পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, বীর-উত্তম খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি আমার সহোদর। আমার বড় ভাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের অধীন জালালপুর সাব-সেক্টরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। লে. কর্নেল সি. আর. দত্ত (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্ত) ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন আমার ভাই কমান্ডার নিজাম। সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলায় তিনি শায়িত আছেন চিরনিদ্রায়। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘বীর-উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে। এ ব্যাপারে জেনারেল দত্ত জানান, মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ নেতৃত্ব আর সমরনৈপুণ্যের পটভূমিতে ৪ নং সেক্টর থেকে নিজামের পক্ষে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাব প্রস্তাব করা হয়। ৪ নং সেক্টরের ৪০০ থেকে ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং তাদের বিপর্যস্ত করে তোলেন। কমান্ডার নিজামের বয়স তখন সবে বাইশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক নিজাম একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ (ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)-এর তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র। হাজী মোহাম্মদ মহসিন হলের আবাসিক ছাত্র থাকাকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ’৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে বর্বর তান্ডবলীলা চালায়, তিনি তা প্রত্যক্ষ করেন মহসিন হলের আবাসিক ছাত্র থাকাকালে। ঘোষিত কারফিউ কিছুটা শিথিল হলে, তিনি ফিরে এলেন পিতৃভূমি কুমিল্লাতে। বাড়িফেরার পথ ছিল বিপদসংকুল। বাড়িতে থাকতে পারলেন মাত্র কয়েকদিন। সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করবেন। একাত্তরে, এপ্রিলের প্রথম দিকেই জনাকয়েক বন্ধু মিলে ঘর ছাড়লেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার উদ্দেশ্যে। বাবা-মাকে জানালেন না কিছুই। সেখানে মিলিটারি ট্রেনিং সম্পন্ন হলে, তাদেরকে পাঠানো হলো সিলেটে, মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরে। কিছুদিনের ভেতরেই জালালপুর সাব-সেক্টরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে পদোন্নতি হলো নিজাম ভাইয়ের। আর কমান্ডার হিসেবে সেখানে দায়িত্ব পেলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন এক তরুণ নেতা।
জালালপুর সাব-সেক্টরে, এলাকাবাসী তাকে ক্যাপ্টেন নিজাম হিসেবে চিনত। সেখানে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার নাম থেকে আসা ‘নিজাম নগর’ এলাকা, তার জনপ্রিয়তার মাত্রা ধারণ করে আছে। অনেক ধকল সহ্য করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁর মৃতদেহটি ৫-৬ কি.মি. দূরে বয়ে আনেন তারই সহকর্মী-এলাকাবাসী। তাঁকে কবরস্থ করা হলো জালালপুর মোকাম টিলাতে। যুদ্ধ শেষ হলে, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাঁর কবরস্থানটি ইট-সিমেন্ট-বালুতে পাকা করে দেয় এবং সেখানে স্থাপন করে দেয় পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত ফলক।
মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমিও যুদ্ধ করেছি ২ নং সেক্টরে। আমি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি আসামের তেজপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে। প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে আমি ও আমার দলের বাকি সদস্য একাত্তর সালের আগস্ট মাসে, ত্রিপুরার সাবরুমে অবস্থিত বাইকোরা নামক স্থানে অপেক্ষা করি। উদ্দেশ্য, কুমিল্লা বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ। নিজাম ভাই জানতেন আমিও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছি এবং শীঘ্রই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আগস্ট মাসেই তিনি ভারতের শিলচর থেকে আগরতলা আসেন একটা মিটিংয়ে যোগ দিতে। আর্মি জিপে করে সেনাপোশাকেই আসেন। আগরতলা থেকে আমাকে খবর পাঠালেন, ওখানে অবস্থিত একটা রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়ে আমি যেন তাঁর সাথে দেখা করি। ক্যাম্পটা শহর থেকে কয়েক কি. মি. দূরে। ওই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন অ্যাডভোকেট আমির হোসেন, এমসিএ, আমাদের বুড়িচং এবং ব্রাহ্মণপাড়া নির্বাচনি আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
খবরটি আমার কাছে দেরিতে আসে। আগরতলা পৌঁছে, ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য যখন ক্যাম্পে যাই, আমাকে জানানো হলো, তিনি এতক্ষণে সড়কপথে সেক্টরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন। দেখা না হওয়ায়, ভেতরে ভেতরে বেশ কষ্ট পেলাম। সপ্তাহখানেক বাদে খবর আসে, আমার ভাই, কমান্ডার নিজাম পাকিস্তান আর্মির সাথে সম্মুখসমরে নিহত হয়েছেন। আমরা সে সময় আমাদের যুদ্ধক্ষেত্র, কুমিল্লায়। দিনটি ছিল সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ। ভোরবেলা। ওই দেখা না-হওয়াটা আজীবন আমাকে ব্যথা দেবে।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। স্বাধীন বাংলাদেশ। ভাইয়ের কবরস্থান দেখা, সেইসাথে তাঁর সেখানকার সহযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, এই দুই উদ্দেশ্য নিয়ে, সিলেটে যাই। কুমিল্লার সাথে সিলেটের সড়ক যোগাযোগ মোটেই ভালো অবস্থায় ছিল না- অধিকাংশ ব্রিজ-কালভার্টই যুদ্ধে বিধ্বস্ত। বেশ কষ্ট করেই সিলেটে পৌঁছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, নেতা-নেত্রী আর ভাইয়ের সহযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাৎ করি। সবাই সানন্দে অভিবাদন জানায়। যুদ্ধে ভাইয়ের ভূমিকা, নেতৃত্ব, তাঁর ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব- এসব নিয়ে অনেক প্রশংসা করলেন সকলে। আমাকে বলা হলো, সিলেট সারকিট হাউজে অবস্থানরত ভারতীয় সেনা অফিসার কমান্ডার নিজামকে ভালোভাবে চিনতেন। তিনি ছিলেন রাজপুত ডিভিশনের ক্যাপ্টেন কুমার। তাঁর সাথে দেখা করতে সারকিট হাউজে যাই এবং আমার পরিচয় জেনে, আমাকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন, পরিবারের অপর সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নিজাম ভাইয়ের প্রশংসা করলেন। আমার মনের অভিপ্রায় জানালে, তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে সিলেট শহর থেকে জকিগঞ্জ হয়ে ৩৩ কি.মি. দূরে একটি নদীর তীর পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। সাথে ছিলেন তার সহধর্মিণীও। ভদ্রমহিলাও ক্যাপ্টেন নিজাম সম্পর্কে বেশ জানতেন। আমাকে যেহেতু কিছু সময় ওখানে থাকতে হবে, স্থানীয় নেতা ও জনগণের সাথে আলাপ করতে হবে, তাই তাঁরা দু’জন সিলেট ফিরে গেলেন। তারপর নৌকায় নদী পার হয়ে নিকটস্থ বাজারে পৌঁছলাম। স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল মেম্বারসহ সেখানকার নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ হলো। বাজার থেকে ২/৩ কি.মি. দূরে কবরস্থান। সবাই আমাকে ওখানে নিয়ে গেলেন। কবর জিয়ারত করলাম। ক্যাপ্টেন কুমারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অশেষ। তার সেই মুগ্ধ করা আতিথিয়তা ভুলবার নয়। কত বছর পেরিয়ে গেল! যদি জানতাম, তিনি এখন কোথায় আছেন!
নিজাম ভাইয়ের চেয়ে আমি দুই বছরের ছোট। ভাই যে বছর বিকম-অনার্সে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, তখন আমি ক্লাস নাইনের ছাত্র। তিনি ঢাকায়, আমরা কুমিল্লায়। ছুটিতে বাড়ি এলে, তবেই দেখা-সাক্ষাৎ। এর বাইরে খুব একটা নয়। গান-বাজনা খুব ভালোবাসতেন তিনি। ঢাকায় হাওয়াইয়ান গিটার বাজানো শিখতেন, বিখ্যাত গিটারিস্ট জনাব বোরহান আহমেদের কাছে। কুমিল্লা এলে, গিটারটি নিয়ে আসতেন। প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কখনও আধুনিক গান, কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাতেন। শুনেছি, ঢাকায় বিভিন্ন ওপেন এয়ার কনসার্টে বাজিয়েছেন। যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যেদিন ঢাকা ছাড়লেন, তালা ঝোলালেন মহসিন হলের সিঙ্গেল সিটের কক্ষটিতে, সেদিন সেই গিটারটিও ওখানে ছেড়ে এসেছিলেন। চলমান কারফিউ এ বিচ্ছেদ গড়ে দিল, গিটারে আর গিটারিস্টে। ১৯৭২ সালের মার্চে আমি মহসিন হলে যাই, ভাইয়ের জিনিসপত্র, বিশেষ করে তাঁর পছন্দের গিটারটি নিয়ে যেতে। পারিবারিক এক স্মৃতিরঝর্ণা হতে পারত সে-সব! হলো না! কক্ষের তালা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। কিছুই পাইনি অবশেষে। মনে পড়ে এইচএসসি পাস করে, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে, এই কক্ষেই ভাইয়ের সাথে এক সপ্তাহ কাটিয়েছি। কত কথা হয়েছে দু’ভাইয়ে। ভুলি কী করে একসাথে কাটানো সেইসব মুহূর্ত! তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন। বন্ধুদের নিয়ে একটা দল গড়লেন। ‘কালচক্র’ নামে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হলো, তাঁরই সম্পাদনায়।
একটি পরিবার। বাবা-মাসহ ছয় ভাই আর তিন বোন। সকলের প্রতিই তিনি ছিলেন পূর্ণ সজাগ। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সাব-ডিভিশনে ঘুরেছেন। ভাই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাবা খরচ যোগাতেন। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে ভাই চাকরির জন্য ঘুরলেন। বাবার কাছ থেকে আর খরচ নিতে চাইলেন না। বলতেন, ‘মাস্টার্স পর্যন্ত তো বাবাই সবকিছু করলেন। এখন নিজেরই কিছু একটা করা দরকার।’ খুব দেরি হলো না ‘কন্ট্রোলার অব স্টোরস’ হিসেবে তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যোগ দিলেন। ওদের ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্ট দেখতেন বিশিষ্ট টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান, এফসিএ। একই সাথে চালিয়ে গেলেন লেখাপড়াও, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আইবিএ’র সান্ধ্যকালীন এমবিএ-তে। আর বেতনের কিছুটা বাবাকে পাঠাতে থাকলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। মুক্তিযোদ্ধারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসছে সবকিছু। এমনই সময়ে নিজাম ভাইয়ের বেশ ক’জন সহযোদ্ধা কুমিল্লায় আমাদের বাড়িতে আসতেন, বাবা-মায়ের সাথে আলাপ করতে। দুঃখ প্রকাশ করতেন। বাবা মাঝে মাঝে তাদের সামনেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন, কেঁদে ফেলতেন। একা ঘরেও তিনি চোখ মুছতেন। বাবাকে এমন দেখলে, আমার ভেতরেও আবেগ জেগেছে, চোখের জল ঝরেছে। চেষ্টা করেছি, হৃদয়ে স্থির হতে। বাবা-মাকে বোঝাতে চেয়েছি, এ নির্মম বাস্তবতা সামলে নেয়ার শক্তি-সামর্থ্য আমার আছে। আমার তখন বিশ বছর বয়স, সবে দ্বিতীয় বর্ষ অর্থনীতি (সম্মান) নিয়ে পড়ছি। পরিচিতজন, স্বজনেরা প্রত্যেকেই আমার ভাইকে ভালোবাসতেন। তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের জীবনে আজও স্মৃতির শব্দ হয়ে বাজে, বাজতে থাকবে... তাঁর জন্য সকলের কাছে দোয়া চাই। প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহ সুবহানুতায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।
লেখক: একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার সহোদর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।