পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শোকে মুহ্যমান ময়মনসিংহ সদর উপজেলার সিরতা ইউনিয়নের কোনাপাড়া গ্রাম। এখানকার মানুষ এখন বোবা কান্নার পাষাণভারে স্তব্ধ। সিরতা ইউনিয়নসহ আশপাশের সকলের কাছে অতিপ্রিয় মানুষ বিশিষ্ট আলেম হাফেজ মাওলানা মাহফুজুর রহমান (৩৮)। তিনি কোনাপাড়া গ্রামে নিজের বসতভিটায় মাদরাসায়ে মারকাযুস সুন্নাহ ও ইসলাহুল বানাত মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠাতা করেন। মোহতামিম ছিলেন তিনি নিজেই। অসংখ্য মানুষের ভিড় পরিলক্ষিত হলে নির্ধারিত সময় সকাল ৯টার অনেক আগেই গতকাল ভোর সাড়ে ৬টায় একসাথে ১২ জনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
পরে কোনাপাড়া বাজারের কাছে একসাথে পাশাপাশি ৯ জনকে দাফন করা হয়। হাফেজ মাওলানা মাহফুজুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ে মারকাযুস সুন্নাহর পাশেই তার কবর দেয়া হয়। এদিকে নিখোঁজ রাকিবুল ইসলামের লাশ গতকাল ভোরে পাওয়া গেছে। এছাড়াও গৌরীপুরের সহনাটিতে শফিকুল ইসলাম ও তার পুত্র সামান মিয়ার লাশ সকালে দাফন করা হয়। নেত্রকোণার মদন থেকে দুপুরে কোনাপাড়ায় লাশ আনা হলে বিকেলে জানাজা শেষে ৯ জনের পাশে তার লাশও দাফন করা হয়।
নেত্রকোণায় ট্রলার ডুবিতে নিহতদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার মো. কামরুল হাসান এনডিসি জানান, ট্রলার ডুবিতে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার জন্য নেত্রকোণা ও ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে মদন উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে ৭ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। এরপর কোনাপাড়ায় ময়মনসিংহ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফ হোসাইন ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম বুধবার রাতেই নিহতের স্বজনদের পাশে গিয়ে সমবেদনা জানান। তাদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং জাতীয় সংসদ সদস্য ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে এবং একটি সংস্থার পক্ষ থেকে আরো ৫ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। মারা যাওয়া প্রতি পরিবারকে সর্বমোট ৩৭ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। স্থানীয় কামাল ও আমিনুলের কাছে সবগুলো পরিবারের টাকা দেয়া হলেও এখনো স্ব-স্ব পরিবারের কাছে পৌঁছানো হয়নি বলে জানা গেছে।
মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যাওয়া হাফেজ মাওলানা মাহফুজুর রহমানের ভাতিজা ও ভাই ফজর উদ্দিনের পুত্র ঢাকার ফরাশগঞ্জ কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মো. জাকির হোসেন কান্না জড়িত কণ্ঠে জানান, তার দু’ভাই মুজাহিদ ও হাফেজ জুবায়ের এবং চাচাতো দু’বোনও মারা গেছে।
মদন উপজেলার মিনি কক্সবাজার হিসেবে খ্যাত উচিৎপুরে নৌকা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে মাদরাসা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ মোট ৪৮ জন ঢাকার একটি স্টাফ বাস মদনে যাওয়া-আসা বাবদ ৯ হাজার টাকায় ভাড়া করে বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায় রওনা দেন। পথিমধ্যে তেলিগাতি নামক স্থানে যাত্রা বিরতি ও সেখানে অনেকে নাস্তা করেন। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মদন উপজেলায় পৌঁছেন তারা। সেখানে দলের গৌরীপুরের শফিকুল ইসলাম আগেই গিয়ে একটি ট্রলার ভাড়া করেন। ওই ট্রলারে চড়ে রওনা দেন হাওর ভ্রমণে। ইঞ্জিন চালিত ট্রলারটি যাত্রা শুরু করার ১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই তীব্র বাতাস ও ঢেউয়ের কবলে পড়ে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে ট্রলারের ওপর। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো বড় বড় কয়েকটি ঢেউয়ের পানি এসে পড়ে ট্রলারের ভিতরে। এতে ট্রলারটি পানিতে ভরে যায়। ট্রলারের একটি কোণা তখন ডুবতে থাকে। এসময় ৪৮ জন ট্রলার যাত্রীর উচ্চঃস্বরে কান্নাকাটি ও আর্তচিৎকারে উচিৎপুরের রাজালীকান্দা এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যেই ট্রলারটি ডুবে যায়। এতে ৩০ জন যাত্রী জীবন নিয়ে উদ্ধারকারী নৌকায় উঠতে পারলেও ১৮ জনের মৃত্যু ঘটে।
মাওলানা মো. জাকির হোসেন আরো জানান, তীব্র ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতার কেটে শক্তি দিয়ে কিছুক্ষণ পানির উপরে থাকার চেষ্টা করি। এরপর শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লে আস্তে আস্তে তার শরীর পানির নীচে যেতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে তার দুটি হাত পানির উপরে উচু করে তুলে রাখেন। ট্রলার যাত্রীরদের কান্নাকাটি ও চিৎকারের শব্দ শুনে পরে আশপাশের লোকজন ট্রলারের যাত্রীদের উদ্ধার করতে দ্রæতই চলে আসে। ৬/৭ মিনিট পানির নীচে থাকার পর একজন এসে তার হাত ধরে উদ্ধারকারী নৌকায় তুলে নেয়। তখন তার শরীর প্রায় অচেতন। একটু পর তার চাচাত বোন লুবনা আক্তার (১০) ও জুলফা আক্তারকে (৭) তুলে আনা হয়। ট্রলারে তোলার সময় ওরা জীবিত থাকলেও মুহূর্তের মধ্যেই ওরা প্রাণ হারায়।
ইত্তেফাকুল ওলামা বৃহত্তর ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কমিটির সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক মুফতি আমীর ইবনে আহমদ বলেন, এতগুলো আলেম ও ছাত্রের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক, এত লাশের বোঝা আমাদের জন্য অনেক ভারী। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শহীদি মৃত্যু নসীব করুন।
মুফতি আমীর ইবনে আহমদ আরো বলেন, গুণী ও বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন হাফেজ মাওলানা মাহফুজুর রহমান ও তার পরিবারের ৮ জন সদস্যসহ ১৭ জন ট্রলার ডুবিতে মৃত্যু হওয়ায় সকলেই মর্মাহত। খবর শুনে আশপাশের এলাকা থেকে অসংখ্য নারী পুরুষ চলে আসে। গতকাল সকাল ৯টায় জানাজার সময় নির্ধারণ করা ছিল। ফজরের নামাজের পর থেকেই হাজার হাজার লোক কোণাপাড়ায় আসতে থাকে। কয়েক হাজার লোক একত্রিত হওয়ার পর অবস্থা বেগতিক দেখে প্রশাসনের নির্দেশে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে ভোর সাড়ে ৬টায় এক সাথে ১২ জনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নৌকাডুবিতে মৃত ১৮ জনের মধ্যে ময়মনসিংহের একই পরিবারের ৮ জন।
তারা হলেন- ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ৫ নম্বর সিরতা ইউনিয়নের কোনাপাড়া গ্রামের মাদরাসায়ে মারকাযুস সুন্নাহর প্রতিষ্ঠাতা ও মোহতামিম মাহফুজুর রহমান (৩৮), তার বড় ছেলে হাফেজ মাহবুবুর রহমান আসিফ (১৭), ছোট ছেলে মাহমুদুর রহমান (১৪), ভাগ্নে (বোন রাহানারার পুত্র) হাফেজ রেজাউল করিম (১৮), ভাতিজা, মো. জুবায়ের হোসাইন (১৯), হাফেজ মো. মুজাহিদ মিয়া (১৪) উভয়ের পিতা ফজর উদ্দিন, মাহফুজুর রহমানের ভাতিজী এবং আরেক ভাই ওয়েজ উদ্দিনের দু’কন্যা লুবনা আক্তার (১০) ও জুলফা আক্তার (৭)। এদের মধ্যে লুবনা ও জুলফা ইসলাহুল বানাত মহিলা মাদরাসা এবং বাকিরা মাদরাসায়ে মারকাযুস সুন্নাহর হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থী।
মাহফুজুর রহমানের ভগ্নিপতি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘সকালে পরিবারের সকলকে নিয়ে আনন্দ ভ্রমণে গিয়েছিল। কে জানত এটাই তাদের শেষ বিদায়’ -এ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
নিহত রেজাউলের মা রেহেনা খাতুন ছেলের কথা বলতে বলতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ছেলে ছোট থাকতেই তার বাবা মারা গেছেন। মামার বাড়িতে থেকেই রেজাউল পড়াশোনা করত’।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, নিহত ১৮ জন ময়মনসিংহের বাসিন্দা। এর মধ্যে গৌরীপুর উপজেলার ২ জন, সদর উপজেলার সিরতা ইউনিয়নের ১৫ জন ও ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের ৩১ নাম্বার ওয়ার্ডের একজন।
ময়মনসিংহ স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক একেএম গালিভ খান বলেন, নৌকাডুবিতে মৃতদের পরিবারের খোঁজখবর নেয়ার পাশাপাশি তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ ও সেক্রেটারী মাওলানা এবিএম জাকারিয়া এক বিবৃতিতে নেত্রকোণার মদনে হাওরে বেড়াতে গিয়ে ট্রলার ডুবিতে কওমী মাদরাসার ১৭জন শিক্ষক শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
গতকাল এক শোক বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, এ দুর্ঘটনা খুবই মর্মস্পর্শী। এতে মাদরাসার ১৭ জন শিক্ষক ও ছাত্রের প্রাণহানীর ঘটনায় অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হলো। আল্লাহ রব্বুল আলামিন সকলকে মাফ করে দিয়ে শহীদ হিসেবে কবুল করুন এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমীন। নেতৃদ্বয় নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।