পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রদত্ত সামাজিক বনায়নের সংজ্ঞা হচ্ছে, বনায়ন কার্যক্রমে জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্তকরণের যেকোন পরিস্থিতি। শিল্পভিত্তিক বৃহদায়তন বনায়ন এবং কর্মসংস্থান ও মজুরিভিত্তিক উন্নয়ন সহায়ক অন্যান্য ধরনের বনায়ন সামাজিক বনায়ন নয়, বরং গোষ্ঠিভিত্তিক বনায়নে উৎসাহ ও সহায়তা প্রদানকল্পে বনশিল্প ও সরকারি প্রচেষ্টায় পরিচালিত কর্মকান্ড সামাজিক বনায়নের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশে সামাজিক বনায়নের ইতিহাস প্রাতিষ্ঠানিক বন সম্প্রসারণ কার্যক্রম প্রবর্তনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৬২-৬৩ সালে রাজশাহী ও ঢাকায় বন সম্প্রসারণ বিভাগ গঠন এবং ১ জুনকে বৃক্ষরোপণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। চারাগাছ উৎপাদন ও বিতরণের জন্য বন সম্প্রসারণ বিভাগ সৃষ্টির পর থেকেই বনায়ন কার্যক্রমের প্রসার ঘটতে থাকে। এই বনায়ন কর্মকান্ড অবশ্য জেলা সদর ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নার্সারি স্থাপন ও আনুষ্ঠানিক বৃক্ষরোপণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বৃক্ষরোপণ অভিযান প্রথমদিকে একদিনের জন্য শুরু হলেও পরে তা এক সপ্তাহ, এক মাস এবং সর্বশেষ তিন মাসে বৃদ্ধি পায়। কর্মসূচি শুরুতে খুবই সীমিত ছিল এবং তা জনগণের উপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এটি সম্প্রসারণকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গির বা জনগণের মানসিক পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হয়। ফলে ভূমিহীন জনগণকে বনায়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়।
বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন মাহবুবুল আলম চাষী, অধ্যাপক ইউনুস ও অধ্যাপক আলীমসহ কয়েকজন উদ্যোক্তা। তাঁরা চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত বেতাগী ও পামোরা নামের দুটি বিরান পাহাড়ে এ প্রকল্প গ্রহণ করেন। এজন্য ১০১টি পরিবার বাছাই করে তাদের সেখানে জমি দেওয়া হয়। এই কর্মসূচি ছিল স্বনির্ভর ধরনের। এসব কৃষক বাইরের কোন অনুদান পেতো না। কৃষি ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ ও ঋণ আদায়ের শর্তে ঋণ বিতরণ করত। এ কার্যক্রম দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে মূল্যায়ন করা হয় এবং সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যায়। তবে নির্বাচিত ১০১টি পরিবারের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ৮৩টিতে দাঁড়ায়। এই প্রকল্পলব্ধ অভিজ্ঞতা আরও কর্মসূচি প্রণয়নে যথেষ্ট সহায়তা করে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থসাহায্যে গৃহীত গোষ্ঠি বনায়ন প্রকল্প থেকেই মূলত সামাজিক বনায়নের কর্মসূচি শুরু। এজন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ১ কোটি ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার ঋণ মঞ্জুর করে। এছাড়া জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মাধ্যমে কারিগরি সাহায্য হিসেবে ২০ লক্ষ মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেয়। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সাতটি বৃহত্তর জেলায় দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও যশোরে এই প্রকল্প কার্যক্রম ১৯৮২ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত চলে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল জ্বালানি কাঠ, গবাদি পশুর খাদ্য, ছোটখাটো কাঠ, ফল ও অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্যের সরবরাহ বৃদ্ধি।
প্রকল্পটির প্রধান উপাদান ছিল ১. সড়ক, রেলপথ ও বেড়িবাঁধের পাশাপাশি প্রায় ৪,৮০০ কিলোমিটার গাছ লাগানো; ২. জ্বালানি কাঠ সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ৪,৮০০ হেক্টর জমিতে বৃক্ষরোপণ এবং ১২০ হেক্টর বিরান বনভূমির ওপর কৃষি বনায়ন প্রদর্শন খামার প্রতিষ্ঠা; ৩. রাজশাহীতে একটি সামাজিক বনায়ন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন; ৪. প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা হিসেবে কর্মচারীদের প্রশিক্ষণদান ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ; ৫. বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা; এবং ৬. প্রকল্প এলাকায় আঞ্চলিক ও বিভাগীয় কার্যালয় প্রতিষ্ঠা। বনায়ন কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে প্রকল্পটি সার্বিক সফলতা অর্জন করে। প্রকল্পটি প্রথমবারের মতো গোষ্ঠিভিত্তিক বনায়ন কর্মসূচিতে মহিলাদের সম্পৃক্ত করে।
গোষ্ঠিভিত্তিক বনায়ন প্রকল্পের সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ‘থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদন করে। এ প্রকল্প সুন্দরবন ও বৃহত্তর চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের জেলাগুলি ছাড়া সারাদেশে বিস্তৃত ছিল। প্রকল্পের উপাদানভিত্তিক লক্ষ্য ছিল ১৬,১৯৪ হেক্টর উজাড় হওয়া শালবনে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে বন তৈরি; ৩২৮৯ হেক্টর অনাচ্ছাদিত বেদখলকৃত শালবনে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কৃষি বনায়ন খামার স্থাপন; পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকার বাইরে ৮১০ হেক্টর জমিতে বনসৃষ্টি; সাবেক গোষ্ঠিভিত্তিক বনবৃদ্ধি কেন্দ্রের ৮টির উন্নয়ন, ৩২টির উন্নীতকরণ ও ৫১টির রক্ষণাবেক্ষণ এবং এগুলিকে ‘বন সম্প্রসারণ নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে নতুন নামকরণ; প্রকল্পের মেয়াদে ৪.৮০-৪.০০ কোটি চারা উৎপাদন ও বণ্টন; ৭৫,০০০ জন গ্রামের নেতৃ-স্থানীয় ব্যক্তি, ব্লক-সুপারভাইজার, থানা কৃষি কর্মকর্তা এবং বন দপ্তরের রোপণ সহকারী, মালি, কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণদান; থানা কমপ্লেক্সে আরও ৩৪৫টি নার্সারি স্থাপন; সড়ক, রেলপথ ও খালের বাঁধের ধারে ১৭,৭৬০ কিমি ফালি-বন সৃষ্টি; নবগঠিত থানা নার্সারিগুলিতে ১.০৯৭ কোটি চারাগাছ উৎপাদন ও বণ্টন; এবং উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ১০০ বেসকারি নার্সারি স্থাপন।
কৃষিবনায়ন মূলত সামাজিক বনায়ন ও বসতবাড়ির বনায়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, যার উদ্দেশ্য কৃষি ও বনের সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে জমির ব্যবহার। এর প্রধান উদ্দেশ্য ফসলের সঙ্গে বৃক্ষ বা অনুরূপ কোনো দ্রুতবর্ধনশীল উদ্ভিদ জন্মানো। কৃষিবনায়ন উদ্যান, বন ও পশুপালন কার্যক্রমসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষি কাজের জন্য একই জমির যুগপৎ ব্যবহারের একটি গুরুত্বপূর্ণ টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা কৌশল। একটি সনাতন প্রথা হলেও জমি, অঞ্চল ও প্রতিবেশ অবস্থানুযায়ী এ পদ্ধতিকে আরও বাস্তবসম্মত ও গতিশীল মডেলে পরিণত করা যায়। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ ছাড়াও কৃষিবনায়ন কোনো স্থানের প্রতিবেশে ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খাদ্য সমস্যার সমাধানে, মরুকরণরোধে, পল্লী ও শহরতলি উন্নয়নে, বনসংরক্ষণ ও কর্মসংস্থান সম্পর্কিত জাতীয় সমস্যা নিরসনের একটি আর্থ-সামাজিক উদ্যোগ হিসেবে এবং বিভিন্ন ভূমিস্তরের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারের জন্যই কৃষিবনায়ন আবশ্যক। কৃষিবনায়ন পদ্ধতি বনজ বৃক্ষ ও ফসল উদ্ভিদের মধ্যে পারস্পরিক বিকাশের সুযোগ ঘটিয়ে প্রাকৃতিক সুস্থিতি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে কৃষিবনায়ন চর্চা মোটামুটি ব্যাপক হলেও এর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নিম্নমানের। বৃক্ষের নির্বাচন এবং রোপণকৌশল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেন-তেনভাবে সম্পন্ন হয়, অথচ বসতবাড়ির চারপাশে জন্মানো গাছপালার ওপরই দেশ অনেকাংশে নির্ভরশীল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণ ও অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে কৃষিবনায়ন ব্যবস্থা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। অনেক সময়ে নতুন গাছ না লাগিয়েই বছরে বসতবাড়ির গাছপালার প্রায় ১০% কেটে ফেলা হয়। সম্প্রতি কৃষিজমির আশেপাশে আরও অধিক পরিমাণে বিভিন্ন জাতের গাছ লাগানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে কয়েকটি প্রজাতি উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে বাবলা, খয়ের, খেজুর, কাঁঠাল, তাল, ও আম প্রধান এবং শিমুল, সাদা শিমুল, নারিকেল , সুপারি, লিচু ও কয়েক ধরনের বাঁশ হলো অপ্রধান বৃক্ষ যেগুলি ফল, দামি কাঠ, জ্বালানি, গৃহনির্মাণ সরঞ্জামের মতো কিছু অর্থকরী সামগ্রীর জন্য সমতলে ফসলের জমির পাশেও লাগানো যায়। তিস্তার বন্যাবিধৌত উঁচু সমতলে নিম , আম, খয়ের, শিশু, কাঁঠাল এবং কয়েক প্রজাতির বাঁশ লাগানোর সুপারিশ করা হয়েছে। কৃষিবনায়নের ধারণা বর্তমানে বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে।
সামাজিক বনায়ন হলো স্থানীয় দরিদ্র জনগণকে উপকারভোগী হিসেবে সম্পৃক্ত করে পরিচালিত বনায়ন কার্যক্রম, যার প্রত্যক্ষ সুফলভোগী ও উপকারভোগী হয়ে থাকেন তারা। সামাজিক বনায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা, বনজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা, লভ্যাংশ বণ্টন ও পুনঃবনায়ন সব কাজেই স্থানীয় দরিদ্র জনগণ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। ভূমিহীন, দরিদ্র, বিধবা ও দুর্দশাগ্রস্থ গ্রামীণ জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করাই সামাজিক বনায়নের প্রধান লক্ষ্য। সামাজিক বনায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের স্বনির্ভর হতে সহায়তা করা এবং তাদের খাদ্য, পশুখাদ্য, জ্বালানি, আসবাবপত্র ও মূলধনের চাহিদা পূরণ করা। নার্সারি সৃজন, প্রান্তিক ও পতিত ভূমিতে বৃক্ষরোপণ করে বনজ সম্পদ সৃষ্টি, মরুময়তারোধ, ক্ষয়িষ্ণু বনাঞ্চল রক্ষা ও উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবেশ উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্ব সৃষ্টি এবং সর্বোপরি কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক বনায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।