পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কোভিড-১৯ পেন্ডেমিক এবং ভগ্নপ্রায় টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বরাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ চলছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির পালাবদল হঠাৎ করে এমনিতেই ঘটে না, কোভিড-১৯ মহামারীতে মানবিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয় বিশ্বের পরাক্রমশালী রাষ্ট্রগুলোর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে। সেখানে কোটি কোটি মানুষের খাদ্য, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা. গতিশীলতা ও নিরাপত্তার ইস্যুগুলোকে সামনে রেখে রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সক্ষমতার মানদন্ড নিরূপিত হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশ ও অঞ্চলে কোভিড-১৯ মহামারী আঘাত হানলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পক্ষান্তরে চীনের ওহান থেকে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছািড়য়ে পড়লেও বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি অত্যন্ত ক্ষীপ্রতা ও দক্ষতার সাথে ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে চলমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকটকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন ক্রমাগত চীন বিরোধী বেøইম গেম, প্রচারনা ও উস্কানিমূলক তৎপরতা বাড়িয়ে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে শুরু করে চীন বিরোধী প্রতিটি পদক্ষেপই শেষ পর্যন্ত মার্কিনীদের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন নানা অজুহাতে একেকবার চীনের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে যায়, এর জবাবে চীনা পদক্ষেপে তাদেরকে লা-জওয়াব হয়ে পড়তে দেখা যায়। দুই বছর আগে হঠাৎ করেই চীনা পণ্যের উপর হাজার হাজার কোটি ডলারের নতুন ট্যাক্স বসিয়ে দিলে চীনা অর্থনীতির গতিশীলতা ব্যহত হলেও মার্কিন অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানও বড় সংকটের সম্মুখীন হয়। মার্কিন পণ্যের উপর চীনের পাল্টা ব্যবস্থায় মার্কিন অর্থনীতির সংকট আরো ঘণীভূত হওয়ার পরই দুই পক্ষের মধ্যে এক প্রকার নমনীয় অবস্থান ও সমঝোতার মনোভাব দেখা যায়। তবে মার্কিন প্রশাসন চীনের সাথে অর্থনীতির সংঘাতকে ক্রমে একটি রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন এবং গোপীয় তথ্য গায়েবের অভিযোগ তুলে হঠাৎ করেই হিউস্টনের চীনা কস্যুলেট অফিসটি বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ জারি করে ট্রাম্প প্রশাসন। দক্ষিণ চীন সাগরে প্রভাব বিস্তারের লড়াই থেকে বাণিজ্যযুদ্ধ ও প্রচারযুদ্ধ পর্যন্ত সমানতালে চোখে চোখ রেখে চলা চীনা কমিউনিস্ট প্রশাসন মার্কিনীদের চীনা কনস্যুলেট বন্ধের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়ে দিয়েছিল। বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যেই চীনের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর চেংদুতে অবস্থিত মার্কিন কনস্যুলেট ভবনটি বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ জারি করে।
চীন-আমেরিকা, চীন-ভারতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনার মধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটে চলেছে। রাশিয়ার সাথে পুরনো কৌশলগত সম্পর্কের পাট চুকিয়ে মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কের সাম্প্রতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক ভূগোলে ভারতকে বাড়তি সুবিধাজনক অবস্থান দেয়াই সঙ্গত ছিল। কিন্তু প্রতিবেশিদের সাথে ভারতের দাদাগিরি ও আধিপত্যবাদী নীতির কারণে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বন্ধুহীন অবস্থার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে ভূটান-মালদ্বীপ পর্যন্ত এ সময়ে ভারতের দাদাগিরির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সুদৃঢ় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। উপযুক্ত সময়ে চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ও কৌশলগত সামরিক-অর্থনৈতিক চুক্তির মধ্য দিয়ে সাহসী পদক্ষেপ না নিলে শ্রীলঙ্কা হয়তো এখনো গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত পরিস্থিতির মধ্যেই পড়ে থাকতো। সেই ঔপনিবেশিক আমলেই পশ্চিমারা ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্ব ও নন-ওয়েস্টার্ন দেশগুলোতে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রেখে নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পন্থা গ্রহণ করেছিল। উপনিবেশোত্তর ভারতের সাথে প্রতিবেশিদের সম্পর্কোন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে বৃটিশরা কিছু ‘অ্যাপল অব ডিসকর্ড’ তৈরী করে রেখে গেছে। ভারত ভাগের সময় রেখে যাওয়া অমিমাংসিত সীমান্ত সমস্যা নিয়ে পশ্চিমাদের ভূমিকা এখনো অস্বচ্ছ ও দায়িত্বহীন। বাংলাভাগ, কাশ্মীর, পাঞ্জাব, শিয়াচেন, লাদাখ, রোহিঙ্গা মুসলমান ও কুর্দি এলাকায় অদ্ভুত অস্বাভাবিক ভাগাভাগি করে দিয়েই তারা নিজেদের কুকর্মের সমাপ্তি করেনি, এসব সীমান্ত ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে গত সত্তুর বছর ধরে চলা আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে তারা পেছন থেকে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে। শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তির আধিপত্যবাদী নীতি অবস্থানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে পশ্চিমাদের শীতল নীরবতাকে নিরপেক্ষতা বলে গণ্য করার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বের বেশিরভাগ সদস্য রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট সমর্থন থাকায় ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর প্রশ্নে জাতিসংঘে পাস হওয়া গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবসমুহের বাস্তবায়ন করা বিশ্বসম্প্রদায়ের জন্য তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। গোপণ যোগসাজশে পশ্চিমারা ইসরাইল ও ভারতের আধিপত্যবাদী, আগ্রাসি ও সম্প্রসারণবাদী ভূমিকার প্রতি সমর্থন না করলে অনেক আগেই মধ্যপ্রাচ্যে ও ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল। বিশ্বের তেলসম্পদে সমৃদ্ধ এবং শতকোটি জনসংখ্যাবহুল অনেক সম্ভাবনাময় এসব অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধি পশ্চিমাদের কাছে কাঙ্খিত নয়। এসব ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে জিইয়ে রাখা গেলেও এর ফলে নিজেদের আভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা চরমভাবে বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিকাশ ও আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে ভারত বা আমেরিকার শাসকও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর তা না বুঝার কথা নয়।
‘রাজিনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ আমাদের সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদরা মাঝে মধ্যেই এই বাক্যটি আওড়ান। তবে আধুনিক তাত্তি¡ক ও অ্যাকাডেমিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যেভাবে রাজনীতিকে ‘আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’ বলে আখ্যা দেন উপমহাদেশের সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদরা সে অর্থে তা বুঝেন না বা বুঝতে চান না। ব্যক্তিগত গোষ্ঠীগত বা দলীয় স্বার্থের প্রশ্নে তারা যতটুকু আপসকামী জাতিগত সহাবস্থান ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে আমাদের এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের বেপরোয়া মনোভাব ও সহিংস নীতির খেসারত দিচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ। এক সময়ের অনুন্নত-অনগ্রসর জেলে পল্লী সিঙ্গাপুর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুধুমাত্র সমুদ্রবন্দরের রাজস্বকে ভিত্তি করে এখন এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ নগররাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কলোম্বো, করাচি, বোম্বাই, কলিকাতা বা চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সিঙ্গাপুরের চেয়ে কম ছিল না। প্রায় একই আকারের ড্রেমোগ্রাফিক অবস্থান এবং একই সময়ে স্বাধীনতা লাভ করেও মালয়েশিয়া বাংলাদেশের চেয়ে কতগুণ এগিয়ে গেছে। প্রায় ২০ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাথে গেরিলা যুদ্ধে বিদ্ধস্ত ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসরমান সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা যে শত্রু র সাথে ২০ বছর লড়াই করেছিল, যুদ্ধশেষে সেই শত্রু রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই নিজেদের প্রধান বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে নিজের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিল। আজকের বিশ্ববাণিজ্যে পশ্চিমাবিশ্বে এ্যাপারেল রফতানির প্রতিযোগিতায় ভিয়েতনাম বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ। অনেক পরে এসেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে ভিয়েতনাম। বার্ংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, শিল্প বিনিয়োগে নিরাপত্তাহীনতা, দুর্নীতি-অস্বচ্ছতা ও অবাধ অর্থপাচারের ব্যবস্থা না থাকলে ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। তবে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়লেও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা এখনো হাতছাড়া হয়ে যায়নি।
আন্তজার্তিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও জিও-পলিটিক্যাল অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। বিগত দশকের অর্থনৈতিক বিশ্বমন্দা বাংলাদেশকে কাবু করতে পারেনি। বরং সুলভ শ্রমে সস্তায় পোশাক রফতানির সুযোগ থাকায় অপেক্ষাকৃত বেশি দামের পোশাকের অর্ডার বাদ দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক ক্রেতা বাংলাদেশের বাজারে ঢুকেছে। এভাবেই অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি খাত প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। চলমান করোনাভাইরাস মহামারী এবং চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বাণিজ্যিক টানাপোেিড়ন শুরু হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও এশিয়ার দেশ জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে চীন থেকে কারখানা রিলোকেট করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নানা কারণে বাংলাদেশ হতে পারে চীন ছেড়ে যাওয়া শিল্প কারখানার বিকল্প স্থান। বিশেষত: শতকোটি জনসংখ্যার দুই দেশ চীন ও ভারতের মধ্যবর্তি স্থানে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশে শিল্পকারখানা প্রতিস্থাপন দুই দেশের বিশাল ভোক্তাশ্রেণী এবং তাদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও বাজারের নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখতে বাংলাদেশই হতে পারে আদর্শ বিকল্প। তবে এই করোনা অথবা চীন-ভারত বৈরিতা প্রকাশিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই চীন, জাপান, জার্মানী, কোরিয়াসহ বেশকিছু দেশের শিল্পদ্যোক্তারা তাদের কারখানা বাংলাদেশে রিলোকেট করার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসার পর বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেয়ার কারণে বেশিরভাগ প্রস্তাবই আলোর মুখ দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব প্রস্তাব সম্পর্কে সঠিক সময়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে দেশের শিল্প বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরো আগেই হয়তো কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারত। এসব হতাশাজনক ব্যর্থতা দেখে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বাংলাদেশের প্রশাসনের ভেতরে কি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো চক্র সক্রিয় রয়েছে, যারা দেশের সম্ভাবনাময় সেক্টরগুলোতে ডেডলক সৃষ্টি করে কোনো মহলের স্বার্থে দেশকে পিছিয়ে রাখতে চায়? রাষ্ট্র ও সরকারের অভ্যন্তরে এবং রাজনীতিতে তেমন কিছুর অস্তিত্ব থাকলে তা সমূলে উৎপাটন না করে দেশকে তার কাক্সিক্ষত সমৃদ্ধ লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
জাপান কোরিয়ার কথা বাদ দিলেও এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর উন্নত রাষ্ট্রের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়াও বিস্ময়কর উন্নতি করেছে। ইতিমধ্যে ভিয়েতনামের এগিয়ে যাওয়ার গতি নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি। কিন্তু আমরা এখনো তিমিরেই রয়ে গেছি কেন? এই ‘কেন’র নানামাত্রিক বিশ্লেষণ ও বহুমাত্রিক জবাব হতে পারে। তবে আমরা যদি অনেক বিষয়ের মধ্যে প্রধান বিষয়কে চিহ্নিত করতে চাই, সেখানে নিশ্চিতভাবেই যে বিষয়টি উঠে আসবে তা হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিবিদদের পশ্চাৎপদ চিন্তাধারা ও অতীতমুখী রাজনীতি। শত বছরের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বহন করলেও একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সব দায় যেন মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরেই আবর্তিত হবে। যে মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল, গণতন্ত্র, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক মুক্তি, নিয়ন্ত্রক শক্তির কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও সেই লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ণের আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যায় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশের মানুষকে বিভাজিত করে রাখা, জাতীয় ঐক্য, সংহতি এবং অর্থনৈতিক মুক্তির পথকে কণ্টকিত করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার হিংসা ও হানাহানির ধীর্ঘস্থায়ী বীজ ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে দেশকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে ফেলার অপরিনামদর্শি কর্মকান্ড গত এক দশক ধরে অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। তবে করোনা ভাইরাস মহামারীর বাস্তবতা সব কিছু ওলটপালট করে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যখন একটি নতুন মোড় পরিবর্তনের সম্ভাবনার কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে তখন বাংলাদেশ নতুন সম্ভাবনাকে আবাহনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে।
উপমহাদেশের প্রতিটা দেশ যখন ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে তখনো বাংলাদেশের শাসকদল ভারতীয় আধিপত্যবাদের সব আবদার রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। চীন, পাকিস্তান, নেপাল. শ্রীলঙ্কা, ভূটান-মালদ্বীপের মত প্রতিবেশিরা যখন যার যার মত করে ভারতীয় আধিপত্যের জবাব দিচ্ছে বাংলাদেশ তখন একদিকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে ভারতের অগ্রাধিকার নিশ্চিতের পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করতে ব্যস্ত। তবে ভিন্নদিকে বাংলাদেশের আঞ্চলিক রাজনীতিতে পরিবর্তনের আভাস কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠলেও এ ধরনের পদক্ষেপ ফলপ্রসু করে তুলতে যতটা কূটনৈতিক দক্ষতা, ক্ষিপ্রতা এবং দূরদর্শিতার প্রয়োজন তার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ফোনালাপ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের উদ্বিঘ্নতা ও নানামাত্রিক বিশ্লেষণে আবারো এটাই প্রমান করছে, বাংলাদেশের স্বাধীন কূটনৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ভারত নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সিলেট বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি চীনা কোম্পানীকে দেয়ায় ভারতীয়দের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের নিজস্ব অবস্থান এবং স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সবকিছুই ভারতের মুখাপেক্ষি হয়ে পরিচালিত হোক, এটাই যেন ভারতপন্থীদের প্রত্যাশা ও লক্ষ্য। তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি, গঙ্গার পানিবন্টন এবং যৌথনদী কমিশনের কার্যক্রম ও সুপারিশ বাস্তবায়নের মত ন্যায্য ইস্যুগুলোকে অগ্রাহ্য করেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব দাবি-দাওয়া ও প্রত্যাশিত সবকিছু আদায় করে নিচ্ছে ভারত। অথচ চীনের সাথে ভারতের দ্বা›িদ্বক অবস্থান ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য কাজে লাগিয়ে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভূটান নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। দুই বছর আগে ভ’টানের দোকলামে চীন-ভারতের মধ্যে যে তীব্র সাংঘর্ষিক সীমান্ত বিরোধ দেখা দিয়েছিল তারপর থেকে ক্ষুদ্র দেশ ভূটানও ভারতের চেয়ে চীনের প্রতি বেশি ঝুকে পড়েছে। হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র নেপালের উপর চিরস্থায়ী আধিপত্য ধরে রাখতে ভারতের সব কলাকৌশল ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার বাস্তবতা উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন বিষ্ময়। ভারতীয় আধিপত্যবাদ প্রতিবেশিরা মেনে নিচ্ছে না, এই বার্তা বুঝে ভারত তার আচরণ বদলাতে না পারলে আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের বন্ধুহীন অবস্থা শুধু তার দুর্বল অবস্থানকেই নির্দেশ করছে না, এটি ভারতীয় কূটনীতি ও আঞ্চলিক নীতির দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করছে।
দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখার পর সম্প্রতি ভূটানকে বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য করার প্রতিবন্ধকতা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। এতে বোঝা যাচ্ছে, শুধুমাত্র আধিপত্যবাদি নীতি ও দাদাগিরির মাধ্যমে অতি দুর্বল শক্তিকেও নিজের পক্ষে রাখা সম্ভব নয়। চীনা বিনিয়োগ এবং চীনের সাথে চুক্তি ও কানেক্টিভিটির কারণে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভূটান বা মালদ্বীপের মত দেশকেও আর নিজের ইচ্ছামত চালিত করতে পারছে না ভারত। এভাবেই উপমহাদেশের আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ এখনো তার অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি। বাংলাদেশকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতে ভারত ও চীনের প্রতিযোগিতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে আছে। তবে চীনের হাজার হাজার কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব, রোড এন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ের আন্তর্জাতিক কানেক্টিভিটির সুযোগ এবং চীনা বাজারে ৮ হাজারের বেশি বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের বিপরীতে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি শুণ্য। এখনো বাংলাদেশ নিজের বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতকে অন্যায্য ট্রানজিট ও বন্দর সুবিধা দিয়ে তুষ্ট রাখতে চাইছে কেন? এটা স্পষ্ট যে ভারতের পাশে একটি শক্তিশালী বাংলাদেশকে দেখতে চায় চীন। এ কারণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারি দেশ চীন। চীন যখন বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে সাবমেরিণ দিয়ে সহযোগিতা করে তখন পারমানবিক শক্তিধর ভারতকে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের পাটপণ্যে এন্টি-ডাম্পিং বেরিয়ার আরোপ করে ভারত, এর মানে হচ্ছে, ভারতীয় শাসকরা কখনো অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেনা। বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই বিএসএফ’র গুলিতে রক্ত ঝরে। চীন বা পাকিস্তান সীমান্তে এমনটি কখনো ঘটে না। শান্তি, স্থিতিশীলতা, নিরাপপত্তা ও সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখতে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরী।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।