পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
(পূর্ব প্রকাশিতর পর)
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে যে বিভৎসরূপে, কদর্যরূপে এখনো বর্ণবৈষম্য, শ্রেণিবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ বিরাজ করছে তেমনটা বোধহয় পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। এক শ্রেণির স্বার্থন্ধ শাস্ত্রকার যে অমানবিক নিয়ম-নীতির প্রচলন করে গিয়েছিলেন সহস্রাধিক বছর ধরে চলছে তারই অনুসৃতি। নিম্ন শ্রেণির মনে বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছে যে, এ অবস্থান তাদের সৃষ্টিগত। উদ্ধৃতি একটু দীর্ঘ হলেও তাদেরই শাস্ত্রের কিছু কথা আমরা তুলে ধরছি:
‘সেই সময় ভারতের পন্ডিত-পুরোহিতগণ অনু, অত্রি প্রভৃতি সংহিতাকারগণের আল্লাহর কোটি কোটি সন্তানকে শূকর, গর্দভ অপেক্ষাও ঘৃণিত মনে করিতেছিল। তৎকালীন শাস্ত্রকাররা এদেশের শূদ্রদিগকে সম্পূর্ণভাবে অতি জঘন্য দাস জাতিতে পরিণত করার জন্য যে সব নিষ্ঠুর ব্যবস্থার প্রবর্তন করিয়াছিলেন, তাঁহাদের পুঁথি-পুস্তকে আজও তাহা বিদ্যমান আছে। সংহিতাকারদের নিষ্ঠুর ব্যবস্থায় শূদ্র ক্রীত হউক বা অক্রীত হউক, তাহাকে দাসত্ব করিতেই হইবে। কারণ, ব্রাহ্মণের দাস্যকর্ম নির্বাহ করার জন্যই বিধাতা শূদ্রের সৃষ্টি করিয়াছেন। যেমন মরণ পর্যন্ত শূদ্রের শূদ্রত্ব নষ্ট হয় না, সেইরূপ শূদ্র, স্বামী কর্তৃক মুক্ত হইলেও, তাহার দাসত্বের মোচন হইতে পারে না।
ভগবান মনু ইহার পর স্পষ্টাক্ষরে ব্যবস্থা দিতেছেন যে, ‘এই দাস যাহা কিছু উপার্জন করিবে, তাহার অধিকারী হইবেন তাহার স্বামী দ্বিজগণ। ব্রাহ্মণ প্রভূ শূদ্রের সমস্ত ধন-সম্পদ গ্রহণ করিতে, এমন কি কাড়িয়া লইতে অধিকারী। কারণ- শূদ্রদাসের স্বত্বাস্পদীভূত কিছুই নাই, উহার যাবতীয় ধন উহার প্রভূর গ্রহণীয় (৪১৬-১৭)। রাজাকে বিশেষ তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিতে হইবে এই শূদ্রের উপর, যেন সে সর্বদাই নিজের দাস্যকার্যে নিযুক্ত থাকে। কারণ এই কার্য ত্যাগ করিয়া অশাস্ত্রীয় উপায়ে, ধন উপার্জন করিতে সমর্থ হইলে, সে অহঙ্কারে ধরাকে আকুল করিয়া তুলিবে (৪১৮)।’
চন্ডালাদি নীচজাতীয় লোকদিগের বাসস্থান হইবে গ্রামের বাহিরে। কুকুর ও গর্দভ ব্যতীত অন্য কোন পশু তাহারা পালন করিতে পারিবে না। তাহারা ভাঙ্গা ভাঁড় মাত্র ব্যবহার করিবে, লোহার অলঙ্কার ব্যবহার করিবে, শববস্ত্র পরিধান করিবে ও লাওয়ারেস শবগুলি গ্রাম হইতে বাহির করিবে। বৈধ কর্মাদির অনুষ্ঠানকালে ইহাদের দর্শনও নিষিদ্ধ। সাধুরা ইহাদিগকে সাক্ষাৎভাবে অন্নদান করিবেন না, দরকার হইলে ভগ্নপাত্রে ভৃত্যের দ্বারা ইহাদিগকে অন্ন দেওয়া যাইতে পারে। (১০ম অধ্যায়)। ব্রাহ্মন দিবেন ২ পণ সুদ, কিন্তু ক্ষত্রিয়কে ৩ পণ, বৈশ্যকে ৪ পণ এবং শূদ্রকে ৫ পণ বৃদ্ধি দিতে হইবে (৮-১৪২)। শ্রীভগবান বলিতেছেন- শূদ্র যদি ব্রাহ্মণাদি তিন বর্ণের লোকের প্রতি কঠোর বাক্য প্রয়োগ করে, তবে ঐ শূদ্রের জিহবারচ্ছেদ করিয়া দিতে হইবে। কারণ ব্রহ্মার পদরূপ নিকৃষ্ট অঙ্গ হইতে তাহার জন্ম হইয়াছে (২৭০)। এমনকি শূদ্র যদি ব্রাহ্মণকে এই কথা বলে যে, ‘এই ধর্ম তোমার অনুষ্ঠেয়’ তাহা হইলেও রাজা তাহার মুখে ও কানে উত্তপ্ত তৈল নিক্ষেপ করিবেন (২৭২)। শূদ্র যদি উচ্চবর্ণের লোককে মারিবার জন্য হস্ত-পদাদি কোন অঙ্গ উত্তোলন মাত্র করে, তবে রাজা তাহার সে অঙ্গ কাটিয়া দিবেন (২৮০)। ব্রাহ্মণের সাথে একাসনে বসিলে শূদ্রের পাছা কাটিয়া দেওয়া হইবে (২৮১)। শূদ্র যদি ব্রাহ্মণীর অঙ্গ স্পর্শ করে, তাহা হইলে তাহার প্রাণদন্ডর ব্যবস্থা (৩৫৯)।
যে অপরাধের জন্য প্রাণদন্ডের ব্যবস্থা আছে, ইতর লোকদিগের সম্বন্ধে ঐ ন্ডেই বলবৎ থাকিবে। কিন্তু ঐ সকল অপরাধের জন্য ব্রাহ্মণের শুধু মাথা মুড়াইয়া দেওয়া হইবে-ইহা শাস্ত্রের ব্যবস্থা।’ (মোস্তফা চরিত)
অপরদিকে চরমপন্থী হিন্দুরা অন্য ধর্ম ও তার অনুসারীদের বিশেষ করে মুসলমানদের যে কতটা ঘৃণা অবজ্ঞা ও হিংসা-বিদ্বেষের নজরে দেখে তার ভূরি ভূরি নজির তাদের বই পুস্তকে রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র, পি.এন.ওক, কবি ঈশ্বর গুপ্তসহ খ্যাতনামা বহু লেখকের লেখাতেই তা বিদ্যমান।
কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন:
‘পশ্চিমে মিয়ামোল্লা, কাচাখোল্লা, তোবাতাল্লা বোলে
তেরা তেরা কাজে ভেড়া মাথা যত
নরাধম নীচ নাই নেড়াদের মত।’
‘দিল্লীর লালকেল্লা হিন্দুদের লালকোর্ট। ভারতে সমস্ত মধ্যযুগীয় কবর, মসজিদ, দূর্গ, লক্ষ্যস্তম্ভ, সেতু, পরিখা, প্রাসাদ, রাজপথ- সবই মুসলিম আগমনের পূর্বে হিন্দুদের নির্মিত। তাজমহল-হিন্দু মন্দির, ফতেহপুর সিক্রি-হিন্দুনগর, আগ্রা লালকেল্লা-হিন্দু প্রাসাদ’ বিস্মৃত ইতিহাস- পি.এন.ওক।
এ সময়ও এই হিংসা-বিদ্বেষ প্রতিদিন তাদের আচার-আচরণে, ক্রিয়া কর্মে অহরহ প্রকাশ পাচ্ছে। জ্ঞান তাপশ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লার মতো বিস্ময়কর প্রতিভাধর ব্যক্তিকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগে ভর্তি হতে দেননি হিন্দু পন্ডিত অধ্যাপকরা। অবশ্য অনেক উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মহৎ হৃদয়ের ব্যক্তিও সেখানে ছিলেন ও আছেন। কিন্তু তারা উগ্রবাদী বর্ণবাদীদের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেননি। এখনও পারছেন না। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকেও জীবন দিতে হয়েছে উগ্রবাদীদের প্রতিভূ নাথুরাম গডসের নিক্ষিপ্ত বুলেটে। এই উগ্র হিন্দুদের হিংস্রতা নতুন মাত্রা পেয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি শ্রুতিমধুর নীতিকথা শাসনতন্ত্রে যাই লেখা থাক না কেন বাস্তব অবস্থা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে ভাঙ্গা হয়েছে মসজিদ, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে নামাজে, ঈদ কোরবানিতে। বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানদের করা হয়েছে হত্যা। চালানো হয়েছে তাদের ওপর অকথ্য জুলুম নির্যাতন। গুজরাট, কাশ্মীর, আসামসহ বিভিন্ন জায়গায় এমনকি রাজধানী দিল্লীতেও সাম্প্রদায়িতা, হিংসা-বিদ্বেষ তথা উগ্র হিন্দুত্বের তান্ডব। হিন্দুত্বের পুনর্জাগরণই হচ্ছে মি. মোদির নির্বাচন বিজয়ের ও রাজনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি।
এই বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ কমবেশি অন্যান্য দেশেও আছে। এ সবের অবসান ঘটিয়ে শান্তির সমাজ, শান্তির দেশ, শান্তির পৃথিবী গড়ে তোলায় ইসলামের ভূমিকা কী সে সম্পর্কে এবার সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আসছি।
আরব তথা সমগ্র বিশ্বের যখন ঘোর দুর্দিন, সর্বত্র চলছে অত্যাচার, অবিচার, জুলুম, নির্যাতনের তান্ডব, ন্যায়-ইনসাফ, সাম্য-ভ্রাতৃত্ব যখন নির্বাসিত, দুনিয়ার এমন এক ক্রান্তিকালে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আবির্ভূত হন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি শুনালেন শান্তি ও মুক্তির পয়গাম। আমাদের জাতীয় কবির ভাষায়:
‘মানুষে মানুষের অধিকার দিল যে জন
এক আল্লাহ ছাড়া প্রভূ নাহি কহিল যে জন
মানুষের লাগি চিরদিন হীন বেশ ধরিল যে জন
বাদশা ফকীরে এক শামিল করিল যে জন
এলো ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী
ব্যাথিত মানবের ধ্যানের ছবি
আজি মাতিল বিশ্ব নিখিল তাই মুক্তির কলরোলে।’
মহাকবি শেখ সাদীর ভাষায়:
‘বালাগাল উলা বি কামালিহী- কাশাফাদ্দোজা বি জামালিহী।
হাসুনাত জামিউ খিসালিহী- সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী।’
‘সবার ঊর্ধ্বে, সবার শীর্ষে পূর্ণতায়
তিমির আঁধার বিদূরিত যার জ্যোতি- আভায়
পূত অনুপম মধুময় চারু স্বভাব যার
সালাম সালাম সে নবী এবং স্বজনে তাঁর।’
বিশ্বনবী মানুষের মনোজগতে এনেছিলেন এক মহাবিপ্লব। দুনিয়ার নিকৃষ্টতম জনগোষ্ঠিকে তিনি পরিণত করেছিলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জনগোষ্ঠিতে। দুনিয়ার নিকৃষ্ট এক সমাজকে পরিণত করেছিলেন সর্বোৎকৃষ্ট সমাজে। সাম্য-মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়-ইনসাফের সেই সমাজের নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। জুলুম-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন শান্তি ও কল্যাণের এক মহান সমাজ। ধর্মে ধর্মে, জাতিতে জাতিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, দেশে দেশে সমঝোতা ও সুসম্পর্কের বুনিয়াদ তিনি স্থাপন করে গেছেন, উপাদান তিনি রেখে গেছেন। তাই তিনি হচ্ছেন বিশ্ব মানবের পথের দিশারী। বিশ্বশান্তি স্থাপনের সর্বোত্তম আদর্শ।
বিশ্বনবী (সা.) মানুষদেরকে ঈমান ও ইসলামের দিকে দাওয়াত দিয়েছেন। ঈমান ও ইসলাম শব্দ দুটি আমন্ ও সালাম ধাতু থেকে নির্গত। এর মৌল অর্থ হলো শান্তি, নিরাপত্তা। মানব জীবনের প্রতিটি স্তরে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের সর্বস্তরে শান্তি ও নিরাপত্তার পয়গাম তিনি শুনিয়েছেন, নিশ্চয়তার বিধান তিনি করেছেন। মানবিক ঐক্যের মহাবাণী তিনি শুনিয়েছেন। ইতিহাস সাক্ষী, সৃষ্টিগতভাবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি, রক্তধারার বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যের অহঙ্কার, বর্ণগত-বংশগত ও ভাষাগত অহঙ্কার, মানবসৃষ্ট বিভেদ, বৈষম্য, মানুষে মানুষে কৃত্রিম বিভাজনই ডেকে এনেছে অনেক অশান্তি, বেজে উঠেছে রণদামামা, সংগঠিত হয়েছে অনেক যুদ্ধ ও মহাযুদ্ধ। বিধ্বস্ত হয়েছে শহর জনপদ। বয়ে গেছে কত না রক্তের দরিয়া। বিধবা, এতিম, অনাথের হাহাকারে পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস। বিষাক্ত হয়েছে আবহাওয়া। বিশ্বশান্তির মহান দিশারী বিশ্বনবী (সা.) ঘোষণা করেছেন: সৃষ্টিগতভাবে শ্রেষ্ঠত্বের এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। শুনিয়েছেন আল্লাহর মহাঘোষণা, ‘ইয়া আইয়ুহান্নাস ইন্না খালাকনা কুম মিন যাকারিউ ওয়া উনসা, ওয়া জায়ালনাকুম, শুউ বাওঁ ওয়া কাবায়িলা লি তা আ’রাফু। ইন্না আকরামাকুম ইনদাল্লাহি আতকাকুম।’ ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে একই পুরুষ ও একই নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর বিভক্ত করেছি বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ে, যাতে তোমরা একে অপরে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সম্মানী ও মর্যাদাবান যেজন অধিক মোত্তাকী ও পরহেজগার।’(ক্রমশ)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।