পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে প্রচন্ড বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল তা এখনো থামেনি। এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে শহরে, রাজ্য থেকে রাজ্যে। এমন কি সে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন মহাদেশে, বিভিন্ন দেশে। ঘটনার সূত্রপাত হয় পোর্টল্যান্ডের ওয়েতে গত ২৫ মে। সে দিন এক ঠুনকো অজুহাতে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড (৪৬) কে রাস্তায় উপুড় করে ফেলে, হাঁটু দিয়ে গলা চেপে ধরে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ জনতা ফুঁসে ওঠে ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ক্রমে এ বিক্ষোভ নিপীড়ন ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে পরিণত হয় জাতীয় আন্দোলনে। বিক্ষোভকারীরা একে একে ভাঙতে থাকে, উপড়ে ফেলতে থাকে, বিকৃত করতে থাকে অনেক খ্যাতনামা আমেরিকান নেতার ভাস্কর্য। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফার্সনের মূর্তি। টমাস জেফার্সন ১৭৪৩ সালের ১৩ এপ্রিল ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে জন্ম গ্রহণ করেন। আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন ১৮০৯ সালের ৪ মার্চ এবং মারা যান ১৮২৬ সালের ৪ জুলাই। তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের রোষের প্রধান কারণ, তিনি ৬শ’রও বেশি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে দাস বানিয়ে রেখেছিলেন। বিক্ষোভকারীরা আমেরিকার আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাত ক্রিস্টোফার কলম্বাসের একটি মূর্তিকে প্রথমে স্প্রে পেইন্ট করে বিকৃত করে, তারপর আগুন লাগিয়ে সেটিকে একটি হ্রদে নিক্ষেপ করে। এই কলম্বাসের আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে আমেরিকায় গড়ে উঠে একে একে ইউরোপীয় উপনিবেশ। ইউরোপীয়রা শুরু করে অমানবিক দাস ব্যবসা। আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের ধরে ধরে জাহাজের খোলে পুরে আমেরিকায় এনে হাটে বাজারে দাস রূপে বিক্রি করতে থাকে গরু-ছাগলের মতো। স্বাধীন মানুষ পরিণত হয় ক্রীতদাসে। মালিকরা তাদের ওপর যে পৈশাচিক নির্যাতন, নিপীড়ন চালায় তা স্মরণ করতেও শরীর শিউরে ওঠে। আফসোস, এককালে মুসলমানরা আফ্রিকায় গিয়ে সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের সভ্য বানিয়েছিল, কালের বিবর্তনে সেই সভ্য মানুষদের ক্রীতদাস বানিয়ে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি করে সভ্যতাগর্বী ইউরোপীয়রা। যাহোক, ক্রমে আমেরিকার এক বিরাট জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয় এই কৃষ্ণাঙ্গ দাসরা। তাদের ছিল না কোন নাগরিক অধিকার। ন্যূনতম মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল তারা। তাদের ভাগ্যলিপি হয়ে দাঁড়ায়, লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা, নিপীড়ন আর নির্যাতন। পশুদের চেয়েও অধম ছিল তাদের অবস্থা। শতশত বছর ধরে চলে এই জুলুম।
১৯ শতকের মধ্যভাগে এসে তাদের ভাগ্যের কিছুটা পরিবর্তন হয়। আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের আমলে। ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এক দরিদ্র ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন আব্রাহাম লিঙ্কন। অদম্য মনোবল, একান্ত নিষ্ঠা-সততা ও ক্রমাগত অধ্যবসায়ের দ্বারা তিনি পরিণত হন আমেরিকার প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিতে। ১৮৬১ সালে তিনি নির্বাচিত হন আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট। তার প্রদত্ত গেটিসবার্গ ভাষণ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। তাঁর প্রদত্ত গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ÔThe government is the people for the people by the people’ ‘গণতান্ত্রিক সরকার হলো সেই সরকার, যে সরকার জনগণেরই সরকার, জনগণের দ্বারাই নির্বাচিত সরকার এবং জনগণের জন্যই গঠিত সরকার।’ সর্বজন গৃহিত। ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি মুক্তি ঘোষণার মাধ্যমে তিনি দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘটান। এতে ৩৫ লাখ দাস মুক্ত হয়। কিন্তু বর্ণবাদীদের তা সহ্য হয়নি। ১৮৮৫ সালের গুড ফ্রাইডের রাতে ওয়াশিংটনের ফোর্ড থিয়েটারে একটি নাটক দেখে বেরুনোর সময় উইলি বুথ নামক এক ব্যক্তি তাঁকে গুলি করে। পরদিন ১৫ এপ্রিল মহান নেতা লিঙ্কন প্রাণ ত্যাগ করেন।
হালের বিক্ষোভকারীরা ১৬ শতাব্দির ঔপনিবেশিক গভর্নর নেটার স্মৃতিস্তম্ভটি অপসারণ করতে গেলে সেখানে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। বিক্ষোভকারীরা এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল হোয়াইট হাউজের দোর গোড়াতেও তখন বর্ণবাদের সমর্থক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও আতঙ্কিত হয়ে হোয়াইট হাউজের অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল।
বিক্ষোভ হোক, যুদ্ধ হোক চিরদিন তা অব্যাহত থাকে না, এক দিন না একদিন থেমে যায়ই। এ বিক্ষোভও যতই ভয়ঙ্কর হোক একদিন থেমে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে বর্ণবাদের নাপাক, ঘৃণ্য মানসিকতা থেকে পবিত্র হতে পারবে কি শ্বেতাঙ্গ জালিমরা? বর্ণবাদের নাপাক মানসিকতা যে তাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে! ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রয়েছে এর অজস্র উদাহরণ। নজির স্বরূপ এখানে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ক্লের কথা বলা যেতে পারে। আমেরিকা ভ্রমণকালে ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের স্মৃতি স্তম্ভ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। দেখেছি, সেখানে শতশত দর্শনার্থীর ভীড়। দেখেছি, তাদের আবেগ-আকুল শ্রদ্ধা নিবেদনের অপূর্ব দৃশ্য। তিনি ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী মহান নেতা। ১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ওয়াশিংটন-মিসিসিপি হাইওয়ের বিভিন্ন স্টপেজে বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে রাস্তায় অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন। ফলে ওই বছরের নভেম্বর মাসে বর্ণবৈষম্য আইন বাতিল করা হয়। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনে লিঙ্কন মেমোরিয়ালে সমবেত আড়াই লক্ষ লোকের সমাবেশে তিনি তার বিখ্যাত I have a Dream শীর্ষক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘যে মানুষ কোন উদ্দেশ্যের জন্য প্রাণ দিতে পারে না, সে মানুষ বেঁচে থাকার যোগ্য নয়’। ১৯৬৪ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন এবং পুরস্কার প্রাপ্ত ৫৪ হাজার ডলারের সবটাই আন্দোলনের জন্য দান করেন। সমগ্র দুনিয়ার শান্তিবাদী মানুষ একে অভিনন্দন জানালেও ক্ষুদ্ধ হয় বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গরা এবং ১৯৬৮ সালে হোটেলের বারান্দায় জেমস আর্ল রে নামক এক উগ্রপন্থী শ্বেতাঙ্গের গুলিতে তিনি নিহত হন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ক্লেকেও কম হেনস্থার শিকার হতে হয়নি তাঁর গাত্রবর্ণ কৃষ্ণ হওয়ার কারণে। যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা যতই থাকুক না কেন যেহেতু কালো, সাদা নয়, তাই মূল্য নেই। স্বীকৃতি নেই শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের কাছে। বিশ্ব অলিম্পিকে সোনা বিজয়ী ক্লে (১৯৬০) একটি হোটেলে চাকরি প্রার্থী হলে তার শ্বেতাঙ্গ মালিক মুখের ওপরে সাফ জানিয়ে দেয়, ‘এখানে কোন কালো আদমীর স্থান নেই। এখানে কাজ পাবে শুধু শ্বেতাঙ্গরাই’। ক্লে সহ্য করতে পারেননি এই বর্ণবাদী ঔদ্ধত্য। তাই প্রাপ্ত স্বর্ণপদক ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ওহাইয়ো নদীতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগদানের আদেশ উপেক্ষা করার জন্য ১৯৬৭ সালে তাঁর বিশ্ব হেভিয়েট চ্যাম্পিয়ান খেতাব কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর তিনি তিনবার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে পুনরুদ্ধার করেন তাঁর হারানো খেতাব এবং ১৯৭৪ সালে অর্জন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধা হওয়ার বিশ্বখেতাব।
১৮৬৩ সালে মুক্তি ঘোষণার মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ দাসরা আইনগত নাগরিক অধিকার লাভ করে বটে কিন্তু আজও পায়নি তারা শ্বেতাঙ্গদের মতো মানবিক ও সামাজিক মর্যাদা। ঘৃণা, অবজ্ঞা আর লাঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে তাদের অহরহ। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কনিষ্ঠ কন্যা শাশাকেও শিকার হতে হয়েছে বর্ণ বিদ্বেষের। জীবনঘাতী মহামারির ছোবল এবং কঠোর নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে আমেরিকায় চলছে যে প্রচন্ড বিক্ষোভ তার দ্বারা অবসান ঘটবে কি এই বৈষম্যের? পাবে কি শ্বেতাঙ্গদের মতো মানবিক ও সামাজিক মর্যাদা? মেগনাকার্টা রয়েছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ আছে, আছে বিভিন্ন আইন, আছে সংবিধান তবু কি গোত্র দিয়ে নয়, বংশ দিয়ে নয়, বর্ণ দিয়ে নয়, মানুষকে মানুষ হিসেবে তার কর্ম দিয়ে করা হচ্ছে মূল্যায়ন? এই মূল্যায়ন বাস্তবে লাভ করতে হলে যে মানসিক পরিবর্তন আনা আবশ্যক কেবলমাত্র কিতাবী বিধান দ্বারা তা কি অর্জন করা সম্ভব? বিশ্বে বিরাজমান হাল অবস্থা ও ঘটনাবলী এর সপক্ষে কি সাক্ষ্য দেয়? দেয় না, ভারতের অবস্থা ও ঘটনাবলীই তার প্রমাণ। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর যৎকিঞ্চিত আলোচনা করে ভারতের বর্ণবৈষম্য প্রসঙ্গে আসছি।
দক্ষিণ আফ্রিকা কালো আদমীদেরই। শ্বেতাঙ্গরা সেখানে বহিরাগত। স্বর্ণ, হিরকসহ মূল্যবান খনিজ সম্পদের লোভেই সেখানে উপনিবেশ গড়ে তোলে শ্বেতাঙ্গরা এবং যাদের দেশ, যাদের সম্পদ সেই সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গদের করে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অধিকারহারা। শ্বেতাঙ্গ নয় এমন বহিরাগতদেরও শিকার হতে হয়েছে হেনস্থার। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীও দীর্ঘদিন ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। অন্যান্যদের মতো তাকেও সেখানে হতে হয়েছে অপদস্ত, অপমানিত। কখনো তাকে হোটেল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, কখনো ট্রেনের ফাস্টক্লাস থেকে থার্ডক্লাসে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। শ্বেতাঙ্গ সরকার মুক্তিকামী জনতার ওপর চালিয়েছে জুলুমের স্টিম রোলার। দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রামী জননেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে বর্ণবাদী সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করা হয়েছে, গ্রেফতার এড়াবার জন্য তিনি ফেরারী ছিলেন ১৭ মাস। ধরা পড়ার পর বিচারে প্রথম তার মৃত্যুদন্ডের রায় হয়। পরে সে ন্ডোদেশ রহিত করে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদন্ড। তিনি কারাভোগ করেন একটানা ২৭ বছর। অবশেষে ঘুরে যায় ইতিহাসের চাকা। সাফল্য আসে আন্দোলনের। মুক্তি পান ম্যান্ডেলা। ১৯৯৩ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে হন প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল থাকেন। তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। (ক্রমশ)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।