পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিস্ট্যাটল বলেছিলেন, ‘ইট ইজ ডিউরিং আওয়ার ডার্কেস্ট মোমেন্টস দ্যাট উই মাস্ট ফোকাস টু সি দ্য লাইট’। সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে আলোর প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়ার এই প্রবণতা চিরন্তন। আমরা কি এখন তেমনই এক অন্ধকার সময় অতিক্রম করছি, যখন আমরা একটি সম্ভাব্য আলোর জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি? বিশ্বে মহামারীর ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। মানব সভ্যতার উত্থান পতনের ইতিহাসের সাথে বহু শতাব্দীর অসংখ্য মহামারীর ইতিহাসের নিবিড় সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। তবে গত ৫ শতাব্দী ধরে প্রতি শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষে এসে এমন মহামারীর সম্মুখীন হচ্ছে মানব সভ্যতা। ১৯২০ সালে স্পেনিশ ফ্লুতে ইউরোপের কয়েক কোটি মানুষের মৃত্যুর চরম বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বকে একচ্ছত্র পুঁজিবাদি লুন্ঠন ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের লৌহ গরাদের নিচে আবদ্ধ করার নতুন রূপরেখা অঙ্কিত হয়েছিল। প্রথম বলকান যুদ্ধের পর বৃটিশ, ফরাসী ও ইতালীয়দের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম প্রধান দেশগুলোর উপর। আটশ’ বছরের উসমানীয় খেলাফত ভেঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রের উপর ভূ-রাজনৈতিক ভাগাভাগির নিকৃষ্ট নীলনকশা প্রথম মহাযুদ্ধের ফলাফলের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এর একদিকে ছিল সাইক্স-পাইকটের ভাগাভাগির চুক্তি, অন্যদিকে পবিত্র নগরী জেরুজালেমসহ আরবদের ভূমি দখল করে ইহুদিদের জন্য হোমল্যান্ড প্রতিষ্ঠায় লর্ড বালফোরের সেই কুখ্যাত ডিক্লারেশন। ১৯১৬ সালের সাইক্স-পাইকট চুক্তি এবং ১৯১৭ সালের বালফোর ডিক্লারেশনের মধ্য দিয়ে পরবর্তি বিশ্বব্যবস্থার গতি প্রকৃতি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও তুরস্কের নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের পরিবর্তনের যে নতুন গাইডলাইন প্রস্তুত করা হয়েছিল, ১৯১৭ সালে ভøাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব বা কোটি মানুষের প্রাণ হরণকারী মহামারী স্পেনিশ ফ্লু’র কারণে তার গতিপ্রকৃতি খুব একটা ব্যাহত হয়নি। ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া স্পেনিশ ফ্লুতে প্রায় ৬ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা যায়। এর আগে ১৮২০ সালে কলেরায় ইউরোপে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, এর একশ বছর আগে ১৭২০ সালে বুবনিক প্লেগে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ১৬১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ডে আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শতকরা ৩০ থেকে ৯০ ভাগ জনসংখ্যার অবলুপ্তি ঘটেছিল বলে জানা যায়। এই মহামারীর কারণে সেখানে ঔপনিবেশিক শক্তি সুসংহত করতে বৃটিশদের জন্য সহজতর হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়। শত বছর পর পর নতুন নতুন রোগ-ব্যাধির একেকটি মহামারী বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্দশার বার্তা বয়ে আনলেও বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে তা ইতিবাচক পরিবর্তনের কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি। তবে এসব মহামারীর কোনো কোনোটি স¤্রাট, রাজা-মহারাজা, সামন্তবাদি ও ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য নতুন রাজ্য দখল ও বিদ্রোহ দমনে এসব মহামারী আর্শিবাদ হয়ে দেখা দিয়েছে।
একবিংশ শতকের তৃতীয় দশক শুরুর আগে বিংশ শতকে সংঘটিত দু’টি মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল ইতিমধ্যে তা শিথিল ও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আর স্থিতিশীল নেই। ফিলিস্তিনী ভূ-খন্ডে প্রতিষ্ঠিত ইহুদি জায়নবাদি রাষ্ট্রটি গত ৭০ বছরেও সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে প্রতিবেশিদের কাছে এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেনি। এ বিষয়ে রাজনৈতিক পন্থা অবলম্বনের কোনো চেষ্টাই তারা করেনি। উপরন্তু যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর ভর করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে সব শক্তির বশংবদ লাঠিয়ালের ভূমিকা নিয়ে জায়নবাদী রাষ্ট্রটি শুরু থেকে বিরতিহীনভাবে হেজিমনিক ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে। এবারের কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যবস্থায় যে ওলটপালটের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তাতে পশ্চিমা সাম্প্রজ্যবাদের পুরনো পরিকল্পনাগুলো বানচাল হওয়ার মধ্য দিয়ে এশীয় সভ্যতার পুনরুত্থানের পথে আরো একধাপ অগ্রগতির পথরেখা দেখা যাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর গন্তব্য এখনো অনিশ্চিত। বিশ্বের সব দেশ ও অঞ্চলে এই ভাইরাস তার কালোছায়া বিস্তার করেছে। বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে আর কোনো মহামারীকে এতটা সর্বত্রগামী হয়ে উঠতে দেখা যায়নি। এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ চীন থেকে এই ভাইরাসের সূত্রপাত ঘটলেও দেড়শ কোটি মানুষের দেশ চীনই সফলভাবে এই ভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে। এই মুহূর্তে করোনা পেন্ডেমিকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় চীনের অবস্থান ১০ নম্বরেরও নিচে। অন্যদিকে বিশ্বের এক নম্বর সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি, পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের পীঠস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। চীনের মহামারি শুরু হওয়ার পর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের জন্য সর্তকতা জারি করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তা পাত্তা না দিয়ে অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্রæত মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পর তার অনেকটা বায়ুগ্রস্থ অবস্থা দেখা গেছে। মহামারীর বিরুদ্ধে যথাসময়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে মার্কিন প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে লাখো মার্কিনীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। মার্কিন অর্থনীতি দেউলিয়া, ঋণগ্রস্ত এবং অচল হয়ে পড়েছে। মাত্র তিনমাসের করোনাভাইরাস মহামারীতে লকডাউনের কারণে মাত্র তিনমাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে তিনকোটি মানুষ বেকার হয়ে রাষ্ট্রীয় বেকার ভাতার জন্য লাইন ধরেছে। এ পর্যন্ত বিচার করলে দেখা যাবে, করোনাভাইরাস মহামারী মার্কিন অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের জন্য অশনি সঙ্কেত হয়ে দেখা দিয়েছে।
চলমান কোভিড-১৯ পেন্ডেমিক প্রত্যেক দেশের সমৃদ্ধি, সাফল্য ও নেতৃত্বের এক সার্বজনীন মানদন্ড হিসেবে উঠে এসেছে। কোন দেশ কিভাবে এই মহামারী মোকাবেলা করছে, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা কি, তার উপর বিচার করে আগামী দিনে এই মানদন্ড বিচার করা হবে। তবে এটা ইতিমধ্যে পরিষ্কার যে, কোভিড-১৯ মহামারীর এই বৈশ্বিক দুর্যোগে তেমন কোনো সমন্বিত আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেই বললেই চলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্ভবত এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক দুর্যোগ। এই দুর্যোগে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি বড় ধরনের ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি করেছে। অকল্পনীয় ধ্বংসক্ষমতা সম্পন্ন হাজার হাজার পারমানবিক বোমা ও সুপারসনিক মহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্রের ভান্ডার নিয়ে গর্বদ্ধোত্ত নেতারা কেউই বিশ্বনেতা হয়ে উঠতে পারেনি। বেশ কিছু সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় চীনের শি জিন পিংয়ের মধ্যে তেমন একটা সম্ভাবনা এখনো দেখা গেলেও তা যেন হাতছাড়া হতে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টিন চার্চিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান, ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্য গল, সোভিয়েত নেতা যোসেফ স্টালিনের মত নেতাদের সাথে তুলনা করলে এসব দেশের বর্তমান নেতাদের অবস্থান অনেকটা ¤øান এবং দুর্বল। এই মহামারীতে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিপোলার বিশ্বের নেতৃত্বে থাকা ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদি শক্তির নড়বড়ে অবস্থা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। এ সময়ে যে নেতা মহামারীর ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় একদেশদর্শী চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে সার্বজনীন কল্যাণের লক্ষ্যে ভূমিকা পালন করবে, তিনিই আগামী দিনে চার্চিল, ট্রুম্যান বা স্টালিনের মত বিজয়ী বীর হিসেবে স্মরণীয় হবেন। ইউরোপের অজেয় শক্তি হিটলারের নাৎসী বাহিনী একের পর এক দেশ দখলের মধ্য দিয়ে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের আশঙ্কার মধ্যেও অসম সাহস, প্রজ্ঞা, মেধা ও বিচক্ষণতায় বিশ্বনেতা হিসেবে চার্চিলের ভূমিকার সাথে আজকের বরিস জনসন, শি জিন পিং বা ডোনাল্ড ট্রাস্পের কোনো তুলনাই চলেনা। বৈশ্বিক মহাদুর্যোগের সময় মহৎ নেতৃত্বের জন্ম হয়। মহাযুদ্ধের চরম ধ্বংসযজ্ঞের ক্রান্তিকালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের একেকটি বক্তৃতা সৈনিক ও নাগরিকদের জন্য অনুপ্রেরণার শক্তি হয়ে উঠত। ১৯৪২ সালের নভেম্বরে এ অনিশ্চিত অন্ধকার সময়ে যখন যুদ্ধের মোড় মিত্রশক্তির অনুকুলে ঘুরতে শুরু করেছিল, তখন চার্চিল এক বেতার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘দিস ইজ নট দ্য এন্ড। ইট ইজ নট ইভেন দ্য বিগেনিং অব দ্য এন্ড। বাট ইট ইজ পারহ্যাপ্স, দি এন্ড অব দ্য বিগেনিং’। চার্চিলের এমন মেটাফরিক্যাল বক্তব্যগুলো এখনো কূটনৈতিক ভাষার সম্পদ হিসেবে উচ্চারিত হয়। করোনা পেন্ডেমিকের প্রভাবে বিশ্বব্যবস্থায় যে সম্ভাব্য পরিবর্তনের প্রত্যাশা জেগে উঠেছে তা, সম্ভবত: চার্চিলের কথিত ‘শেষের শুরু’র এখন যবনিকাপাত ঘটতে চলেছে।
গত তিন হাজার বছর ধরে একেকটি রোগব্যাধির মহামারি বিশ্ব সভ্যতায় ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে উঠতে দেখা গেছে। খৃষ্টীয় পঞ্চম শতকে পলিপনেশিয়ার যুদ্ধে স্পার্টার সাথে এথেনীয়দের পতনের মূল কারণ ছিল টাইফয়েড মহামারী। এথেন্সের দেয়ালের বাইরে স্পার্টার সেনাবাহিনী ঘেরাও করে রেখেছিল, এমন সময় এক অদ্ভুত রোগে এথেন্সের জনসংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যুবরণ করার পর স্পার্টার বাহিনী সহজেই এথেন্স দখল করে নেয়। এর দুই হাজার বছর পর ১৫২০ সালে স্পেনিশদের হাতে দক্ষিণ আমেরিকায় মায়া ও ইনকা (এজটেক) সভ্যতার পতন ঘটে স্মলপক্স মহামারীর কারণে। পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন প্রথম হিস্পানিওলা দ্বীপে পা রাখেন তখন তাকে আদিবাসী তাইনো জাতিগোষ্ঠীর ৬০ হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মূলত মহামারীর কারণে ১৫৪৮ সাল নাগাদ তাইনো জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫০০’র নিচে। গত বছর প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের মধ্যে সাড়ে ৬ কোটির বেশি আমেরিকান আদিবাসীর মৃত্যু হয়। মহামারীর এই মৃত্যু দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকায় ইউরোপীয়দের উপনিবেশিক শাসনকে সুসংহত করতে সহায়ক হয়। তবে সে সব মহামারী সম্পর্কে তখন বা পরবর্তী কখনো রাজনৈতিক বেøম গেমের বিষয় হয়ে উঠেনি। আজকে ইউরোপের জনসংখ্যার ঘনত্ব এশীয় দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম হওয়ার পেছনে সম্ভবত দেড়শ’ বছরে বেশ কয়েকটি প্লেগ এবং কলেরা মহামারীর দায় রয়েছে। বিগত শতকের প্রথম দিকে বৃটিশ সৈনিকদের মাধ্যমে ভারতসহ এশিয়ার ঔপনিবেশিক দেশগুলোতেও কলেরা মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিল। কলেরায় হাজার হাজার মানুষের করুণ মৃত্যু এবং দুর্ভীক্ষের কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে বৃটিশদের উপনিবেশ সরাতে হয়েছিল। এবারের করোনা মহামারীর শুরু থেকে এ নিয়ে বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে এক প্রকার দোষারোপের রাজনীতি দেখা যাচ্ছে। এই প্রথম একটি বৈশ্বিক মহামারীর জন্য দায়ী ভাইরাসকে ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট বলে সরাসরি অভিযোগ তোলা হয়েছে। অবশ্য চীনের ওহানের বায়োলজিক্যাল ল্যাব থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করছেন, তার সপক্ষে কোনো তথ্য-প্রমান এখনো দেখা যায়নি। খোদ মার্কিন গোয়েন্দা দফতর ও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ এন্থনি ফাউসি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। সমগ্র বিশ্বের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারি এমন মহামারীর কারণ ও অভিযোগগুলোর সুরাহার দাবি ক্রমে জোরালো হয়ে উঠেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হয়তো এ নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান চালাতে হবে।
প্রতিটা পেন্ডেমিক এবং মানবিক দুর্যোগেরই একদিকে প্রধান ভিকটিম এবং একটা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী থাকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মুসলমানদের কোনো দায় না থাকলেও এসব যুদ্ধে বিশ্বমুসলিমের অপুরনীয় ক্ষতি হয়েছে। মুসলমানদের ঐক্য ও কেন্দ্রীয় শক্তিকে তছনছ করে দিয়ে বিভক্তি ও জাতিগত বিদ্বেষের বীজ বপণ করা হয়েছে। অন্যদিকে হলোকস্টের মিথ ব্যবহার করে ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা নিয়েছিল তার টার্গেটও ছিল মুসলমানরা। আরব মুসলমানদের ভূমি দখল করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের জন্য নাকবা বা বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়। এ সপ্তাহে করোনা মহামারীতেও ফিলিস্তিনীরা ৭২তম নাকবা দিবস পালন করেছে। অন্যদিকে প্রাণঘাতী মহামারী বিশ্বের বেশিরভাগ আঞ্চলিক-জাতিগত সংঘাত থেমে গেলেও ইসরাইলের নতুন কোয়ালিশন সরকার পশ্চিম তীর, জর্ডান উপত্যকাসহ ফিলিস্তিনি ভূ-খÐগুলো নতুন করে ইসরাইলের পূর্ণ দখলে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের পেছনে চীন বা আমেরিকার বায়োলজিক্যাল ওয়েপন প্রকল্পের কোনো ভূমিকা আছে কি না সে প্রশ্নে প্রবেশের আগেই ইতিমধ্যে এই ভাইরাসের পেন্ডেমিকে সরাসরি আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি নানাবিধ গুজব, প্রপাগান্ডা ও ট্যাবুর আশ্রয় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মুসলমানরা জাতিগত সহিংসতার শিকার হতে শুরু করেছে। প্রথম মহাযুদ্ধ এবং স্পেনিশ ফ্লু মহামারীর পর যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল শতবছর পূর্তির আগেই তা নানাবিধ চ্যালেঞ্জ ও হুমকির মুখে পড়ার আগেই সা¤্রাজ্যবাদী হেজিমনি টিকিয়ে রাখতে নতুন নীলনকশার প্রয়োজন ছিল। ইসলামোফোবিয়া, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধ এবং তথাকথিত ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির মধ্য দিয়ে আলআকসা মসজিদ কমপ্লেক্সসহ পুরো ফিলিস্তিনকে জায়নবাদি ইহুদিদের হাতে ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা সে নীলনকশার মূল অংশ। হঠাৎ করেই ডিল অব দ্য সেঞ্চরির আবির্ভাব ঘটেনি। এর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র নামে মুসলিম বিশ্বের উপর অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি, একের পর এক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র দখল। আলকায়েদা, আইএস’র মত গোষ্ঠীর সৃষ্টি এবং জাতিগত ও আঞ্চলিক সংঘাতের পেছনে ইন্ধন দেয়া সে পরিকল্পনারই অংশ। ইতিমধ্যে গত এক দশকে বিশ্বরাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মেরুকরণ ঘটে গেছে। আর তা হচ্ছে, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীদের সাথে এক সময়ের জোট নিরপেক্ষ শক্তি ভারতের কৌশলগত নতুন গাঁটছড়া বাঁধা, তারই সাথে জায়নবাদী ইসরাইলের সাথে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের পুরনো গোপণ সমঝোতা প্রকাশ্য প্রণয়ে পরিনত হওয়া। নরেন্দ্র মোদিই হচ্ছেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি রাষ্ট্রীয় সফরে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইল সফর করেছেন। ২০১৭ সালে মোদির ইসরাইল সফরের সময় ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছিলেন, (ম্যারেজ মেড ইন হ্যাভেন) ভারতের সাথে ইসরাইলের স্বর্গে বিয়ে হয়েছিল। কি সাংঘাতিক কথা! এরপর থেকেই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির ফিলিস্তিনের পরিণতি লাভ করতে শুরু করে। আজকের করোনা মহামারী আক্রান্ত বিশ্ব যখন অতীতের সব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় নতুন বাস্তবতার আলোক ফেলতে চাচ্ছে, তখন ফিলিস্তিন ও কাশ্মিরের মুসলমানদের উপর নিপীড়ন ও জবরদখলের মাত্রা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। করোনা মহামারী পরবর্তি বিশ্বব্যবস্থায় মুসলমানরা এর শেষ দেখতে চাইবে। ইতিমধ্যে আরবলীগ, ওআইসিসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা হিন্দুত্ববাদী ভারত এবং জায়নবাদী ইসরাইলের এমন বেআইনী, অমানবিক-ন্যাক্কারজনক তৎপরতার নিন্দা জানিয়েছে। মহামারীর এই সঙ্কটকালে আমরা অ্যারিস্ট্যাটলের সেই বানীকেই স্মরণ করতে চাই, তিনি বলেছিলেন, ‘ইট ইজ ডিউরিং আওয়ার ডার্কেস্ট মোমেন্টস দ্যাট উই মাস্ট ফোকাস টু সি দ্য লাইট’। আগামীর বিশ্ব এশিয়ার। মুসলমান এবং শান্তির সপক্ষ শক্তির।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।