পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সত্তুরের দশকের একটি জনপ্রিয় সিনেমা ছিল ‘পাগলা রাজা’। নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত সিনেমাটি সেসময় দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। নামটি ব্যতিক্রমী হওয়ায় দর্শকের মনে তা দেখার আগ্রহ জন্মায়। কেন এমন একটি নাম হলো এবং পাগলা রাজা কী করেন, এমন আকর্ষণে দর্শক সিনেমা হলে ছুটে গিয়েছিল। পাগলা রাজার ভূমিকায় নায়করাজ রাজ্জাক অভিনয় করেছিলেন। সিনেমায় পাগলা রাজাকে দেখা যায়, একজন ন্যায়বান ও প্রজা অন্তপ্রাণ শাসক হিসেবে, যিনি অন্যায় কাজ বরদাস্ত করেন না। তার সুসাশন এবং ন্যায়নীতি প্রাসাদ এবং প্রশাসনের লোকজনের পছন্দ হচ্ছিল না। ফলে তারা রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ষড়যন্ত্র শুরু করে। রাজার কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে পাগল আখ্যা দেয় এবং এক পর্যায়ে রাজা দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ছোট ভাইয়ের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সাধারণ জনগণের কাছে চলে যায়। সিনেমার গল্পের ধারাবাহিকতায় ষড়যন্ত্রকারীদের পরাজয় হলে রাজাকে পুনরায় ক্ষমতায় বসার জন্য বলা হয়। তবে তিনি তা গ্রহণ না করে সাধারণ মানুষের কাছে ফিরে যান। একজন ন্যায়নীতিবান শাসক কীভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে যান এবং সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন, তাই সিনেমাটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। সিনেমাটি মাঝে মাঝে টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। নিবন্ধে সিনেমাটির কথা উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, এ যুগেও কোনো কোনো দেশে ‘পাগলা রাজা’ দেখা যায়। তবে তারা সিনেমাটির ‘পাগলা রাজা’র মতো ন্যায়পরায়ণ এবং প্রজা অন্তপ্রাণ নন। তাদের পাগলামি এতটাই সীমাছাড়া হয়ে যায় যে, প্রজাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। নিজ দেশে তো বটেই বিশ্বজুড়ে তার বদনাম ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যদি ‘পাগলা রাজা’ বলা হয়, বোধকরি অনেকেই একমত হবেন। ক্ষমতায় আসার আগে এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ট্রাম্প এ পর্যন্ত যেসব কথাবার্তা এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা আক্ষরিক অর্থেই ‘পাগলা রাজা’র কান্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তার এসব কান্ডে নিজ দেশসহ সারাবিশ্বে তিনি সমালোচিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। একেক সময় একেক কথা বলে মানুষকে বিক্ষুদ্ধ করে চুপ মেরে থাকেন। এই যে পুলিশ কর্তৃক জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী যে প্রতিবাদ চলছে এবং তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, তার পেছনে ট্রাম্পের একটি মন্তব্যই দায়ী। ঘটনার পরপরই তিনি এক টুইট বার্তায় আন্দোলনকারীদের গুন্ডা আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘যেকোনো জটিলতা আমরা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারি, তবে যখনই লুটপাট শুরু হবে তখনই গুলি শুরু হবে। বিক্ষোভকারীরা হিংস্র অপরাধী। জর্জ ফ্লয়েডের স্মৃতির প্রতি এসব গুন্ডা অসম্মান দেখাচ্ছে, আর আমি তা হতে দিতে পারি না।’ তার অবিবেচনাপ্রসূত এমন মন্তব্যে বিক্ষোভকারীরা আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বিক্ষোভের আগুণ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ বিক্ষোভ দমাতে গুলি ছুঁড়ে, গ্রেফতার করে। তাতেও বিক্ষোভ দমানো যায়নি। বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের সীমা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভের আগুন এখনো জ্বলছে। প্রতিবাদকারীরা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ব্যানার নিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করছে। এই বিক্ষোভের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পুলিশ হাঁটুগেড়ে বসে বিক্ষোভকারীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। গত সপ্তাহে কানাডার প্রধানমন্ত্রীও সহকর্মীদের সাথে নিয়ে হাঁটুগেড়ে বিক্ষোভে সংহতি প্রকাশ করেন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এমন বিক্ষোভ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি।
দুই.
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে অপছন্দের কোনো প্রেসিডেন্ট যদি হয়ে থাকেন, তাবে সবার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামটি আসবে। নির্বাচিত হওয়ার আগে, পরে এবং এখনও সমানভাবেই অজনপ্রিয় হয়ে আছেন তিনি। এর মূল কারণ, তার অসংলগ্ন ও একেক সময় একেক কথা বলে বিতর্ক সৃষ্টি করা। ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিদরা বলেছিলেন, ট্রাম্পের মানসিক সুস্থ্যতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তাকে নির্বাচিত করে। এর কারণ কি? কারণ হচ্ছে, ট্রাম্প অভিবাসী হওয়া নাগরিকদের চেয়ে আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী স্থায়ী ও শ্বেতাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক সংস্কৃতির বিপরীত। তিনি অনেকটা একচোখা নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র বিরোধী। ট্রাম্প এই ট্রাম্প কার্ডটি খেলেই বর্ণবাদকে যেমন উস্কে দেন, তেমনি বিজয়ের পথ রচনা করেন। নির্বাচনের আগে তিনি অভিবাসীদের দেশ থেকে বের করে দেয়ার ঘোষণা এবং ‘ট্রু আমেরিকান’ শ্লোগান দিয়ে শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন। আমেরিকার কুখ্যাত বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সংগঠন কে.কে.কে বা কু ক্লাক্স ক্ল্যান তখন ট্রাম্পের এই শ্লোগান নিয়ে নেমে পড়ে। ট্রাম্প বোঝাতে সক্ষম হন আমেরিকা হবে শুধু আমেরিকানদের, এখানে বাইরের অভিবাসীদের ঠাঁই নেই। বলা যায়, বর্ণবাদবিরোধী এবং আমেরিকার বহুজাতিক অভিবাসীদের চিরন্তন নীতির মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেন। আজকের যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অভিবাসী নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি এবং যুক্তরাষ্ট্র সবধরনের মানুষের সুন্দর আবাসস্থল, এ বাস্তবতা পেছনে ঠেলে দেন। শ্বেতাঙ্গরাও তার এই নীতি লুফে নেয় এবং নিজেদের আবাসস্থল অন্যরা দখল করে নিয়ে যাচ্ছে, এমন অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত ও ইগোইজমের কারণে ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়ে দেয়। মূলত, এ কারণেই ট্রাম্প নির্বাচনে বিজয়ী হন। অথচ ইতিহাস বলে, যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিপুত্র নাগরিক বলে কেউ নেই। একমাত্র রেড ইন্ডিয়ানরাই দেশটির ভূমিপুত্র এবং প্রকৃত নাগরিক। এছাড়ার বাকি সবাই অভিবাসী। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের বংশ বিস্তারের ইতিহাস যদি ঘাটা হয়, তবে দেখা যাবে তাদের কয়েক পুরুষ আগের প্রজন্মও এদেশে অভিবাসী হয়ে এসেছে। এমনকি ট্রাম্পের পূর্ব পুরুষরাও ইউরোপ থেকে এসে যুক্তরাষ্ট্রে বসতি গড়ে তুলেছে। ইতিহাসবিদরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মূলত একটি ‘আউট ল’ বা বনবাসীদের দেশ। ইউরোপের অপরাধীদের সাজা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া বা বনবাসে দেয়া হতো। অর্থাৎ অপরাধী ও সাজাপ্রাপ্ত লোকজনের মাধ্যমেই আমেরিকা গড়ে ওঠে। এর সাথে কৃতদাস হিসেবে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকে কালো মানুষদের এখানে নিয়ে আসা হয় এবং তাদেরকে বাজারে বিক্রি করা হতো। তাদের সাথে পশুর মতো আচরণ করা হতো। অ্যালেক্স হেলির বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য রুটস’-এ এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পাওয়া যায়। আব্রাহাম লিংকন এসে আমেরিকার বর্ণবাদের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নেন। ধীরে ধীরে কালোদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যেমন চলতে থাকে, তেমনি তাদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙা লাগলেও তা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এই যে, জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকে কেন্দ্র করে যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন চলছে, তা সভ্যতারই বহিঃপ্রকাশ। এ আন্দোলন ও বিক্ষোভ ধীরে ধীরে হয়তো কমে আসবে, তবে তা ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে। আর বর্ণবাদকে উস্কে দেয়ার নেপথ্যচারী হিসেবে ইতিহাসে ট্রাম্পের নামটি যে লেখা থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই। আগামী নভেম্বরে শুরু হতে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হবেন কিনা, তা নিয়ে এখন সন্দেহ করা যেতেই পারে। কারণ বছরের শুরুতেও ধরে নেয়া হয়েছিল, আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পের জেতার সম্ভাবনাই বেশি। তবে বর্ণবাদকে উস্কে দেয়া এবং চলমান বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রটিকে যে কিছুটা হলেও টালমাটাল করে দিয়েছে, তা বলা যায়। গত সপ্তাহে নিউজ উইক পত্রিকার করা সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের প্রতিদ্ব›দ্বী ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন ৫০ শতাংশেরও বেশি ভোটারের মতামতে এগিয়ে আছেন। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের জরিপ এখন আর যথাযথ ফল দেয় না। কারণ গত নির্বাচনের শেষ মুহূর্তের জরিপেও হিলারি ক্লিন্টন ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ফলে জরিপের ফলাফল যে সবসময় সঠিক চিত্র দেয়, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অবশ্য অতীতে দেশটির অধিকাংশ জরিপের ফলাফল সঠিক হয়েছিল। ট্রাম্পের ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে। এর পেছনে যে তার অভিবাসীবিরোধী ও বর্ণবাদী নীতি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আগামী নির্বাচনে যদি ট্রাম্পের এই বর্ণবাদী নীতির ধারাবাহিকতা আমেরিকানরা ধরে রাখে, তবে ট্রাম্পের পুনরায় বিজয়ী হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তবে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকানদের যে বিক্ষোভ দেখা গেছে, তাতে ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়া বেশ কঠিন। এদিকে ট্রাম্পকে পুনরায় প্রার্থী করা করার ক্ষেত্রে তার দল রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেই দ্বিমত দেখা দিয়েছে। দলটির সদস্য ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিও বুশ এবং সিনেটর মিট রোমনি ট্রাম্পকে পুনর্নিবাচিত করার পক্ষে নন। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে আমেরিকানদের মনোভাবের পরিবর্তনের ওপর। তারা এই ‘পাগলা রাজা’কে ক্ষমতায় রাখবেন, নাকি তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন, এ সিদ্ধান্ত তাদেরই নিতে হবে।
তিন.
জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী যে ঝড় উঠেছে দুখের বিষয় হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত মুসলমানরা যে হত্যা-নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা নিয়ে এমন প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না। এটা বর্ণবাদের চেয়েও ভয়ংকর। কারণ এর মাধ্যমে প্রচ্ছন্নভাবে স্থানভেদে মুসলামনদের নির্মূল করার একটি প্রক্রিয়া। সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লিবিয়া, মিয়ানমার, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা যেভাবে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা মুসলমান নির্মূলেরই অংশ। এ নিয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো টুঁ শব্দ পর্যন্ত করছে না। বর্ণবাদ বা কালোদের নির্যাতন নিয়ে যেভাবে দেশগুলো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং করছে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। ‘এটা ঠিক হচ্ছে না’ বলে জাতিসংঘসহ কোনো কোনো দেশ বড়জোর একটি বিবৃতি দেয়। তাদের এই ‘লিপ সার্ভিস’কে মুসলমান নির্যাতনকারি দেশগুলো খুব একটা আমলে নেয় না। এই যে করোনা মহামারীর আগে ভারত নাগরিকত্ব বিলসহ নানা নীতি নিয়ে যেভাবে মুসলমানদের দেশছাড়া করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, তা করোনাকালেও চলমান রয়েছে। দেশটিতে করোনার শুরুতেই এর বিস্তারের জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়। মুসলমানরাই নাকি করোনা বিস্তার করেছে। এমন হাস্যকর দোষ চাপিয়ে মুসলমানদের নির্যাতন ও হেয়প্রতিপন্ন করছে। এ নিয়ে প্রভাবশালী দেশগুলো কোনো ধরনের প্রতিবাদ করেনি। জাতিসংঘ থেকে লিপ সার্ভিসের মতো একটি বক্তব্য দিয়ে দায় সারা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা নিয়ে যে প্রতিবাদ হয়েছে, মুসলমানদের মধ্যেও এমন অসংখ্য জর্জ ফ্লয়েড রয়েছে যাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এক জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকান্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের যে আগুন জ্বলছে, নির্বিচারে মুসলমান হত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে যদি এমন প্রতিবাদ হতো, তাহলে নিপীড়ন-নির্যাতনকারীরা হুশিয়ার হয়ে যেত। মুসলমানদের হত্যা-নির্যাতনের মতো জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার শিকার হতে হতো না। এক মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ইতিহাসের যে বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে যদি বিশ্বব্যাপী সরকার প্রধানসহ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদের মতো হাঁটুগেড়ে প্রতিবাদ করত, তাহলে কি শত শত মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করার মতো সাহস মিয়ানমারের হতো? কালো হোক, সাদা হোক কিংবা অন্য কোনো ধর্মের হোক, সবই বর্ণবাদ এবং তা মানবতাবিরোধী, এ বিষয়টি কি তারা ভুলে গেছে? এই যে ফ্লয়েড হত্যা হলো, তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক মুসলমান, সরাসরি কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদে সরব হয়েছে। ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদকারীরা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ব্যানার নিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করছে। ভারতের মুসলমানদের মধ্যেও এর প্রতিক্রিয়া পড়েছে। সেখানেও গত সপ্তাহে মুসলমানরা ‘মুসলিম লাইভস ম্যাটার’ নিয়ে প্রতিবাদ করেছে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ শ্লোগানের সাথে প্রতিবাদকারীরা যদি ‘মুসলিম লাইভস ম্যাটার’ ব্যানারটি নিয়েও দাঁড়িয়ে যেত, তাহলে বর্ণবাদবিরোধী প্রতিবাদটি আরও মানবিক এবং সাম্যের প্রতীক হয়ে উঠত। কারণ, বিশ্বব্যাপী মুসলমান হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়টি চলমান। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, যখন ফ্লয়েড হত্যাকান্ড হয়েছে, একই সময়ে কোথাও না কোথাও মুসলমান নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ভারত, মিয়ানমার, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, সিরিয়াসহ অন্যদেশগুলোতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। ফলে এ নিয়ে প্রতিবাদ হলে নির্যাতনকারীদের বুক কেঁপে উঠত। যে কাউকে নির্যাতন করার আগে তাদের দুইবার চিন্তা করতে হতো। কারণ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল হত্যা ও নির্যাতনই মানবতাবিরোধী অপরাধ। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ফ্লয়েড হত্যাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে আসামী বা অভিযুক্তকে ধরা ও গ্রেফতার করার সময় মাটিতে শুইয়ে ঘাড়ে পুলিশের হাঁটু চেপে ধরার বিষয়টি বন্ধ করা হচ্ছে। এমনকি ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে যখন তখন পুলিশের হস্তক্ষেপের বিষয়টিও নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করলে তার সুফল পাওয়া যায়। বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ওপর যে নির্যাতন ও হত্যাকান্ড চলছে, তার বিরুদ্ধে যদি এমন প্রতিবাদ করা হয়, তবে নিশ্চয়ই নির্যাতনকারীরা তা বন্ধ করতে বাধ্য হবে।
চার.
বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতি যেসব দেশ নিয়ন্ত্রণ করে, সেসব দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের ন্যায়-নীতির প্রতীক হওয়া উচিত। পাগলা রাজা বা যুদ্ধবাজ হলে, তা বিশ্বের জন্য অমঙ্গল বৈ মঙ্গল বয়ে আনে না, আনবেও না। যুক্তরাষ্ট্রে এক কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লয়েড হত্যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে প্রতিবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে, তদ্রুপ অসংখ্য মুসলমান হত্যা ও নির্যাতন নিয়ে এমন প্রতিবাদ হওয়া উচিত। বিশ্বে দেশ অনুযায়ী প্রত্যেকে নাগরিকেরই বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। এক ধর্ম বা বর্ণের মানুষকে নির্মূল করে অন্যদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার মতো পদক্ষেপ কোনোভাবেই মানবতার পরিচায়ক নয়। করোনা মানবজাতির শত্রু হলেও, এটি বুঝিয়ে দিয়েছে, তার ক্ষেত্রে কে ক্ষমতাধর আর কে ক্ষমতাহীন তার কোনো বাছবিচার নেই। ধর্ম, বর্ণ, ক্ষমতাশালী নির্বিশেষে প্রত্যেককেই তার কাছে সমান। সুরম্য অট্টালিকা কিংবা সুরক্ষিত পরিবেশে থেকেও এ থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং বর্ণবাদের প্রতিবাদকারী কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও করোনার কবল থেকে রক্ষা পাননি। তারাও আক্রান্ত হয়েছিলেন। পাগলা রাজা হিসেবে খ্যাত ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা থেকে বাঁচার জন্য নিয়মিত ওষুধ সেবন করছেন। তিনিও জানেন, এ কোনো মুসলমান জনগোষ্ঠী নয় যে, চাইলেই মিসাইল দিয়ে মেরে ফেলা যায় এবং এর কোনো জবাব দিতে হয় না। তবে এক ফ্লয়েড হত্যাকান্ড নিয়ে তাকে জবাব দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি পুনরায় ক্ষমতায় আসার বিষয়টিও অনিশ্চিত করে দিয়েছে। কাজেই বিশ্বের ক্ষমতাধরদের চিন্তা করতে হবে, কোনো অপরাধ করেই যেমন পার পাওয়া যায় না, তেমনি যারা মুসলমান নির্যাতন ও হত্যা করছে, তারাও পার পাবে না। আজ হোক, কাল হোক, এর জোরালো প্রতিবাদ ও প্রতিকার হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।