পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বিশ্বশান্তির বিপক্ষ শক্তি চক্রের মণিকাঞ্চন যোগ। বেলফোর ডিক্লারেশনের শত বছরে এসে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিগত সংঘাতের আগুন জ্বালিয়ে এরা পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে রি-শাপল করতে চাইছে। পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জয়পরাজয়ের নির্নায়ক শক্তি হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে টেক্কা দিয়ে নতুন বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল, সত্তুর বছর পেরিয়ে এসে সা¤্রাজ্যবাদের পুরনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় আর কাজ হচ্ছে না। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙ্গণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউনিপোলার শক্তি হিসেবে আর্বিভুত হওয়া এবং চীনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পদার্পণ করার মধ্য দিয়ে মার্কিন অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জিং শক্তি হয়ে ওঠে চীন। চীনের সাথে রাশিয়ার কৌশলগত মৈত্রী, ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের উদীয়মান আঞ্চলিক পরাশক্তি হয়ে ওঠা এবং চীন-রাশিয়ার সাথে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের আধিপত্যবাদী অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এহেন বাস্তবতায় ফিলিস্তিনীদের স্বশাসন ও আল-আকসা মুক্তির আন্দোলনে নতুন মাত্রা লাভ করেছে এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়ায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এখন সময়ের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করে ইরাকের উপর দখলদারিত্ব কায়েম করার পর দেড় দশকেও সেখানে আমেরিকানরা রাজনৈতিক বা সামরিক বিজয় অর্জন করতে পারেনি। তালেবান শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতে আফগানিস্তানে নির্লজ্জভাবে সামরিক দখলদারিত্ব কায়েম কায়েম করার পর এখন মার্কিনীদের সেখান থেকে পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে হচ্ছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের আগুন লাগিয়ে তা বশে আনতে পারেনি। পশ্চিমা প্রক্সি ওয়ারের পর এসব দেশে এখন ইরানের রাজনৈতিক ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতা ও শান্তি প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক অবস্থান সক্রিয় থাকলে এসব দেশের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে পারে। আর এই শান্তি, স্থিতিশীলতা ঐক্য ও সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকেই ইসরাইলের জন্য বড় বিপদ বলে মনে করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন।
চীনের বৈশ্বিক কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মহাপারিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এগিয়ে চলেছে। চীন, ইরান, রাশিয়ার ঐক্যে ফাঁটল ধরানো যাচ্ছে না, অগ্রযাত্রা নস্যাৎ করা যাচ্ছে না, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, আলআকসার মুক্তি ক্রমে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। এহেন বাস্তবতায় দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য কায়েম রাখতে এবং চীনের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা রুখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত বাণিজ্যযুদ্ধও যখন ব্যর্থ হয়ে গেল, তখন মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া এবং টু-স্টেট সলিউশনের ভিত্তিতে ইসরাইলের পাশে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সম্ভাবনাকে ভেঙ্গে দিতে তথাকথিত ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি ঘোষণা দিয়ে জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনের অধিকাংশ অধিকৃত এলাকায় নতুন করে দখলদারিত্ব কায়েমের সিদ্ধান্ত নেয় ইউএস-জায়নিস্ট চক্র। সেই ১৯১৬ সালে সাইক্স-পাইকট চুক্তির ভিত্তিতে ১৯১৭ সালের বালফোর ঘোষণার পর দুইটি মহাযুদ্ধের ফলাফল যে নতুন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা কায়েমের সুযোগ এনে দিয়েছিল পরবর্তী একশ বছর ধরে তা বহাল রয়েছে। এখন চীন-রাশিয়া-ইরানের উত্থান এবং ঐক্যের মধ্য দিয়ে সে ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি হেজিমনিক প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে, যাকে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি বলে অভিহিত করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হতে না পারলেও ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই ডিল থেকে সরে গিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের আকাক্সক্ষা অনুসারে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেবেন, এমন প্রত্যাশা করা বাতুলতা মাত্র। কারণ মার্কিন ডিপ স্টেট ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স কোনো প্রেসিডেন্টের একক সিদ্ধান্তে চলে না। মূলত জায়নিস্ট লবি, ব্যাংকার ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোই মার্কিন অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতিগতভাবে বারাক ওবামার সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ রাষ্ট্র শক্তিশালী ইসরাইলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বছরে শত শত কোটি ডলারের আর্থিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় তেমন কোনো ফেরফের ঘটে না।
মার্কিন-জায়নিস্ট চক্রের পরিকল্পনা অনুসারে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির বাস্তবায়ন শুরুর মধ্য দিয়ে ২০২০ সালকে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে বাগদাদ বিমানবন্দরে ইরানি সেনা কমান্ডার কাসেম সুলাইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যার মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের রক্তাক্ত সূচনা করেছিল ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই ইরানকে আঘাত করে কাবু করতে হবে। এই ধারণা থেকেই বছরের প্রথম দিন তারা ইরানি সেনা কমান্ডারকে হত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। তবে ইরানের পক্ষ থেকে মার্কিন সেনাঘাটিতে পাল্টা আঘাত ছিল অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এমন প্রত্যাঘাতের জন্য তারা সম্ভবত প্রস্তুত ছিল না। চীনের ওহান থেকে ফেব্রæয়ারীতে ইউরোপে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারী অনেক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যাহত করলেও ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলের আগ্রাসন এবং দখলদারিত্বের তৎপরতা একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। এই সময়ে ভারতে কাশ্মিরী মুসলমানদের উপর হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনও জোরদার করা হয়েছে। ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা তথাকথিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ তাৎক্ষনিকভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বনেতাদের অনেক কিছু থেকে বিরত রাখলেও বছর শেষ হওয়ার আগে তারা ২০২০ সালের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রত্যাশিত অর্জন নিশ্চিত করতে চায় ইসরাইল ও ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আগস্ট মাস এলে বিশ্ববাসীর সামনে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমার নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞের মর্মন্তুদ স্মৃতি ফিরে আসে। এই আগস্ট মাসের চার তারিখে ইসরাইলী আগ্রাসনের অন্যতম টার্গেট-শত্রæরাষ্ট্র লেবাননের রাজধানী ও বন্দরনগরী বৈরুত হিরোশিমার পারমানবিক ধ্বংসযজ্ঞের মত বিস্ফোরণের শিকার হয়। আপাতত দৃষ্টিতে একে একটি রাসায়নিক গুদামের বিষ্ফোরণ হিসেবে দেখা হলেও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও বিচার-বিশ্লেষণে এমন সরলাঙ্কিক হিসাবের সুযোগ নেই। বৈরুত বিস্ফোরণের সাথে ইসরাইলী হুমকি ও নাশকতা পরিকল্পনার সংশ্লিষ্টতা এখন আর উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। এক ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, দু’বছর আগে, ২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে বৈরুতের একটি ম্যাপ দেখিয়ে হেজবুল্লাহর ঘাঁটি ও অস্ত্রাগারের স্থানগুলো চিহ্নিত করছেন। তিনি বলেন, তাঁর দেশের নিরাপত্তার জন্য তিনি যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেন। আইসিএইচ ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ২০০৭ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন জেনারেল এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী ওয়েসলি ক্লার্ক নানা ক্লাসিফাইড তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলছেন, মার্কিন প্রশাসন আগামী ৫ বছরে মধ্যপ্রাচ্যের ৭টি দেশকে দখল করতে চায়। এর মধ্যে আছে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়্,া সোমালিয়া, সুদান এবং সবশেষে ইরান। গ্রেটার ইসরাইল গঠনের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই দখলদার যুদ্ধবাজির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে সিএনএন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ইউএস স্টেপিং আপ লেবানন ইভ্যাকুয়েশন। ইরাক-আফগানিস্তানের সাথে সাথে লেবাননে দখলদারিত্বের টার্গেট ছিল আমেরিকার। হেজবুল্লাহর প্রতিরোধের মুখে তা ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘের ভাষণে বৈরুতে হেজবুল্লাহর ঘাঁটি, অস্ত্রাগারে হামলার পক্ষে সাফাই গেয়ে যে বক্তৃতা নেতানিয়াহু দিয়েছিল, গত ৪ঠা আগস্টের বৈরুত বিস্ফোরণ তারই বাস্তবায়ন কিনা সে প্রশ্নটিই এখন ঘুরে ফিরে উঠে আসছে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী লেবানন হেজবুল্লাহকে টার্গেট করে যেসব হুমকি দিয়েছেন, তার প্রেক্ষাপট এবং বৈরুত বিস্ফোরণের তিনদিন আগে ৩১ জুলাই ইসরাইলি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলের কোয়ালিশন সরকারের নেতা ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্জ আইডিএফকে লেবাননে হামলার নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই রিপোর্টে বলা হয়, হেজবুল্লাহ যদি আর কোনো আক্রমণের চেষ্টা করে তবে তারা এবং লেবানন একটি (আনউজুয়াল রেসপন্স) অস্বাভাবিক আঘাতের সম্মুখীন হবে। ৪ঠ আগস্ট বৈরুতের মানুষ সেই অস্বাভাবিক আক্রমণের শিকার হয়েছিল।
বৈরুতে অস্বাভাবিক বিস্ফোরণটি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু অস্ত্রের বিস্ফোরনের মতই ধ্বংসাত্মক ছিল। এই বিস্ফোরণে একই সাথে লেবাননের সমরাস্ত্রের জন্য হাজার হাজার টন বিস্ফোরক কাঁচামাল, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা, দেশের বৃহত্তম খাদ্যগুদামে রক্ষিত সব খাদ্যশস্য ধ্বংস করা হয়েছে। ফরাসি সাংবাদিক-রাজনৈতিক তাত্তি¡ক থিয়েরি মেইসান মধ্যপ্রাচ্যের চলমান অবস্থাকে হাইব্রিড ওয়ার বলে অভিহিত করে বৈরুত বিস্ফোরণকে ইসরাইলের নতুন বোমা বলে দাবি করেছেন। গত ৯ আগস্ট ভল্টেয়ারনেট.ওআরজি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নতুন অস্ত্রের মাধ্যমে ইসরাইল পূর্ব বৈরুতকে ধ্বংস করেছে বলে উল্লেখ করেছেন। এর আগে সিরিয়ার মরুভূমি ও মালভূমিতে সাত মাস ধরে এই অস্ত্রের পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়েছিল বলে রিপোর্টে বলা হয়। বলা হচ্ছে, গুদামটিকে ২ হাজার ৭০০টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মজুদ ছিল। এটি মূলত সার এবং বিস্ফোরকের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই বিস্ফোরকে এমন ধ্বংসযজ্ঞ হতে পারে না। বিস্ফোরণ এলাকার প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাজার হাজার ভবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দৃশ্যকে শুধুমাত্র হিরোশিমা-নাগাসাকি বোমার সাথে তুলনা করা যায়। এর ধ্বংস ক্ষমতা এবং মাশরুমের মত কুন্ডলি পাকানো ধোঁয়ার উদগীরণ পারমানবিক বোমার মতই। পনের বছর আগে যে স্থানে লেবানিজ প্রধানমনস্ত্রী রাফিক হারিরিকে হত্যার জন্য একটি পিকআপ ভ্যান থেকে মিসাইল ছোঁড়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে ইসরাইলি বোমা হামলার ঘটনাকে আড়াল করা চেষ্টা করা হয়েছিল। বৈরুত বিস্ফোরণে সেই একই পন্থা অবলম্বন করা হয়। রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে নতুন প্রিসিশন গাইডেড বোমার বিষয়টিকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে থিয়েরি মেইসান তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন।
ফিলিস্তিনি মুসলমানদের নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই রাষ্ট্রটিকে আরবদের আক্রোশ থেকে রক্ষা করার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করেছে ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীরা। তবে আরবদের তেলসম্পদের উপর নির্ভরতা এবং মুসলমান ও বিশ্বসম্প্রদায়ের আবেগের কথা ভেবে তারা জেরুসালেমের বিশেষ মর্যাদা ও নিরপেক্ষতা মেনে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমের অধিকার মেনে নেয়নি। ইসরাইলের সত্তুর বছরে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করার প্রস্তাবে সই করেননি। ইসরাইল রাষ্ট্রের ৭০ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৮ সালের ১৪ মে জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে মুসলমান ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার আরেক দৃষ্টান্ত তৈরী হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম এই অপকর্মে এগিয়ে গেলেন। আরব-ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক ভূ-রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো হঠাৎ করেই গ্রহণ করা হয়নি। এসব সিদ্ধান্ত জায়নবাদীদের শত বছরের হেজিমনিক পরিকল্পনার অংশ। প্রায় ছয়শ বছর ধরে ইউরোপ ও এশিয়া শাসন করা অটোমান সা¤্রাজ্য ভেঙ্গে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা বশংবদ রাজপরিবারের সৃষ্টির সাথে এই হেজিমনিক পরিকল্পনার যোগসাজশ রয়েছে। শুরু থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারগুলো জাতিবিদ্বেষী ভূমিকার ইতিহাস রয়েছে। শুধুমাত্র ধর্মপ্রাণ জনগণের আবেগ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি বাহ্যিক সম্মান প্রদর্শনের জন্য তারা ইসরাইলের সাথে প্রকাশ্য সর্ম্পক গড়ে তোলতে পারেনি। এখন শত বছর পেরিয়ে এসে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আরবদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে যখন নতুন চেতনা জেগে উঠেছে, তখন মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ ও জায়নবাদী শক্তির সাথে মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারগুলোর সেই পুরনো গোপণ সন্ধিগুলো এখন নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে শুরু করেছে। ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির রোডম্যাপ প্রণয়নের আগেই সম্ভবত প্রভাবশালী আরব রাজাদের সাথে গোপন সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে ইরানের পক্ষ থেকে কথিত হুমকির জুজু কাজে লাগাচ্ছে জায়নবাদীরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কথিত চুক্তির ঘোষণার মধ্য দিয়ে তারই প্রতিফলন দেখা গেল। তবে ক্ষমতালোভী আরব শাসকরা জায়নিস্ট মার্কিনীদের ক্রীড়ণকে পরিণত হলেও দরিদ্র ফিলিস্তিনী জনগণকে তারা কখনোই বশীভূত করতে পারেনি। যতই দিন যাচ্ছে, যতই রক্ত ঝরছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রাম যেন ততই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। হামাস ও হেজবুল্লাহর প্রতিরোধ যুদ্ধ এখন জায়নবাদি ইসরাইল ও তার পৃষ্ঠপোষকদের জন্য তীব্র মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে আসার আগেই গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ শুরুতেই সর্ব মহলে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর এ নিয়ে মার্কিনীদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় কিছুটা ভাটা পড়েছিল। দীর্ঘ প্রায় ৭ মাস করোনাভাইরাস মহামারীর লড়াইয়ে অন্য সব বিষয়াবলী গৌণ হয়ে পড়েছিল। আগস্টের ৪ তারিখ লেবাননের রাজধানী ও বৈরুত বন্দরে শান্তিকালীন নজিরবিহীন ভয়াবহ বিস্ফোরণে পূর্ব বৈরুত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তিতে সই করেছে। বৈরুতে নতুন বোমা বিস্ফোরণের ধ্বংসযজ্ঞকে অন্য আরব দেশগুলোকে ভয় দেখানোর কাজে ব্যবহার করছে ইসরাইল? ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির মূল লক্ষ্য হচ্ছে তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোকে বশে এনে এতদিনের আরব-ইসরাইল সংঘাতকে আরব-ইরান সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া। ইসরাইলের সমরশক্তি এবং ধ্বংস ক্ষমতা দেখিয়ে তাদের মধ্যে ভয় ধরিয়ে দেয়ার কাজটি করতেই বৈরুত বøাস্টের পরিকল্পনা করা হয়ে থাকতে পারে। পূর্ব বৈরুতের বিস্ফোরণে যে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে, একই ধরনের বিস্ফোরণ যদি ও দুবাইয়ের কেন্দ্রস্থলে ঘটত তার ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হত। দুবাই বা যে কোনো আরব রাষ্ট্রে প্রিসিশন গাইডেড মিসাইল দিয়ে এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানো ইসরাইলের জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। এই ভয় এবং ইরানের পক্ষ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কার কথা প্রচারের মাধ্যমে আরবদের ইসরাইলের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে বাধ্য করছে মার্কিন প্রশাসন ও পেন্টাগন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর ওমান, কুয়েত, সউদী আরব একই পথ অনুসরণ করতে চলেছে বলে জানা গেছে।
পরনির্ভর, পশ্চিমা বশংবদ আরব রাজাদের ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক গড়ার এই প্রক্রিয়া ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম এবং মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী চীন-রাশিয়া-ইরান ঐক্য ও ভূ-রাজনৈতিক সমঝোতার পথকে আরো ত্বরান্বিত ও ঘনিষ্ঠ করবে। ইসরাইল ও মার্কিন সামরিক সহায়তা নিয়ে বিশাল বাহিনী গঠন করে দরিদ্র দুর্বল ইয়েমেনের হুতিদের পরাস্ত করতে পারেনি আমিরাত ও সউদী আরবের জোট। এখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের টোপ গিলে আরব দেশগুলো নিজেদের জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনছে না তো! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরাইলের গ্রেটার ইজরাইল বা একপাক্ষিক ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি প্লান বিশ্ববাসী মানছে না। এর মধ্যে শান্তির সম্ভাবনা নেই। পশ্চিমা বশংবদ, দুর্বল আরবদের ভয় দেখিয়ে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের পন্থাও বিফল হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত সন্ধিতে উপনীত হতে পশ্চিম তীর ও গাজায় ইজরাইলের নতুন দখলদারিত্বের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার কথা বলা হয়েছে। ইরানকে টার্গেট করে মধ্যপ্রাচ্যে বিভক্তির ভূ-রাজনীতি আমেরিকা, ইজরাইল এবং আরবদের জন্য বুমেরাং হতে পারে। জেরুজালেমসহ আরব ভূমিতে দখলবাজি পরিত্যাগ করে শান্তি ও সহাবস্থানের পরিকল্পনা সফল করতে হলে ইরান, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়াসহ সব পক্ষের সাথে সমঝোতা ও সম্পর্কোন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। আমেরিকার তরফ থেকে সে পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা নেই। এখন নতুন শান্তি চুক্তির নামে আমেরিকা আবারো ভুয়া মধ্যস্থকারির ভূমিকায় ফিরে আসতে চাইছে। আরবদের মধ্যে প্যাঁচ লাগিয়ে, বিরোধ জিইয়ে রেখে আরো শত বছরের জন্য ইসরাইলকে নিরাপদ রাখাই ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির মূল লক্ষ্য।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।