পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
উন্নতমানের প্রতিশব্দ থাকা স্বত্তে¡ও মিডিয়াতে কিছু শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে যা শুনতে না শ্রæতি মধুর, না উন্নতমানের। যেমন পুত্রের স্থলে ‘ছেলে’ লেখা বা বলা হচ্ছে। পিতার স্থলে ‘বাবা’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। কেউ মৃত্যুবরণ করলে ‘ইন্তেকাল’ বা ‘শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ’ বা ‘মৃত্যুবরণ’ করেছেন এর পরিবর্তে প্রয়োগ হচ্ছে ‘মারা’ গেছেন। ‘মারা’ যাওয়ার পরিবর্তে ‘ইন্তেকাল’ বা ‘শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ’ বা ‘মৃত্যুবরণ’ শব্দগুলি নিশ্চয় ‘মরা’ শব্দের চেয়ে উন্নতমানের, সুশোভন ও শ্রুতি মধুর। ‘মারা যাওয়া’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘মৃত্যুবরণ’ বা ‘শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ’ শব্দগুলি ব্যবহার বেশী অর্থপূর্ণ ও শ্রুতি মধুর। শাব্দিক ব্যবহার সম্পর্কেও কোন কোন সময় মিডিয়াকে উদাসীন মনে হয়। যেমন একটি বহুল প্রচারিত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্ক্রলের ফুট নোটে লেখা দেখলাম ‘মেজর সিনহার ‘মারা’ যাওয়ার ঘটনায় তিনজন গ্রেফতার’। মিডিয়ার শাব্দিক প্রয়োগ অর্থপূর্ণ হতে হবে। কেহ যদি খুন হয় সেখানে ‘নিহত’ শব্দটি প্রয়োগ করতে হবে, ‘মরা’ শব্দটি সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং এপ্রোপ্রিয়েট শব্দ প্রয়োগে উদাসীনতার পরিচায়ক। মিডিয়া এক অর্থে গোটা পৃথিবীতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রভাবান্বিত করার এখতিয়ার অর্জন করেছে। সে ক্ষেত্রে শব্দ প্রয়োগে মিডিয়া যদি উদাসীন হয়, তবে ভাষা সম্মৃদ্ধশালী হতে বাধাগ্রস্থ হবে। এ ধরনের আরো অনেক উপমা দেয়া যাবে যেখানে উন্নতমানের এপ্রোপ্রিয়েট প্রতিশব্দ থাকা স্বত্তে¡ও নিম্নমানের শব্দ মিডিয়াতে অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে।
শব্দ শ্রুতিমধুর হওয়ার তাৎপর্য অনেক। যে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম শ্রæতিমধুর নহে, সেগুলি পরিবর্তনের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নেত্রকোনা জেলাধীন পূর্বধলা উপজেলার একটি স্কুলের নাম ‘চোরের ভিটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়’। নীলফামারী সদর উপজেলার ‘মানুষমরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘মানুষগড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নাম করণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন পরে হলেও সরকার শ্রæতি মধুর নাম রাখার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা একটি যথাপোযুক্ত সিদ্ধান্ত বটে। উল্লেখ্য ‘মানুষমরা’ নামের চেয়ে ‘মানুষগড়া’ শব্দটি অনেক শ্রæতি মধুর, তাৎপর্যপূর্ণ এবং অর্থ বোধক। অন্যদিকে ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ‘মরা’ জাতীয় শব্দ শুশোভন নয় জেনেও মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করছে। এটা কি সঠিক ভাষা প্রয়োগে অলসতা, নাকি ভাষা জ্ঞানের ঘাটতি? উল্লেখ্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) এক সার্কুলারে যে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম শ্রæতিমধুর নহে তা আগামী ৩০/৮/২০২০ ইং তারিখের মধ্যে পরিবর্তনের জন্য নির্দেশনা জারী করেছেন। এ ধরনের প্রস্তাব ইতোপূর্বেই বাংলা একাডেমী থোক দেয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেখানে সরকারকে খুশী রাখার জন্য ব্যতিব্যস্ত সেখানে এ ধরনের সংস্কারমূলক কাজে তাদের সময় কোথায়?
বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। এ মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে রক্ত ঝরাতে হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও প্রয়োগগতভাবে এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা এখনো রাষ্ট্রভাষা হিসাবে পরিপূর্ণতা লাভ করে নাই। অথচ বাঙ্গালীর ভাষা আন্দোলনের প্রতি বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে, ২১শে ফেব্রæয়ারী ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’ হিসাবে পালিত হচ্ছে।
আসামে ভাষার স্বীকৃতির দাবীতে আন্দোলন হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও নিজ মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছে, কিন্তু বাঙ্গালীর ভাষা আন্দোলনই আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে এটাই বলা বাহুল্য যে, বাংলা এখন অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষা। এ কারণেই ভাষাটির মর্যাদা বৃদ্ধি, সুশোভন করে প্রসারিত করা প্রতিটি বাঙ্গালীর দায়িত্ব ও কর্তব্য, মিডিয়ার দায়িত্ব আরও বেশী।
ভাষার উন্নয়ন ও প্রয়োগ যথাযথ হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানটির তার নাম বাংলা একাডেমী। ১৯৫২’র মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪’র জাতীয় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর ফ্রন্টের ২১ দফার ষষ্ঠদশ দফার বাস্তবায়ন হিসাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা-বিকাশের লক্ষে ১৯৫৫’র ৩রা ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমীর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় বর্ধমান হাউসে পূর্বপাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবন ছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অসমাপ্ত বিচারকার্য এ বর্ধমান হাউসেই হয়েছিল, জনতার রোষানলে বিচারক আব্দুর রহমান তখন পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। ঐতিহাসিক দিক থেকেও ভবনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দলমত নির্বিশেষে জাতীয় মতামতকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বা সকল পথ ও মতের মানুষ যেন একটি জায়গায় বসতে পারে এ ধরনের একটি ‘প্ল্যাটফর্ম’ জাতীয়ভাবে থাকা দরকার, যা অন্যান্য রাষ্ট্রেও রয়েছে। বাংলা একাডেমী সর্বজন গ্রহণযোগ্য ধরনের একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারতো, যা বাংলাদেশের সকল পথ ও মতের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্দিজীবিদের গ্রহণযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা যেতো। কিন্তু দিনে দিনে বাংলা একাডেমী একটি দলীয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। একাডেমী পরিচালনার জন্য একাডেমী সদস্যদের নির্বাচিত কোন কমিটি নাই, সরকারী ঘরনার একজন বুদ্ধিজীবী একাডেমীর সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন আমৃত্যু। কমিটির অন্যান্য সদস্যরাও সরকারী ঘরানা থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত। ফলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের এখানে প্রবেশের তেমন কোন সুযোগ থাকে না। একাডেমী অনেক বই প্রকাশ করেছে, কিন্তু অনেক ভিন্ন মতাবলম্বীর বই প্রকাশে শৈথিল্য প্রকাশ করে। লেখক হিসাবে পুরুষ্কার বা স্বীকৃতি প্রদান বা ফেলোশীপ প্রদানের ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র সরকারী ঘরানার লেখকদের প্রাধান্য দেয়া হয়। ভিন্ন মতালম্বীরা উন্নতমানের বই লিখলে বা গবেষণা করলেও সহজে স্বীকৃতি পাওয়া যায় না, সহযোগিতা করা তো অনেক দূরের কথা।
একটি দেশকে ধ্বংস করার জন্য সে দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে পারলেই জাতিটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। তখন যুদ্ধ করে পতন ঘটানোর প্রয়োজন হয় না। ফলে একটি জাতিসত্তাকে পরিপূর্ণ করার জন্য জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রটেকশন দিতে হবে। নতুবা অপসংস্কৃতি বা পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রবেশ করে জাতীয় সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করবে, যা ইতোমধ্যে অনেকটুকু দখল করে ফেলছে। বাংলার ঐতিহ্যকে লালন পালনের চেয়ে ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতির প্রতি সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা ঝুঁকে পড়েছে। বাংলা নববর্ষকে যথাযথ মর্যাদা উদযাপনের চেয়ে টাকা ওয়ালা লোকেরা ও তাদের উঠতি বয়সের সন্তানেরা থার্টিফার্স্ট নাইট বেশী ঘটা করে পালন করে। পশ্চিমা সংস্কৃতি যাতে জাতিগতভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি অঙ্গণের অংশ হতে না পারে এজন্য বাংলা একাডেমীর যতটুকু গুরু দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল, ততটুকু তারা করতে পারছে না। তারা শুধু তাদের পছন্দনীয় সরকারী ঘরানার লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে।
গ্রাম-গঞ্জের এখনো অনেক বাউল, মুর্শীদি, নানা ধরনের উৎসব পালন করা হচ্ছে, কোথাও পৃষ্ঠপোষকতা তথা অভাবের কারণে হারিয়ে গেছে। সেগুলি জাতীয়ভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হচ্ছে কি না বা করলে কতটুকু সংগ্রহ করা হচ্ছে, তাও জাতি জানতে পারে না, কারণ বাংলা একাডেমী তাদের হাত দেশব্যাপী বিস্তৃত করতে পারে নাই।
স্বাধীনতার পর দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার জন্য সরকারীভাবে একটি উদ্যেগের কথা বলা হলেও পরবর্তীতে ক্ষমতাহীন সকল সরকারের ম্যানুফেস্টুতে ‘দেশ নিরক্ষরমুক্ত’ করার ঘোষণা থাকলেও তা আর বাস্তবায়িত হয় নাই। সরকারের ‘গণশিক্ষা’ কার্যক্রম নামে একটি দপ্তর থাকলেও এর কোন ভ‚মিকা জনগণ দেখতে পায় না। একটি রাষ্ট্র তথা জাতিকে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে মাথা উঁচু করে টিকে থাকার জন্যই সকল স্তরে মানসিক প্রস্তুতি এবং এ অনুযায়ী অগ্রগামী হওয়া দরকার।
গোটা বিশ্বে অনেক রাষ্ট্র যেখানে চাঁদে তাদের জাতীয় পতাকা রেখেছে, অন্যান্য গ্রহে যাওয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেখানে আমরা বালিশ ক্রয়ের খরচ বাড়িয়ে কিভাবে টাকা আত্নসাৎ করা যায়, কিভাবে ত্রাণের চাল কালোবাজারে বিক্রি করা যায়, কিভাবে জাল টাকা বানানো যায়, কিভাবে চাদাবাজী করা যায়, করোনার নেগেটিভ ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে অজস্র অর্থ উপার্জন করা যায়, কিভাবে সমাজবিরোধী কর্মে লিপ্ত যা করা হচ্ছে, সেদিকে যেন ব্যস্ত বেশি। এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। যেহেতু আমাদের জাতিসত্ত¡াবোধের অভাব রয়েছে, তাই এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে চলেছে। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়, অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুষম বন্টনের নীতিমালা বর্হিভ‚ত ও পরিপন্থী কর্মকান্ড অবাধে হচ্ছে, যা বন্ধ করার জন্য দেেেপ্রমে উদবুদ্ধ হওয়া অপরিহার্য।
লেখক: জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি, সদস্য, এশিয়াটিক সোসাইটি, সাবেক সিনেটর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।