শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মুসলামানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন নওয়াব আব্দুল লতিফ (১৮২৬-১৮৯৩ খ্রি.)। তিনি আই.সি.এস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) ছিলেন না। নওয়াব আব্দুল লতিফ ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার কলরোয়াতে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন।
১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা মে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন হতে শুরু করে। ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুন কলকাতায় হিন্দু কলেজের নাম পরিবর্তন হয়ে প্রেসিডিন্সী কলেজ নাম করণ করেন নবাব আব্দুল লতীফ (১৮২৬-১৮৯৩ খ্রি.)।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষা গৃহীত হয়। সারা বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যবস্থা চালু হয়।
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল (৫-১০) মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম বি.এ পরীক্ষার সূত্রপাত হয়। ১৩ জন বি.এ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১০ জন ছাত্র ৬টি বিষয়ে তাঁদের পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। কিন্তু এরা সবাই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। এই অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীদের তালিকায় ছিলেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও যদুনাথ বসু। ৫টি বিষয়ে এই দু’জন কৃতিত্বের পরিচয় দিলেও ষষ্ঠতম বিষয়টিতে তাঁরা উভয়েই অকৃতকার্য হন। এই ষষ্ঠতম বিষয়টি ছিল “মেন্টাল অফ মোরাল সাইন্স (নীতি বিজ্ঞান)। তাঁরা এই বিষয়টিতে উভয়েই ৭ নম্বর পরীক্ষায় পাশের চেয়ে কম নম্বর পেয়ে ফেল করেছিলেন। পরবর্তীতে এই বিষয়ে ৭ নম্বর গ্রেস মার্ক দিয়ে উভয়কেই পরীক্ষায় পাশ করে দেয়া হয়। পরীক্ষক কমিটির সুপারিশ ক্রমে শেষ পর্যন্ত বঙ্কিম চন্দ্র ও যদুনাথ বসু দ্বিতীয় বিভাগে উর্ত্তীণ হয়ে অধুনালুপ্ত পাক ভারত উপমহাদেশে প্রথম বি.এ ডিগ্রী লাভের বিরল সম্মানে ভূষিত হন। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই মর্মে উপনীত হন যে ভবিষ্যতে আর কখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাউকেই গ্রেস মার্ক দেওয়া হবে না। বঙ্কিম চন্দ্র ও যদু নাথ বসু উভয়েই কর্মজীবনে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউই ইন্ডিয়ান আই.সি.এস ছিলেন না। মুসলামানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন নওয়াব আব্দুল লতিফ (১৮২৬-১৮৯৩ খ্রি.)। তিনি আই.সি.এস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) ছিলেন না। নওয়াব আব্দুল লতিফ ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান সাতক্ষীরা জেলার কলরোয়াতে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন।
১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড মেকলের প্রচেষ্ঠায় চাকুরী ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষা প্রথার প্রবর্তন হয়। এই সময় কিছু কিছু বাঙালি ছাত্র উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে গমন করে এবং সেখানকার শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে অবগত হয়। তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রতিযোগীতামূলক “ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (ওঈঝ)” এ উর্ত্তীণ হয়ে শাসন কার্যে শরীক হওয়ার জন্য উৎসাহ বোধ করতে থাকে।
১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সতেন্দ্রনাথ ঠাকুর (বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ) বিলেত থেকে প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আরও ৩জন ভারতীয় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, রমেশচন্দ্র দত্ত ও বিহারী লাল গুপ্ত বিলেত থেকে এই আই.সি.এস পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। ভারতীয়দের এই সাফল্য ইংল্যান্ডে দারুন সারা পড়ে যায় এবং ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১২ জন ভারতীয় আই.সি.এস পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন।
সতেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩ খ্রি.) লেখক, সাহিত্যিক ও প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ন। ১৮৪২ সালের ১লা জুন কলকাতার জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র, তাঁর মাতা ছিলেন সারদা দেবী। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই।
সতেন্দ্রনাথ নিজ গৃহে ইংরেজী ও সংস্কৃতি ভাষা শেখেন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হিন্দু স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি যশোরের জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সঙ্গে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন এবং সুরেন্দ্র নাথ ও ইন্দিরা দেবী চৌধূরানী নামে দুই কৃতী সন্তানের জনক হন।
কলেজ জীবনেই সতেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে কেশব চন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণ নগরে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সস্ত্রীক লন্ডনে যান এবং ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে আই.সি.এস হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আহমেদাবাদের এ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর ও ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে তিনি কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন। তাঁর পেশাগত জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে পশ্চিম ভারতে (সাবেক বোম্বাই প্রদেশে) এবং শেষ পর্যায়ে সাতারা জেলার সেশন জজের পদ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯০১ ও ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ এর সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে আদি ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য ও ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে জেষ্ঠা ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে আচার্য ও সভাপতি নিযুক্ত হন।
সতেন্দ্রনাথ ঠাকুর ০৯টি বাংলা ও ০৩টি ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেন। সে সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- সুশীলা ও বীর সিংহ নাটক (১৮৬৭ খ্রি.), বোম্বাই চিত্র (১৮৮৮ খ্রি.), নবরত্ন মেলা, স্ত্রী স্বাধীনতা, বৌদ্ধধর্ম (১৯০১ খ্রি.), আমার বাল্য কথা ও বোম্বাই প্রবাস (১৯১৫ খ্রি.) ভারতবর্ষীয় ইংরেজ (১৯০৮ খ্রি.), রাজা রাম মোহন রায় ইত্যাদি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। এছাড়াও তাঁর রচিত তিলকের ভগবত গীতা ভাষ্য, কালিদাস এর মেঘদূত এবং তুকারাম অভঙ্গের অনুবাদ সর্বশেষ উল্লেখ যোগ্য গ্রন্থ । তিনি বেশ কিছু ব্রহ্ম সঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান ও রচনা করেন এবং কিছু কাল তত্ত্ব বোধনী পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯ খ্রি.) বিলেত থেকে ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আই.সি.এস পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯ খ্রি.) কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ফাষ্ট আটর্স (এফ.এ) পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে রমেশ চন্দ্র দত্ত, সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী ও বিহারী লাল গুপ্তের সঙ্গে একত্রে ইংল্যান্ডে যান এবং এই তিনজনই একত্রে ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আই.সি.এস পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন ইংল্যান্ড থেকে।
রমেশচন্দ্র দত্ত উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, রাজনীতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাবিদ এবং সুপন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। কলকাতার রামনগরের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ আগষ্ট তাঁর জন্ম। আর.সি দত্ত নামে তিনি সমধিক পরিচিত। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন এবং ঐ বছরের শুরুতে মাতঙ্গিনী দেবীকে (মোহিনী বসু) বিয়ে করেন। তাঁদের বিবাহিত জীবন ৪৫ বছর স্থায়ী হয় এবং এ সময়ে তাঁদের ৪ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তান জন্মগ্রহন করে। আর.সি দত্ত কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ফার্স্ট আটর্স (ঋ.অ) পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিলেত থেকে আই.সি.এস পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে আলীপুরে সহকারী ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে তার চাকুরী জীবন শুরু হয়। অতঃপর তিনি মেহেরপুর জেলা (তৎকালীন নদীয়া জেলা) ও দক্ষিণ শাহবাজ পুর (তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলা) রিলিফ অফিসার পদে এবং বাকুড়া, বালেশ্বর, পাবনা, ময়মনসিংহ, বর্ধমান, দিনাজপুর, মেদিনী পুরে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট ও উড়িষ্যায় বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে বিভাগীয় কমিশনারের ন্যায় উচ্চ পদে কোন ভারতীয় নিয়োগ পান নি। তৎকালীন নিয়োগ অনুযায়ী তিনি আরও নয় বছর চাকরী করতে পারতেন কিন্তু তার জুনিয়র তাঁকে ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন পাবার ফলে তিনি চাকরী থেকে স্বেচ্ছায় অবগর গ্রহন করেন। বাকী জীবন তিনি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইঊঘএঅখঊ খওঞঊজঅঞটজঊ শীর্ষক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। তিনি ৪টি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেন। বঙ্গবিজেতা, মাধবীকঙ্কন, রাজপুত জীবন সন্ধ্যা ও মহারাষ্ট্র জীবন। তাঁর দুটি সামাজিক উপন্যাস হলো- সমাজ (১৮৮৫ খ্রি.) এবং সংসার (১৮৯৩ খ্রি.), ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রাক যুগের আরেকজন আই.সি.এস সুরেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং মৃত্যু হয় ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।