পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশ বর্তমানে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় রয়েছে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ২০২৪ সালে মধ্য আয়ের ও ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়া। এ আকাক্সক্ষা সমগ্র দেশবাসীরও। কিন্তু সে সামর্থ্য আছে কি-না সে ব্যাপারে প্রশ্ন উদয় হয়েছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে। সরকারি কিছু ভুল কার্যক্রম ও বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্য বিধি অমান্য করায় করোনায় দেশের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ও হচ্ছে। করোনায় দেশের উন্নতিরও প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অবস্থা চরম ভঙ্গুর!অর্থ বরাদ্দের স্বল্পতা (জিডিপির ১% এর কম), অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, জনবলের ব্যাপক ঘাটতি ও ভয়াবহ দুর্নীতির জন্য এটা হয়েছে। তাই করোনাকালে বেশিরভাগ রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। কোনো রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদানে অনীহা দেখালে এবং এতে ওই রোগীর মৃত্যু ঘটলে তা ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে বিবেচিতসহ ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। করোনা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক ৫টি দাতা সংস্থার কাছে ২.৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য চেয়েছে সরকার। দেশের কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে মাত্র ২৪% দক্ষ বলে জাতিসংঘের অভিমত। তাই বিদেশি দক্ষ লোক দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ করাতে হচ্ছে। অদক্ষতার জন্য দেশে বেকারত্বও প্রকট। করোনায় বেকারত্ব আরও বেড়েছে।গত ২৭ মে প্রকাশিত আইএলও’র প্রতিবেদন মতে, ‘বাংলাদেশে ২৭.৩৯% এমনিতেই কর্মসংস্থানবিহীন। তারা শিক্ষা অথবা কোনো ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ থেকেও বঞ্চিত। আবার যেসব তরুণের চাকরি আছে তাদের ৩৫% অদক্ষ। উপরন্তু করোনার কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী প্রতি ৬ জন তরুণের মধ্যে একজন চাকরি হারিয়েছে। যাদের কর্মসংস্থান রয়েছে তাদেরও কর্মঘণ্টা কমেছে ২৩%। আর নারী তরুণদের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।’ এই অদক্ষতার জন্য প্রবাসী আয়ও কম। বৈশ্বিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে আমরা ৬ষ্ঠ কিন্তু রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে ১১তম। কারণ, অদক্ষতার কারণে আমাদের প্রবাসীদের বেতন বিভিন্ন দেশের তুলনায় অনেক কম। দেশের মানুষের অদক্ষতার প্রধান কারণ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সেকেলে,যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে অচল। তাই দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষ লোকের প্রচন্ড অভাব রয়েছে। অন্যদিকে, বেকারত্ব সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। দক্ষ লোকের ঘাটতিজনিত দেশের উৎপাদনশীলতাও খুব কম। ফলে আমাদের পণ্যের মূল্য বেশি, মানও কম। বিশ্বায়ন প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আগামীতে আরও বন্ধ হবে। ফলে দেশ বিদেশি পণ্যের বাজারে পরিণত হতে চলেছে। এসব থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন খুব দ্রুত শিক্ষার আমূল পরিবর্তন। সেকেলে শিক্ষা বন্ধ করে তদস্থলে ধর্ম ও ইংরেজিসহ কর্মমুখী শিক্ষা চালু ও মানসম্পন্ন করা। এ জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে জিডিপির কমপক্ষে ৬% করা দরকার।
আধুনিক যুগে সর্বজনীন পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার অপরিহার্য। কিন্তু সেটা দেশে থেকেও নেই। কারণ, দৈনিক চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু সক্ষমতার এক তৃতীয়াংশের মতো উৎপাদন করে বাকী সচল প্লান্ট বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এতে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। উপরন্তু মানুষ ঠিকমতো বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। প্রায়ই লোডশেডিং হচ্ছে। প্রয়োজনীয় বিতরণ ব্যবস্থা না থাকায় এটা হয়েছে! বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি হওয়ার প্রধান কারণ রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ ক্রয়। এর মূল্যও অত্যধিক। তাই বিদ্যুত খাতের আর্থিক ঘাটতি বিপুল হচ্ছে, যা কমানোর জন্য বারবার মূল্য বাড়াতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের দ্বিতীয় বড় সংকট হচ্ছে, কয়লা ভিত্তিক প্লান্ট। বায়ু মন্ডলের উঞ্চতা হ্রাসের জন্য কয়লার প্লান্ট বন্ধ করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এই খাতে বড় বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে কয়লার ব্যবহার নিষিদ্ধ হতে পারে বিশ্বব্যাপী। উপরন্তু দেশের মানুষও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রচন্ড বিরোধী। তবুও এসবকে পাত্তা না দিয়ে সরকার অনেকগুলো কয়লানির্ভর বড় প্লান্ট নির্মাণ করছে। তাও বিপুল ঋণে ও আমদানিকৃত কয়লায়। কয়লার ব্যবহার নিষিদ্ধ হলে আম-ছালা সবই যাবে!
উন্নতির গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে প্রয়োজনীয় ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা দেশে তেমন নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু তার সিংহভাগই দুর্নীতি হয়েছে। তাই অবকাঠামো নির্মাণে আমাদের ব্যয় বিশ্বে সর্বাধিক। আবার মানও অত্যন্ত খারাপ। উপরন্তু অনেকগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে অপ্রয়োজনেই। যানবাহনেরও অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। সড়ক পথের বেশিরভাগ যানবাহনের মেয়াদ উত্তীর্ণ। তবুও চলেছ! ট্রেনের অবস্থাও তাই। গত ১০ বছরে এক লাখ কোটি টাকার অধিক ব্যয় ও ভাড়া দ্বিগুণ করার পরও বিপুল লোকসান চলছেই। সেবার মানও অত্যন্ত খারাপ! আকাশ যানের অবস্থাও তথৈবচ। নৌযানের অবস্থাও তাই। নৌরুট কমতে কমতে এখন সামান্য হয়েছে। কারণ, বেশিরভাগ নদী শুকিয়ে ও মজে গেছে। যেগুলো জীবন্ত আছে, তাতেও বেশিরভাগ সময় প্রয়োজনীয় পানি থাকে না। নদী ড্রেজিং করা হচ্ছে। তবে তা কতটুকু ফলদায়ক হবে তা ভাববার বিষয়। কারণ, পানির উপরেই চলছে মহালুটপাট। তবুও শাস্তি হয় না। সে অবস্থায় পানির নিচে কী হয় তা বলা কঠিন। উন্নতির জন্য প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু দেশে এফডিআর জিডিপির ১% এর মতো আর বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির গড়ে ২৪% এর মতো চলছে বহু দিন যাবত। বিনিয়োগের এই স্বল্পতার প্রধান কারণ অনুকূল পরিবেশের অভাব। বৈশ্বিক ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে ২০২০ সালে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮ নাম্বারে (২০১০ সালে ছিল ১১৯ নাম্বারে)। তাই বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগে অনাগ্রহী। দ্বিতীয়ত: সরকারের ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণ হ্রাস পেয়েছে অনেক। অবশ্য, দেশে কয়েক বছর যাবত সরকারী বিনিয়োগ অনেক বেড়েছে (জিডিপির ৮% এর মতো)। কিন্তু সেটা ঋণে। তাই প্রতিবছর তার সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে বিপুল অর্থ। আগামী অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হবে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয়েছে ৫৭,৬৬৩ কোটি টাকা।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত গার্মেন্ট। মোট রফতানির ৮০% এর বেশি। কর্মসংস্থানেও প্রধান। এই খাতে সরাসরি ৪০ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছে, যার ৮০% প্রান্তিক নারী। এছাড়া, সহযোগী খাতে আরও প্রায় এক কোটি লোক কর্মরত আছে। কিন্তু সেই গার্মেন্টের অর্ধেক বন্ধ হয়ে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে, কারখানার নিরাপত্তা ও পরিবেশ উন্নত করার কারণে। বাকী যেসব গার্মেন্ট চালু আছে, তাদেরও অবস্থা শোচনীয় হয়েছে করোনায়। এ পর্যন্ত ৩.২ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। তাই গার্মেন্টে নতুন করে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে বহু শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি বিপুল প্রণোদনা পাওয়ার পরও গার্মেন্টে শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে কেন? বলা বাহুল্য, গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হলে তার প্রভাব পড়বে সহযোগী প্রতিষ্ঠানেও। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে- প্রবাসী আয়। তাও করোনার কারণে চরম সংকটে পড়েছে। বেশিরভাগ প্রবাসী কর্ম হারিয়ে অনাহার ও বিনা চিকিৎসার সন্মুখীন হয়েছে। তাদেরকে রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের নিকট চিঠি দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই কাজ হারিয়ে খালি হাতে প্রায় ১৪ লাখ প্রবাসী দেশে ফেরত এসেছে গত কয়েক মাসে।তারা দেশেও বেকার হয়ে পড়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আরও ২০ লাখ ফেরত আসবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কারণ, বৈশ্বিক মহামন্দা ও জ্বালানি তেলের দাম সর্বনিম্ন হওয়ায় অভিবাসী গ্রহণকারী দেশগুলো রক্ষণশীল হয়ে বিদেশি শ্রমিকের পরিবর্তে নিজেদের শ্রমশক্তি কাজে লাগাচ্ছে। এই অবস্থা বেশি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, যেখানে আমাদের মোট প্রবাসীর ৭৫% রয়েছে। কাতার, কুয়েতসহ কয়েকটি দেশ বিদেশি শ্রমিকদের কোটা নির্ধারণ করেছে। তাই অতিরিক্ত লোককে দেশে ফেরত যেতে হবেই। সৌদি আরব থেকেও লোক আনতে রাজী হয়েছে দেশের সরকার। দেশটি প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি ফেরত পাঠাতে চায় বলে পত্রিকায় প্রকাশ। মধ্যপ্রাচ্যের বাকী দেশগুলোও এই পথ অনুসরণ করবে বলে অনুমেয়। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আর একটি খাত হচ্ছে আউট সোর্সিং। এ খাতে আয় করার ব্যাপক সুযোগ আছে। কিন্তু দক্ষতার অভাবে সে সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। গত বছর এই খাতে আমাদের অর্জন ছিল মাত্র ৮৫০ কোটি টাকা। অথচ এই খাতে ভারতের অর্জন একশ’ বিলিয়ন ডলার।
যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের হৃতপিন্ড হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। অথচ, আমাদের ব্যাংকিং খাত প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা ঋণ খেলাপির কারণে মরণ যন্ত্রণায় ভুগছে অনেকদিন যাবত! এ ক্ষেত্র আমরা বিশ্বে সর্বাধিক। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার প্রবল দাবি উঠেছে। কিন্তু তা করা হয়নি! এই অবস্থায় ৯-৬ সুদ, করোনা মোকাবেলায় সরকারের প্রণোদনার এক লাখ কোটি টাকা ও ঋণের দুই মাসের সুদ গ্রহণ না করার নির্দেশ, ঋণ আদায় এবং আমানত ও আয় হ্রাস ইত্যাদিতে ব্যাংকগুলো মরণাপন্ন হয়ে পড়েছে। তাই বেসরকারি ব্যাংকগুলো টিকে থাকতে পারবে কি-না সংশয় দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় ব্যাংক বাঁচাতে কর্মীদের বেতন-ভাতা ১৫% হ্রাস, পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট, ইনসেনটিভ, বোনাস বন্ধ করাসহ ১৩ দফা লিখিত সুপারিশ করে বিএবি পত্র দিয়েছে সবক’টি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে। এরূপ ব্যবস্থা অন্য সব খাতেও শেয়ার কেলেঙ্কারির পর শেয়ার বাজার মরনাপন্ন রয়েছে অনেক দিন যাবত। শত চেষ্টা করেও চাঙ্গা করা যাচ্ছে না। কারণ মানুষের আস্থা নেই। শেয়ার কেলেংকারীর দায়ে অভিযুক্তদের শাস্তি না হওয়ায় এটা হয়েছে। আর বীমা খাতের তেমন অবদান নেই দেশের উন্নতিতে। দেশে কর আদায়ের হারও বিশ্বের মধ্যে নিম্ন। এটা যেমন মানুষের অনীহার কারণে হয়েছে, তেমনি আদায়ের সক্ষমতাও তেমন নেই রাজস্ব বিভাগের। দেশের বিশাল সমুদ্র এলাকা আছে। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে আরও ১.১৮ লাখ বর্গ কিলোমিটার পাওয়া গেছে মিয়ানমার ও ভারতের নিকট থেকে। এই সমুদ্রে রয়েছে অফুরন্ত সম্পদ। আদালতের রায়ের পর সমুদ্রে গ্যাস ও তেল উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে মিয়ানমার ও ভারত। আর আমরা এ ব্যাপারে টেন্ডারই আহ্বান করতে পরিনি! এমনকি মৎস্যও আহরণ করা হয় না তেমন। উপকূলে সামান্য আহরণ করা হয়, তাও সেকেলে যান দিয়ে। তারও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। তাই বিদেশি দস্যুরা মাছ লুট করে নিয়ে যায়। তবুও আমাদের অনেকেই নীল অর্থনীতির স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু শুধুমাত্র স্বপ্ন দেখলেই দেশের উন্নতি হয় না। হলে বাংলাদেশ হতো দুনিয়ার সর্বাধিক ধনী দেশ। তা হয়নি। কারণ, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দক্ষতা ও নিষ্ঠা লাগে, যা আমাদের তেমন নেই। দেশ পরিবেশবান্ধব না হলে সব উন্নতি নস্যাৎ হয়। তবুও বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, নদী দূষণ, পরিবেশ দূষণে আমরা বিশ্বের সেরাদের অন্যতম। অপরদিকে, সুষ্ঠভাবে জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা খুব কম আমাদের। প্রতি বছর বিপুল অর্থ ফেরত যায়। বিদেশি ঋণ ও সহায়তার ব্যবহারেও তথৈবচ। টাকার অবমূল্যায়নও হয়েছে অনেক। উপরন্তু দুর্নীতি, অর্থ পাচার, যানজট, অপচয়, খুন, ধর্ষণ, নকল, ভেজাল, শিশু শ্রম, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্ঘটনা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, আমলাতন্ত্র, মানব পাচার, বাল্য বিবাহ ইত্যাদিতে আমরা বিশ্বে অন্যতম! ওয়েলথ এক্স’র রিপোর্ট মতে, ‘গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৪.৩% হারে ধনাঢ্য ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষে।’ সুশাসনের অভাবেই এসব হয়েছে।
তবে, দেশের কৃষির অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুব ভালো। কয়েক বছর একনাগাড়ে বাম্পার ফলন হয়েছে। খাদ্য মজুদও ভালো। কিন্তু ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষকের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তাই অনেকেই পেশা পরিবর্তন করছে। দ্বিতীয়ত আমাদের কৃষিও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। কারণ, আমাদের কৃষি ব্যবস্থার বেশিরভাগ সেকেলেই রয়ে গেছে। সর্বোপরি কৃষি শ্রমিক সংকটজনিত মজুরী ব্যাপক। সব মিলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন মূল্য বেশি। আর প্রতিযোগী দেশগুলোর কৃষি খাত সম্পূর্ণরূপে যান্ত্রিকরণ করা হয়েছে। ফলে তাদের উৎপাদন ব্যয় কম। আমাদের কৃষির দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, কৃষি পণ্যের প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের তেমন ব্যবস্থা নেই। তাই অপচয় ও পচে যায় প্রায় ৩০%। এছাড়া, মওসুমে মূল্য অনেক কম আর মওসুম শেষে মূল্য অত্যধিক। সম্প্রতি কৃষি খাতকে যান্ত্রিকরণে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সরকার ঘোষণা করেছে, কোনো জমি পতিত থাকলে সেটা সীজ করা হবে। কিন্তু চাষ করে যদি লাভ না হয়, তাহলে কেউ ফসল ফলাবে না। তাই মাছ, মাংসসহ সব ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা যতই নির্দেশ দেওয়া হোক না কেন তা ফলদায়ক হবে না। ভারতের কৃষকের উন্নতির জন্য সম্প্রতি সরকারি ক্রয়মূল্য ৫০% বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমাদের তাই করা দরকার। একই সঙ্গে সব কৃষি পণ্যের প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
করোনায় সারা বিশ্বের ন্যায় আমাদেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। অর্থনীতি সমিতির তরফে বলা হয়েছে, ‘করোনাভাইরাসের আগে আমাদের কর্মে নিয়োজিত ছিল ৬.১০ কোটি মানুষ। তন্মধ্যে ৩.৬০ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে।লকডাউনের আগে যে ১.৭০ কোটি মানুষ অতি ধনী শ্রেণির কাতারে ছিল তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তবে উচ্চ-মধ্যবিত্তে থাকা ৩.৪০ কোটি থেকে ১.১৯ কোটি মধ্য-মধ্যবিত্তের কাতারে, মধ্য-মধ্যবিত্তে থাকা ৩.৪০ কোটি থেকে ১.২ কোটি নিম্ন-মধ্যবিত্তের কাতারে, নিম্ন-মধ্যবিত্তে থাকা ৫.১০ কোটি থেকে ১.১৯ কোটি দরিদ্রের কাতারে ও দরিদ্র থাকা ৩.৪০ কোটি থেকে ২.৫৫ কোটি হতদরিদ্রের কাতারে নেমে গেছে। সব মিলিয়ে লকডাউনের মাত্র ৬৬ দিনে ৫.৯৫ কোটি মানুষের শ্রেণি কাঠামো পরিবর্তন হয়েছে। এ মানুষগুলো এক ধাপ নিচে নেমে গেছে। সর্বোপরি আয় বৈষম্য মহাবিপজ্জনক পর্যায়ে গেছে। তবুও এ বিপদগ্রস্ত মানুষ সরকারি সাহায্য তেমন পায়নি! বেসরকারি ত্রাণও নগন্য। ব্র্যাকের জরিপ মতে, ‘করোনার মধ্যে ত্রাণ ও সহায়তা পায়নি ৬৯% মানুষ’। সরকার যেটুকু ত্রাণ ও সহায়তা দিয়েছে, তার অধিকাংশ দুর্নীতি হয়েছে, যা বিশ্বে নজিরবিহীন!
এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে আমাদের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো উন্নতির অলীক স্বপ্ন না দেখে টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে এবং তাতে সফল হয়ে উন্নতির পথে এগুতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন অতি দ্রæত বর্ণিত সব সমস্যা দূর ও সম্ভাবনাগুলোর সদ্ব্যবহার করা। সরকারি দপ্তরগুলোতে ব্যাপক সংস্কার করা দরকার। এমন বহু প্রতিষ্ঠান আছে, যার অধিকাংশ জনবলের কোন কাজ নেই। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে লোকের ঘাটতিজনিত মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে, একই কাজের বহু প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি। বরং প্রশাসনিক ব্যয় বেড়েছে অনেক। এই অবস্থায় একটি নিরেপক্ষ ও বিশেষজ্ঞ কমিশনের মাধ্যমে সরকারী সব প্রতিষ্ঠানকে ব্যাপক সংস্কার করে জনবল হালনাগাদ, প্রযুক্তি নির্ভর ও পেশাভিত্তিক করা দরকার। সর্বত্রই নিরপেক্ষভাবে দক্ষ লোক নিয়োগ করা প্রয়োজন। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সর্বোপরি প্রতিটি কাজের কঠোর জবাবদিহি আবশ্যক। দরকার সুশাসন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণ স্বাধীন ও শক্তিশালী করা ছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব দিকে যথোচিত নজর দেয়া হলে চলতি সংকট মোকাবেলা করে টিকে থাকা এবং পরবর্তীতে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন তরান্বিত করা সম্ভবপর হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।