পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নিষ্ঠুর, মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক শব্দগুলো সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এখন আর যেন কার্যকর নয়। বাংলাদেশে যেভাবে, যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, তাকে এখন আর স্বাভাবিক বলা যায় না। এ দুর্ঘটনাকে ‘হত্যাকান্ড’ হিসেবে সচেতন ও সুশীল নাগরিকরা অনেক আগেই চিিহ্নত করেছেন। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে। একের পর এক কেড়ে নিচ্ছে কর্মজীবী মানুষের প্রাণ। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ বেপরোয়া চালকদের নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। এছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশে দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরছে অসংখ্য মানুষের। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত লকডাউনের মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১২০৫টি। এতে নিহত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। আহত হয়েছে অসংখ্য। পরিতাপের বিষয়, যে যাত্রীদের জন্য গণপরিবহণের অস্তিত্ব, বেপরোয়া চালকদের কারণে সেই যাত্রীদেরই একের পর এক প্রাণ যাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যাদের ভুলের জন্য দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, সেই চালকদের অধিকাংশই কিভাবে যেন দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে যায়। এতে মনে হতে পারে, চালকরা যেন গাড়ি চালানোর দক্ষতা অর্জনের চেয়ে দুর্ঘটনায় পড়লে কিভাবে পালিয়ে যাওয়া যায়, এ প্রশিক্ষণই বেশি নিয়েছে। যাত্রী বা পথচারীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার এ প্রবণতাকে কি দুর্ঘটনা বলা যায়? বিশেষজ্ঞরা বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই এমন বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো হয় না। দেশে পরিবহণ মালিক আর শ্রমিক মিলে একটি ভয়ংকর চক্রের সৃষ্টি হয়েছে। এ চক্র কাউকেই মানে না। কারণ এ চক্রের ওপর প্রভাবশালীদের আশীর্বাদ রয়েছে। এ কারণে তারা কাউকে পাত্তা দেয় না। মানুষ খুন করে তারা উল্লাস করে।
দুই.
সড়ক দুর্ঘটনা এমনই যে, এতে কোন শ্রেণীভেদ থাকে না। ধনী-দরিদ্র, রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যক্তি এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও রেহাই পায় না। বলা যায়, বেপরোয়া ও দুর্বিনীত গাড়ি চালকরা এদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এদের কারণে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে এবং যেসব মানুষ মৃত্যুবরণ করে তার শতকরা ৭০ ভাগই কর্মক্ষম এবং দেশের অর্থনীতিতে তাদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে বলে এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। যারা আহত হয়ে অচল হয়ে পড়ে, তারা পরিবার ও সমাজের বোঝায় পরিণত হয়। বিশ্বব্যাংকের এক হিসেবে দেখানো হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপি’র এক শতাংশের বেশি। দুর্ঘটনায় কর্মক্ষম এসব মানুষের হতাহতের ঘটনায় তাদের পরিবারে কি দুর্বিষহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তা কেবল তারাই জানে। গত সপ্তাহে ময়মনসিংহের ফুলপুরে একটি মাইক্রোবাস উল্টে পুকুরে পড়ে এক পরিবারের কয়েকজনসহ ৬ জন নিহত হয়। দেখা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পরিবার নিমেষে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আবার সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করছে। এতে ঐ পরিবারের কী করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তা কেবল তারাই জানে। পরিবারের সদস্যদের কে ভারণপোষণ করবে, সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব কে নেবে? এমন শত শত পরিবার রয়েছে, যারা সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে এক অনিশ্চিত অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। চালক বেঁচে গিয়ে হয়ত তার পরিবার অনিশ্চয়তার হাত থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু তার কারণে যার বা যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের পরিবারগুলোর কি অবস্থা, তা কি কখনো ভেবে দেখে? তার হাতে যে রক্তের দাগ লেগে রইল, এ দাগ কি কখনো মুছতে পারবে? সে যে পরিবহণ প্রতিষ্ঠানের গাড়িটি চালিয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কি এ বিষয়টি কখনো ভেবেছে বা নিহতদের পরিবারের খোঁজ নিয়েছে? সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও কি কখনো তাদের খোঁজ-খবর নেয়? এমন সংবাদ আমরা কখনো পাই না। বরং আমরা এ সংবাদ দেখেছি, অতীতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করতে এবং চালককে ‘ঘাতক’ বলা যাবে না বলে তীব্র আপত্তি করতে। এর অর্থ হচ্ছে, গণপরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট চালক এবং মালিকদের এক ধরনের দায়মুক্তি দেয়া। তারা অদক্ষ ও অযোগ্য হলেও তাদের কারণে দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে তারা যেভাবে খুশি সেভাবে গাড়ি চালাবে, এতে দুর্ঘটনা ঘটলে তাদের টিকিটিও ধরা যাবে না। দায়মুক্তির এই প্রবণতা থেকে যতদিন না বের হয়ে আসা যাবে, ততদিন মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক যে শব্দেই দুর্ঘটনাকে আখ্যায়িত করা হোক না কেন, দুর্ঘটনা যে ঘটবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গড়ে প্রতি বছর মৃত্যুবরণ করে প্রায় ৪ হাজার। বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি। এসব দুর্ঘটনার বেশিরভাগই ঘটেছে চালকের ভুল এবং বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। এটাই হওয়া স্বাভাবিক। যে দেশে শতকরা ৯০ ভাগ চালক ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালায়, সেখানে দুর্ঘটনার হার ও মানুষের হতাহতের ঘটনা এবং পরিবার-পরিজনের হাহাকার ও আর্তনাদ কমার কোন কারণ নেই। বিশ্বের কোন সভ্য দেশে মানুষ মারার এমন অস্বাভাবিক গণপরিবহণ ব্যবস্থা আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। উন্নত বিশ্বে নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ির গতিসীমা সামান্য অতিক্রম এবং লেন পরিবর্তন করলেই সংশ্লিষ্ট গাড়ি চালকের অরিজিনাল লাইসেন্স স্থগিত, এমনকি বাতিল করে দেয়া হয়। সেই চালককে পুনরায় পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স ফেরত পেতে হয়। আমাদের দেশে এসব নিয়ম-কানুন দূরে থাক, যে সংস্থা ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয় তার বিরুদ্ধেই জাল লাইসেন্স প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। তার উপর রয়েছে গাড়ি চালক, শ্রমিক সংগঠন এবং পরিবহন মালিকদের বেপরোয়া মনোভাব। জাল লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি ধরলে বা অভিযান চালালে তারা হয় পরিবহণ ধর্মঘটের ডাক দেয়, না হয় কৌশলে গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তিতে ফেলে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে। সড়ক যোগাযোগ উন্নত হচ্ছে, একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু গণপরিবহণে যেসব অনিয়ম চলছে এবং বেড়ে চলেছে, এ ক্ষেত্রে কার্যকর কোন ব্যবস্থা কেন নেয়া হচ্ছে না? এ খাতটিকে কেন নিরাপদ ও শৃঙ্খল করা যাচ্ছে না? এ খাত এবং এর সাথে জড়িতদের যদি সংস্কার ও সুশৃঙ্খল করা না যায়, তবে রাস্তা-ঘাট যতই উন্নত করা হোক এবং যতই ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হোক না কেন, তাতে কোন লাভ হবে না। বেপরোয়া চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি মসৃন রাস্তা ও ফ্লাইওভারেও দুর্ঘটনা ঘটাবে।
তিন.
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বহু কথা হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় এ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অনেক লেখালেখি করেছেন। এখনও করছেন। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এসবে যে কোন কাজ হচ্ছে না, তা সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির হারই প্রমাণ করছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের কোন বিচলন আছে বলেও মনে হচ্ছে না। বরং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের পক্ষাবলম্বন করতে দেখা গিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, ‘সংশ্লিষ্টরা ঘাতক চালকদের পক্ষাবলম্বন করেন। নিহতদের পক্ষে তাদের কথা বলতে দেখা যায় না।’ এটাই বাস্তবতা। যে চালক ও যে পরিবহন সংস্থার ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, তারা যদি নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে এমন প্রশ্রয় পায়, তবে তাদের বেপরোয়া মনোভাব রোখার কারও সাধ্য নেই। এর ফলে বেপরোয়া চালকরা নিজেদের ‘রাস্তার রাজা’ ভাববে, যাত্রীরা তাদের কাছে জিম্মি হবে, সড়ক-মহাসড়ক মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রতিকারের পরিবর্তে যদি প্রশ্রয় দেয়া হয়, তবে কেন তারা নিয়ম-কানুন মানবে? এ ধরনের প্রবণতা মানুষ হত্যা এবং জনসাধারণের স্বাভাবিক চলাচলে মানবাধিকার খর্ব করা ছাড়া কিছুই নয়। দিনের পর দিন সড়ক দুর্ঘটনায় যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, এ ক্ষতিকে ¯্রফে দুর্ঘটনা বা দুর্ঘটনায় মানুষের কোন হাত নেই বলে এড়িয়ে যাওয়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে মাঝে মাঝে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কয়েক বছর আগে সোনারগাঁও হোটেল সংলগ্ন ভিআইপি সড়কে পথচারী যাতে যত্রতত্রভাবে রাস্তা পারাপার হতে না পারে, এজন্য মোবাইল কোর্ট বসানো হয়। কয়েক শ’ পথচারীকে জরিমানাও করা হয়েছিল। এ ধরনের উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য হলেও তা স্থায়ী হয়নি। কিছুদিন পর আবার যেই-সেই অবস্থা। প্রশ্ন হচ্ছে, স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন? এভাবে আর কতদিন? দেশের কর্মক্ষম ও ব্রিলিয়ান্ট ব্যক্তিদের বাঁচাতে এর স্থায়ী সমাধান কি সরকার অনুভব করছে না? তাদের জীবন কি গণপরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা ও কিছু বেপরোয়া গাড়ি চালকের হাতেই জিম্মি থেকে যাবে? আমরা দেখেছি, যখনই কোন বিশিষ্টজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন, তখন সরকার সংশ্লিষ্টরা দুঃখ ও শোক প্রকাশ করেন। নিশ্চয়ই তারা শোক প্রকাশ করবেন, অশ্রুসজল হবেন। পাশাপাশি আমরা তো আশা করি, পরিবহন খাতে যে মারাত্মক ত্রুটি-বিচ্যুতি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে, সেগুলোর ব্যাপারেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কথা তারা বলবেন। দুঃখের বিষয়, আমরা এ ধরনের কথাবার্তা নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে শুনি না। সরকারকে অনেক ক্ষেত্রে কঠোর মনোভাব পোষন এবং দমন করার ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখা যায়। সড়ক ও পরিবহন খাতে যে অনিয়ম দানা বেঁধে রয়েছে, এ ক্ষেত্রে যদি এমন মনোভাব পোষন করত, তবে সড়ক দুর্ঘটনা হত্যাকান্ড হিসেবে অভিহিত না হয়ে স্রফে দুর্ঘটনা হিসেবেই চিিহ্নত হতো। সাধারণ মানুষও দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়ে সান্ত¦না পেত।
চার.
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বহু উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা শোনা যায়। এসব উদ্যোগ কি কেবল পরিকল্পনা বা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বাস্তবায়িত হবে তা কেউ বলতে পারে না। কিছুদিন যেতে না যেতেই এসব উদ্যোগ ও পরিকল্পনা ঝিমিয়ে পড়ে। আরেকটি ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটা না পর্যন্ত যেন অপেক্ষমান থাকে। অথচ উদ্যোগ নেয়া হবে-হচ্ছের মাঝেই প্রায় প্রতিদিন একের পর এক প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। এ ধরনের শৈথিল্য ও ঢিলেমি কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশে পরিবহন খাত এবং সড়ক ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলায় আইনের শাসন নাজুক অবস্থায়ই রয়েছে। পরিবহন খাতে যেসব সংগঠন ও প্রভাবশালী ব্যক্তি যুক্ত সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেই। রাস্তায় গাড়ি চললে দুর্ঘটনা ঘটবে, তাদের মধ্যে যেন এমন মনোভাব কাজ করছে। বলা যায়, তাদের কাছে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে আছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসন আজ পর্যন্ত এ খাতটিকে সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ করতে পারেনি। এটা কি ভাবা যায়, একটি সভ্য দেশে পরিবহন খাতে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থাপনাসহ যত ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা রয়েছে, তা বছরের পর বছর চলছে, অথচ কোনো প্রতিকার নেই! সড়ক-মহাসড়কে আর কত প্রাণ ঝরলে পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টদের হুঁশ হবে? আর কবে এ খাতটিকে আধুনিক ও সুশৃঙ্খল করে গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রায়ই দেখা যায় ভ্রাম্যমান আদালত নিয়ে রাস্তায় নেমে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও অনিয়ম পরীক্ষা করতে। এই কার্যক্রমকে সাধারণ মানুষের কাছে লোক দেখানো ছাড়া কিছু মনে হয় না। মূল জায়গায় হাত না দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে দুয়েকটি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গাড়ি ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ঠিক আছে কিনা, এ পরীক্ষা করে যে কোনো লাভ হচ্ছে না, তা তো প্রতিদিনের দুর্ঘটনা বৃদ্ধি থেকেই বোঝা যায়। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও মালিকদের আগে সংযত ও সংশোধন করা প্রয়োজন। এ কাজ না করে কেবল রাস্তায় দুয়েকটি গাড়ি থামিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে এ সমস্যার সমাধান কোনো দিনই হবে না। পরিবহন সংক্রান্ত যেসব আইন রয়েছে, সেগুলো কেবল খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখানো অপরিহার্য। দক্ষ চালক গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম জোরদার, কাউন্সিলিং, মোটিভেশন এবং গণপরিবহন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের চালকদের অরিজিনাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে যে প্রতিষ্ঠানের গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটাবে, সে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। গণপরিবহণখাতে যাত্রীবীমার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা এবং এ অনুযায়ী উদ্যোগী হতে হবে। জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করেছে। প্রতিটি সদস্য দেশকে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করার কথা বলা হয়েছে। এ পরিকল্পনা করে সদস্য দেশগুলোর প্রায় ৫০ শতাংশ দেশ পর্যায়ক্রমে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুহার কমিয়ে এনেছে। অথচ এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পেছনে রয়েছে, উল্টোপথে হাঁটছে। দুর্ঘটনা ও মৃত্যুহার কমানোর পরিবর্তে তা বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘ যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে, সেখান থেকে কারিগরি সহযোগিতা পাওয়া যাবে। সরকারের উচিত হবে এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর উদ্যোগ নেয়া।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।