পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার (দহগ্রাম থেকে ফিরে) : ‘ওইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে/ ত্রিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে’ (জসীমউদ্দীন)। পল্লীকবির ‘কবর’ কবিতায় নাতিকে তার দাদির কবর দেখানোর মতোই দহগ্রাম আঙ্গরপোতা ছিটমহলের সর্দার পাড়া গ্রামের শুক্কুর আলী তিস্তা নদীর মাঝখানে ভেসে যাওয়া একটি কলাগাছ দেখিয়ে বললেন, ওইখানে আমার দুই বিঘা জমি ছিল। প্রচুর ধান হতো। গত তিন বছরে নদী ভেঙে সে জমি এখন মাঝ নদীতে। নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া রফিকুল ইসলাম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার ৭ বিঘা জমির ২ বিঘা নদী গর্ভে গেছে। এক বিঘার অর্ধেক ধান এখন নদীতে গেছে। এখনো ভাংছে। দূর থেকে দেখা গেল লুঙ্গি পরিহিত উদোম শরীরের একজন লকলকে ধানের গাছের পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে নদীর পানে তাকিয়ে আছেন আনমনে। নদী গর্ভে চলে যাওয়া ধানী জমিতে বসে থাকা ওই যুকবকে দেখে সঙ্গী প্রফেসর ইফতেখার মোবাইলেই ছবি তুললেন। তিস্তার ভাঙনে ছোট হয়ে আসছে দহগ্রাম আঙ্গরপোতা ছিটমহল। তিস্তার ভাঙনে ছিটমহলের মহিমপুর, সর্দার পাড়া, পশ্চিম বাড়ি, সৈয়দ পাড়ার আয়তন ছোট হয়ে আসছে। নদীর অপর প্রান্তে ভারতের দিকে চারালাইল, ধাপড়া, মেকলিগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, হলদিবাড়িতে জাগছে নতুন নতুন চর। জমি বাড়ছে ভারতে আর ছোট হয়ে আসছে দহগ্রাম ছিটমহলের আয়তন।
পাটগ্রামে রিকশা ভাড়া নেয়া হয়। সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করে সকালেই রওয়ানা দেয়া হলো। তিনবিঘা করিডোরে কয়েকটি ছবি তোলা হলো। করিডোর পার হয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা এগিয়ে চলছে। গন্তব্য ছিটমহলের শেষপ্রান্ত। সানিয়াজান নদীর ওপর সরু ব্রিজ। রিকশা থেকে নেমে পায়ে হেটে উঁচু ব্রিজ পেরুতেই কয়েকজন জানালেন, তিস্তা নদীর এখনো ভাংছে। গত তিনচার দিনে কয়েক গজ ভেঙেছে। সঙ্গী প্রফেসর ইফতেখার আহমেদের নির্দেশে গন্তব্য পরিবর্তন করে রিকশা ছুটতে শুরু করলো তিস্তা নদীর দিকে। কাছে যেতেই ঘিরে ধরলো আশপাশের গ্রামের মানুষ। তিস্তা নদী নিয়ে তাদের পেটে কত যেন দুঃখের গল্প জমা হয়ে আছে। পত্রিকার লোক পেয়ে সবাই সে কথা এক সঙ্গে প্রকাশ করে হালকা হতে চায়। ধানী জমি নদীগর্ভে যাওয়ায় সবার মন খারাপ। হায় আল্লাহ! ধানের থোর (মৌল) এসেছে। সেই ধানি জমি যাচ্ছে নদীর পেটে? নদীর কাছে পৌঁছে রিকশা থেকে নেমে পায়ে হেঁটে চলতে শুরু করলাম। কয়েকটি ধান ক্ষেত পার হয়েই তিস্তা নদীর পাড়। হায়রে তিস্তা নদী! তোর একি পাগলামো? তোর ‘একুল ভাঙে ওকুল গড়ে’ খেলায় কতজন সর্বস্ব হারাচ্ছে। তিস্তার ত্রিমুখী ভাঙনে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল সংকুচিত হয়ে আসছে। নদীর ভাঙন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের মানচিত্রে পরিবর্তন ঘটবে। মানচিত্রে দহগ্রাম ছিটমহল ছোট হবে। তিস্তার ভাঙন দেখতে নদী পাড়ে দাঁড়াতেই সর্দারপাড়া গ্রামের জাকির হোসেন নিজের জমি দেখিয়ে দিয়ে বললেন, দুই বিঘা জমির এক বিঘা কয়েকদিনের মধ্যে নদীতে গেছে। নদীর মাঝখানে দেখিয়ে বললেন ওই খানে আমার এক বিঘা জমি ছিল। গত বছর ভেঙেছে। যে সুন্দর ধান হয়। নদী না ভাঙলে ৩ লাখ টাকা বিক্রি করা যেত।
সরেজমিন ঘুরে দেখে মনে হলোÑ লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে তিস্তার ভাঙনে জমি প্রতি বছরই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে অল্পদিনের মধ্যে দেশের মানচিত্রে ৩৫ বর্গ কিলোমিটারের ছিটমহলটি আরও অনেকাংশে কমে ছোট হয়ে যাবে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অচিরেই হয়তোবা ছিটমহলটির অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না এ আশঙ্কা ভুক্তভোগীদের। তিনদিকে ভারতীয় ভূ-খ- এবং একদিকে করালগ্রাসী তিস্তা নদী পরিবেষ্টিত ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা দিন দিন ছোট হয়ে আসছে; অথচ কারো যেন মাথাব্যথা নেই। এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অনেক ঘরবাড়ি, জমিজমা, রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ছিটমহলবাসীর আবাদি ফসল। ছিটমহলে মোট জমির পরিমাণ ১৮৭৮ হেক্টর। আর আবাদী জমির পরিমাণ ১৫৮০ হেক্টর। এরই মধ্যে কয়েকশ’ হেক্টর জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। নদী ভাঙন রোধে ৭ কোটি টাকা ব্যায়ে ব্লক ফেলা হচ্ছে। কিন্তু নামকাওয়াস্তে ব্লক ফেলায় নদী ভাঙন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দেখে ব্লক ফেলা কাজে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি বার বার অনুরোধ করেন পত্রিকায় রিপোর্ট লেখা হলে তার চাকরি যাবে। তাই রিপোর্ট লেখার আগে যেন আমরা কন্টাক্টরের সঙ্গে দেখা করি। কি কারণে কন্টাক্টারের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করছেন তা রহস্যজনক।
সর্দার পাড়ার রফিকুল ইসলাম জানান, ৫০ বছর আগে তারা কুড়িগ্রাম থেকে দহগ্রামে এসেছেন। জমিজমা ছিল প্রচুর। অর্ধেক জমি নদী গর্ভে গেছে। তার অভিযোগ ছিটমহলের মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখার কেউ নেই। জানালেন, ভারতীয় অংশে স্পার নির্মাণ করে পরিকল্পিতভাবে তিস্তার গতি পরিবর্তন করে দেয়ায় দহগ্রামের দিকে নদী ভাঙন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা তিস্তা নদীর ভাঙনে অনেক কিছু হারিয়ে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের অভিযোগ দহগ্রামের জেগে ওঠা ধুঁ ধুঁ বালুচর বর্তমানে ভারতীয়দের দখলে। সেখানে বসত গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। জেগে ওঠা চরে বিএসএফ সদস্যরা জোরপূর্বক ক্যাম্প স্থাপন করেছে। ইতোমধ্যেই করালগ্রাসী তিস্তার ভাঙনে কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৭শ’ পরিবারের ঘরবাড়ি। প্রতি বছরই ছিটমহলটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে আয়তন কমে যাচ্ছে। ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ তালেব আলীর সাথে কথা হলে তিনি দুঃখ করে বলেন, প্রায়ই ‘উপোস’ থাকতে হয়। কাজ না পেলে ঘরে কোনো খাবার থাকে না। চুল-দাড়ি পেকে বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও অভাবের তাড়নায় মানুষের বাড়িতে দিন হাজিরা দিতে হয় তাকে। বললেন, ‘মাইনষের বাড়িত কাম (কাজ) না করলে ভাত জোটে না। ৫ বিঘা ধানি জমি ছিল। চাষাবাদ করে সংসার ভালোই চলছিল। রাক্ষসী তিস্তার পেটে গেছে সেই জমি। বুড়ো মানুষ বলে কাজে নিতে চান না গেরস্থরা। কাজ না করলে অনাহারে থাকতে হবে জানালে দয়া করে কেউ ক্ষেত মজুরের কাজ দেয়, কেউ দেয় না। বৃদ্ধা স্ত্রী, ১ কন্যা সন্তান নিয়ে প্রায়ই অনাহারে থাকতে হয়। একই গ্রামের মোঃ আলী জানান, ৫ বিঘা জমি ছিল, তিস্তার ভাঙনে বর্তমানে ২ বিঘা জমি আছে। তার এক অংশ এবার ভেঙে নিয়ে গেছে তিস্তা। বর্তমানে অন্যের জমিতে খড়ের ঝুপরি ঘর তুলে কোনোমতে আছেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল মহিমপাড়া এলাকায় একশ’ মিটার এলাকায় সিসি ব্লক ফেলে বাঁধ দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। কাজ এখন বন্ধ। ভুক্তোভোগীরা জানান, তিস্তা নদী দহগ্রাম অংশের প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন চলেছে। অথচ বাঁধ দেয়ার চেষ্টা মাত্র ১০০ মিটার!
নদীর পাড়ে অনেকগুলো লোক দেখে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া সর্দার পাড়ার মোহাম্মদ আলী থামলেন। তারও যেন মনের ভিতর অনেক কথা বলার আছে। বললেন, স্যার গত ৪ বছরে তিস্তা নদী প্রায় এক কিলোমিটার ভেঙে দহগ্রমের পেটে ঢুকেছে। নদীর পাড় থেকে আগে দেওয়ানগঞ্জ, হলদী বাড়ির পিলার দেখা যেন। এখন দেখা যায় না। ওরা পিলার ফেলে দিয়ে চরের নতুন জমি দখল নিয়েছে। নদীর ভাঙন ঠেকাতে দুই বছর আগে যে ব্লগ ফেলা শুরু হয় সে কাজ এখন বন্ধ। সর্দার পাড়ার সাহেবের পুত্র হামিদুল বলেন, আমার ৫ বিঘা জমি নদীর পেটে গেছে। দহগ্রামের মাটিতে ধান তো নয় সোনা ফলে। অথচ নদীগর্ভে জমি চলে যাওয়ায় দারুণ কষ্টে দিনযাপন করছি। দহগ্রামের মোহাম্মদ আলী, রফিকুল ইসলামদের দীর্ঘ নিঃশ্বাস শুনেও দেরি করা গেল না। সীমান্তে যেতে হবে। অতএব অনেকটা স্বার্থপরের মতোই তাদের সেখানে রেখেই রওয়ানা দিতে হলো সীমান্তপানে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।