পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আধুনিক এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা থেকে শুরু করে অধিকাংশ পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যম, চোখ ধাঁধানো হলিউডি ক্লাসিক, গুগল সার্চইঞ্জিন, উইকিপিডিয়া এবং সাম্প্রতিক ফেইসবুক-টুইটার, ইনস্ট্যাগ্রাম পর্যন্ত সব মিডিয়াই মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতহীন আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা ইসলামোফোবিক এজেন্ডা পশ্চিমা সমাজের মাল্টি-কালচারালিজম ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঐতিহ্যের প্রতি বড় ধরনের হুমকি হয়ে নিজেদের জন্য বুমেরাং হয়েছে। ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে প্রথমে পশ্চিমা সমাজমানসে মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব তৈরি করা, অতঃপর ফল্স ফ্লাগ অপারেশন ও টেররিজমের ফেইক অভিযোগ তুলে মূলধারার মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে ডি-স্ট্যাবিলাইজ ও রিজাইম চেঞ্জ’র এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের হাজার হাজার কোটি ডলার অস্ত্র বাণিজ্যের চিত্র ইতোমধ্যে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্য ও সাম্প্রতিক বিশ্ববাস্তবতা প্রত্যক্ষ করলে দেখা যাবে, পশ্চিমাদের সেই এজেন্ডা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে মার খেয়েছে। তবে ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় ইসলাম বিদ্বেষী কর্মকান্ড কখনো বন্ধ হয়নি। এই বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের কাছে সহজলভ্য, গ্রহণযোগ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেইসবুকের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এই সোশ্যাল মিডিয়া পূর্ব-পশ্চিমের ভৌগোলিক দূরত্ব, সামাজিক-অর্থনৈতিক পার্থক্য ও বৈষম্য ঘুচিয়ে এককাতারে সামিল করে দিয়েছে সবাইকে। ফেইসবুকের কর্পোরেট প্রচরাণা ও বিজ্ঞাপনগুলো মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বের কয়েক বিলিয়ন মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এ ধরনের সহজ প্রচারণার এক্সেস পাওয়া বিশ্বের আর কোনো যোগাযোগমাধ্যমের পক্ষে আর কখনো সম্ভব হয়নি। বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের পাশাপাশি বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের মন-মগজকে ক্রমাগত ধোলাই করার এমন মোক্ষম নেটওয়ার্ক এখন মুসলিম বিদ্বেষী ইসলামোফোবিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে জায়নবাদী ও হিন্দুত্ববাদীরা একাট্টা হয়ে কাজে লাগাচ্ছে। বাহ্যিক রাজনৈতিক তৎপরতা এবং সাংগঠনিক-অর্থনৈতিক মেরুকরণের মধ্য দিয়ে তাদের এই সমন্বিত ইসলামবিদ্বেষী ঐক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে উদ্ভূত মুসলিম বিদ্বেষী দাঙ্গা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, অনৈতিক ও মানবতা বিরোধী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী আইন-কানুন পাসের মধ্য দিয়ে তা বিশ্বের সামনে হাজির হয়েছে।
বিশ্বের এক নম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আচরণ এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিলের কায়কারবার ইদানীং পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও উঠে এসেছে। টাইম ম্যগাজিন ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন অবলম্বনে গত শনিবার দৈনিক ইনকিলাবে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ধর্মীয়-রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের অন্যতম স্পর্শকাতর এলাকা হিসেবে গণ্য। এখানে যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জাতিগত সংঘাত, হানাহানি ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটে বিশ্বের আর কোনো অঞ্চলে তা ঘটে না। বিশেষত ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি শাসনের শুরু থেকে একের পর এক বিতর্কিত, বৈষম্যমূলক ও মুসলিম বিদ্বেষী কালা কানুন চাপিয়ে দেয়ার পাশাপাশি কোটি কোটি মুসলমানকে রাষ্ট্রহীন করার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। মোদি সরকার একদিকে নাগরিকপুঞ্জি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মধ্য দিয়ে ভারতের কোটি কোটি মুসলমানের উপর একটি মনস্তাত্তি¡ক চাপ ও আইনের গড়গ ঝুলিয়ে দিতে চাইছে, অন্যদিকে শত শত বছর ধরে স্বাধীন কাশ্মীরিরা বাধ্য হয়ে যে সমঝোতার মধ্য দিয়ে ভারতীয় ইউনিয়নের সাথে অঙ্গিভূত থাকার সমঝোতা করেছিল, মোদি সরকার কাশ্মীরের সে বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্বশাসন বাতিল করতে ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা এবং ৩৫-এ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দেয়। এরপর কোটি কোটি কাশ্মীরীর কণ্ঠ রোধ করতে কাশ্মীরকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। কাশ্মীরের নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদের ধ্বনি যেন বিশ্বের মানুষের কানে না পৌঁছায় সে জন্য ইন্টারনেট, মোবাইলফোন নেটওয়ার্ক পর্যন্ত বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কাশ্মীরীদের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার কোনো কণ্ঠ যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়ে তার সব পথ রুদ্ধ করতে হাজার হাজার কাশ্মিরী তরুণ-তরুণীকে জেলে ভরে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে ফেইসবুক তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক নীতিমালার প্রশ্নে নিরবতা অবলম্বন করেছে।
সত্তর বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনীদের কষ্ট চেপে রাখার অভিজ্ঞতাক কাজে লাগিয়ে কাশ্মিরসহ ভারতের পঁচিশ কোটি মুসলমানের সব রকমের অধিকার হরণে হিন্দুত্ববাদী তৎপরতা চলছে। বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী আইনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলের তেমন কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থার পক্ষ থেকেও কিছু সত্য উচ্চারিত হতে দেখা গেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র বাণিজ্যিক স্বার্থে হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম বিদ্বেষী কর্মকান্ডের সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টের এমন অনৈতিক অবস্থানের বিষয়টি পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমে উঠে আসার পরও তাদের কর্মকান্ডে বা নীতিতে কোনো পরিবর্তনের আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। শুধু ভারতেই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়া মুসলিম বিদ্বেষী দাঙ্গা ও নিপীড়িনমূলক তৎপরতার সাথে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সারাবিশ্ব থেকে ব্যাপক জনমত গঠিত হওয়ার পরও সেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রপাগান্ডার মাধ্যম হিসেবে ফেইসবুক ব্যবহার করলেও তাদের বিরুদ্ধে ফেইসবুক কোনো পদেক্ষপ নিতে রাজি হয়নি। তাদের ঘোষিত নীতিমালা অনুসারে সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ধর্মীয় সংঘাত বা বিভেদাত্মক কোনো বিষয় ফেইসবুকে আপলোড করলে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ তা রদ করার কথা থাকলেও ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম করা হচ্ছে। ফেইসবুকের এমন মুসলিম বিদ্বেষী ভূমিকার নেপথ্যের থলের বেড়ালটি অবশেষে বেরিয়ে পড়েছে।
ভারতের কোটি কোটি মুসলমানের প্রতি মোদি সরকার এবং বিজেপি সমর্থকদের ফেইসবুকে ঘৃণা ছড়ানো ও মুসলিম বিদ্বেষী সংঘাতমূলক ভূমিকার যেসব অভিযোগ উঠেছে তার প্রতিকার হিসেবে ফেইসবুক এখানে তাদের ঘোষিত নীতিমালা প্রয়োগ করেনি। এ প্রসঙ্গে টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফেইসবুক তার বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করতে কট্টর বিজেপি সমর্থক শিবনাথ ঠাকরালকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পলিসি ডিরেক্টর নিযুক্ত করেছে। করোনাকালে ফেইসবুক ব্যবহার করে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর হিন্দুত্ববাদী তৎপরতার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। বিজেপির সরকারি আইনজীবী টি রাজা সিং মুসলিম অভিবাসিদের গুলি করার আহŸান জানানোর পর রাজা সিংয়ের বক্তব্যটি এমনিতেই ফেইসবুক থেকে বøক হয়ে যাওয়ার কথা, আদতে তা হয়নি। উপরন্তু যারা রাজা সিংয়ের প্রতি চাপ সৃষ্টির আবেদন জানিয়েছিল ভারতে ফেইসবুকের আরেক নীতি নির্ধারক আঁখি দাস তাদের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করেছেন বলে আগস্টের মাঝামাঝিতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়। মোদির নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে ফেইসবুক প্রতিনিধি আঁখি দাসের বিশেষ পক্ষপাতমূলক সম্পৃক্ততা তাঁর বক্তব্যেই প্রমাণীত হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে মোদির বিজয় যখন অনেকটা নিশ্চিত, তখন আঁখি দাস এক স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘উই লিট অ্যা ফায়ার টু মোদি’স সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন’- আমরা মোদির সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইনে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ধরিয়ে দিতে পেরেছি। আঁখি দাসের রাজনৈতিক অবস্থান ফেইসবুকের ঘোষিত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হলেও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের পক্ষ থেকে ফেইসবুকের মুখপাত্র এন্ডি স্টোনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রকারান্তরে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে টাইম ম্যাগাজিন ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একাধিক প্রতিবেদনে ভারতে এবং উপমহাদেশে ফেইসবুকের নীতি ভঙ্গের অভিযোগগুলো স্পষ্ট হয়ে গেছে।
জায়নবাদী ও পশ্চিমা বর্ণবাদী নিওকন সা¤্রাজ্যবাদীদের ইসলামোফাবিক এজেন্ডা এখন ভারতে নতুন মাত্রা বিস্তার লাভ করেছে। নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি অনুৎঘাটিত নাশকতামূলক কর্মকান্ডের সাথে মুসলমানদের অভিযুক্ত করার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে পরবর্তীতে মুসলিম অভিবাসন বিরোধী আইন ও নীতিমালার পক্ষে একটি কট্টর জনমত প্রতিষ্ঠা করার ছিল ইসলামোফোবিয়ার মূল লক্ষ্য। একই ধারা অনুসরণ করছে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা, তাদের লক্ষ্য ভারত ও এ অঞ্চলের প্রায় শতকোটি মুসলমানকে অধিকার বঞ্চিত করা ও মনস্ত¡াত্তিকভাবে চাপে রাখা। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারীর আতঙ্ককে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম বিদ্বেষী এজেন্ডায় ব্যবহার করতে গিয়ে করোনাজিহাদ ট্যাগ দিয়ে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে। যদিও জনসংখ্যার বিচারে ভারতে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা পশ্চিমা যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু তারা এমন একটি বৈশ্বিক মহামারীকে আভ্যন্তরীণ মুসলিম বিদ্বেষী এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করতে গিয়ে বিশ্বের সামনে নিজেদের কদর্য চেহারাটা প্রকাশ করে দিয়েছে। হিটলার-মুসোলিনী, ট্রাম্প-মোদি বা নেতানিয়াহুর অনুসারীরা তাদের মতো করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তবে মূল ধারার কর্পোরেট মিডিয়ার বাণিজ্যিক স্বার্থ, রাজনৈতিক পক্ষপাত ও হেজিমনিক এজেন্ডার বাইরে, মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত, আঞ্চলিক ও অরাজনৈতিক-অসাম্প্রদায়িক অনুসঙ্গের কারণে সহজগম্য সামাজিক মাধ্যম হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ফেইসবুকের মুনাফাবাজির নীতির কারণে এমন মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক অবস্থানকে এই মাধ্যমটির জন্য একটি আত্মঘাতী প্রবণতা হিসেবে গণ্য করা চলে। ধর্ম-বর্ণ, ভাষা-সংস্কৃতি নির্বিশেষে বিশ্বের প্রায় সব মানুষ এই মাধ্যমটিকে নিজের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিল বলেই এটি আজ শত শত কোটি মানুষের আস্থার প্লাটফর্ম হয়ে উঠতে পেরেছে। হিন্দুত্ববাদীদের সাথে আপস করে শতকোটি মুসলমানের অধিকার ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফেইসবুক তার আস্থার ভিত্তিভূমির উপর কুঠারাঘাত করে টিকে থাকবে পারবে না। আমরা এখনো বিশ্বাস করি, ফেইসবুক তার ঘৃণা বিরোধী নীতিমালায় অটুট থাকবে। হিন্দুত্ববাদী বা জায়নবাদী শক্তির সাথে আপস করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আস্থার সংকট সৃষ্টি করবে না। শতকোটি মুসলমানের মনে ফেইসবুকের প্রতি একবার অনাস্থার সৃষ্টি হলে শিবনাথ ঠাকরাল বা আঁখি দাসদের মতো হিন্দুত্ববাদী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিজেপির সাথে আঁতাত করে ফেইসবুক তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না।
প্রকাশিত রিপোর্টগুলো থেকেই বোঝা যাচ্ছে, ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম বিদ্বেষী তৎপরতা, অপপ্রচার ও দাঙ্গা-সংঘাতের মাত্রা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। একদিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা মেইনস্ট্রিম মিডিয়া, অন্যদিকে ফেইসবুকের মতো প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিরব সমর্থন ও গোপন আঁতাতের কারণে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ফোরামের সমালোচনা ও নিন্দার পরও মুসলিম বিদ্বেষী ঘৃণা, উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ও দাঙ্গা সৃষ্টিকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠতে সাহস পেয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তারা বিশ্ববিবেকের উপর বিদ্রæপের চোখ রেখে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবলিলায় নারকীয় গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যা এতটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, জাতিসংঘ একে ‘টেক্সটবুক এক্সাম্পল অব এথনিক ক্লিনজিং’ বলে অভিহিত করেছে। তৎকালীন বৃটিশ পরপরাষ্ট্রমন্ত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রাখাইনের গণহত্যাকে আমাদেরকালের সবচেয়ে বর্বরতম মানবিক বিপর্যয় বলে স্বীকার করেছিলেন। রাখাইনে কয়েকশ গ্রাম জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মধ্য দিয়ে অন্তত ৩০ হাজার মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারা এবং অন্তত ২০ হাজার নারীকে গণধর্ষণ করার প্রমাণপত্র ফেইসবুকের হাতে থাকলেও আন্তর্জাতিক তদন্তকারী দলের কাছে সে সব প্রমাণাদী হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ। আমরা ভুলে যাইনি, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বন্য হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে ফেইসবুকে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছিল। এরপর শুরু হয় সমন্বিত, পরিকল্পিত গণহত্যা ও এথনিক ক্লিনজিং। গত ১৮ আগস্ট বাইলাইন টাইমস নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত স্টিভ শ’র লেখা একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘ফেইসবুক উইদহোল্ডিং এভাইডেন্স অব মিয়ানমার্স রোহিঙ্গা জেনোসাইড।’ সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সভ্যতার অন্যতম দাবি। এই দাবির বিপরীতে দাঁড়িয়ে পুরো বিশ্বকে কী বার্তা দিচ্ছেন ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ?
রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের তান্ডবে পালিয়ে যাওয়া ও গণহত্যার শিকার হওয়া রাখাইনে শত শত গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়েছে। নিহত ও পালিয়ে যাওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাড়িঘর, জমিজিরাত দখলে নিচ্ছে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা মুসলমানদের মধ্যে ভয় ধরিয়ে দেয়ার কাজটি করতে সক্ষম হয়েছে। মিয়ানমারের বৌদ্ধদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৮ সালে ফেব্রæয়ারি থেকে শ্রীলঙ্কার সিংহলি বৌদ্ধদের সিরিজ হামলার শিকার হয় সেখানকার মুসলমানরা। প্রায় দুই দশক ধরে এলটিটিই গেরিলাদের সাথে গৃহযুদ্ধের শিকার হয়ে বিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কা প্রথম বৌদ্ধ-মুসলিম রায়টের সম্মুখীন হয় ২০১৪ সালে। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার দাঙ্গার পেছনে ফেইসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার এবং ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মুসলিম বিদ্বেষী ফেইক নিউজের নেতিবাচক ভূমিকা অনেকটাই স্পষ্ট। এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কা সরকার এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়স্ত্রণের চেষ্টায় সফল হয়। বৌদ্ধদের দাঙ্গায় শত শত মুসলমান পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এক বছরের মাথায় ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার সানডে উৎসবের সময় তিনটা চার্চ এবং তিনটি হোটেলে কথিত মুসলিম আত্মঘাতী হামলার প্রতিক্রিয়ায় শত শত মুসলমানের বাড়িঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদের পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। প্রায় সাড়ে ৫শ মুসলমান বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সে সব দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় শ্রীলঙ্কা সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী নতুন আইন এবং কঠোর পদক্ষেপ যথেষ্ট ফলদায়ক হয়েছে। তবে মুসলিম বিদ্বেষী প্রপাগান্ডায় বিক্ষুব্ধ খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদের চাপের মুখে শ্রীলঙ্কা সরকারের অন্তত চারজন মুসলমান মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। শ্রীলঙ্কায় মুসলিম বিদ্বেষী দাঙ্গার ৫ মাসের মাথায় ভারতে নাগরিকপঞ্জী সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জনতাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে দিল্লীতে মুসলিমবিরোধী রক্তাক্ত দাঙ্গা ছড়িয়ে দেয় বিজেপির সন্ত্রাসীরা। ভারতে ১৯৪৬-৪৭ সালের দাঙ্গা, গুজরাটের দাঙ্গার পর গত বছরের দাঙ্গায় দিল্লীর মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
চীনের ওহান থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর সারাবিশ্বের প্রায় সবকিছু থমকে দাঁড়ায়, সব যুদ্ধ, হিংসা-বিদ্বেষ ও জাতিগত সংঘাত থেমে গেলেও ভারতে মুসলিম বিদ্বেষী হিংসা একদিনের জন্যও থেমে যায়নি। করোনা মহামারীর মতো প্রাণঘাতী আতঙ্ককে মুসলিম বিদ্বেষী আতঙ্কে পরিণত করার জন্য করোনাজিহাদ ট্যাগ দিয়ে পরিকল্পিত প্রপাগান্ডা প্রোগ্রাম গ্রহণ করে হিন্দুত্ববাদীরা। ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে ভারত থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ার মিথ্যা অভিযোগ ও প্রচারণা শুরু করে তারা। তবে এবার তারা সর্বত্র ধরা পড়তে শুরু করেছে। ইসলামোফোবিয়া ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর দায়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতীয়দের চাকরিচ্যুতির বেশ কিছু ঘটনা ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। জায়নবাদীদের সাথে হিন্দুত্ববাদীদের গাঁটছড়া বাঁধার পর থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম বিদ্বেষী অপতৎপরতা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ক্রমে বেড়েই চলেছে। ফেইসবুক, হোয়াটস অ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ঢুকে পড়া হিন্দুত্ববাদী ও জায়নবাদীরা উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রেখে ঘোলা পানিতে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চল নির্বিশেষে বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ ফেইসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে জীবনের ঘনিষ্ঠ অনুসঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানও রয়েছেন। যে সব নীতিমালা ও নিরপেক্ষতার কারণে ফেইসবুক এত বিপুল সংখ্যক মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে, তাদের ভুল নীতি বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে বা ভুল ব্যক্তিকে ফেইসবুকের নীতি নির্ধারণে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে সেই আস্থা যেন নষ্ট হয়ে না যায়, ফেইসবুক কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সে দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।