দূর করতে হবে।

আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলছি। ডিজিটাল, আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপরেখা তুলে ধরছি। কিন্তু লাখ লাখ মানুষের নদীভাঙ্গনে নি:স্ব হয়ে যাওয়া এবং দেশের শত শত কিলোমিটার ভূমি বিলীন হয়ে যাওয়ার চরম বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন দেখছি না। উজানের ঢলে সাংবাৎসরিক আকষ্মিক বন্যায় ফসলহানি এবং নদী ভাঙ্গনের হুমকি থেকে রক্ষা করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়া সত্যিকার অর্থে সামাজিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। নদীভাঙ্গন স্থায়ীভাবে রোধ করতে হলে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদ-নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেই সাথে ভাঙ্গন রোধ ও নদী শাসনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে বাঁধ, গ্রোয়েন এবং জলাধার নির্মানের টেকসই, স্থায়ী ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষত সীমান্তনদীর ভাঙ্গনে ভারতের কাছে বাংলাদেশের ভূমি হারানোর বাস্তবতার আলোকে মধ্য স্রােত নীতির পর্যালোচনা ও পরিবর্তনের কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। যৌথ নদীর উজানে নির্মিত বাঁধের স্লুইসগেট যখন তখন খুলে দেয়া এবং যথেচ্ছ পানি প্রত্যহারে ভারতকে একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেআইনী তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। যৌথ নদী কমিশনকে অবশ্যই তার যথাযথ সক্রিয়তা ও কার্যকারিতা প্রমান করতে হবে। সর্বোপরি নদীভাঙ্গন রোধে কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি নদীভাঙ্গনে নি:স্ব হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পুনর্বাসনসহ নিজ নিজ পেশা অক্ষুন্ন রাখার উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নদীভাঙ্গন, আকষ্মিক বন্যা ও হাওরের মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তাসহ উন্নয়ন নিশ্চিত করা ছাড়া বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন