পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সরকার ‘লিমিটেড স্কেল’ অর্থাৎ সীমিত পরিসরে গার্মেন্ট, শপিংমল, সুপার শপ, দোকানপাট এবং কলকারাখানা খোলার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। কিন্তু ‘সীমিত পরিসরে’ বলতে কি বোঝায়? এটি পরিস্কার করা হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খানকে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল। জনাব খান স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ মিডিয়া সেলেরও প্রধান। তিনি বলেন, লিমিটেড স্কেল বা স্বল্প পরিসরে অর্থ সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ নাই বা বর্ণনা করা যাবেনা, তবে বিষয়টি কি সেটি বুঝতে অসুবিধা হয়না। তিনি আরো বলেন, এটি এমন মাত্রায় খোলা যাবে, যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় এবং স্বাস্থ্যবিধি এমনভাবে মেনে চলতে হবে, যাতে করে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি না ঘটে এবং জীবন ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে। তিনি আরো বলেন, এর মধ্যেই জনগণ জেনে গেছেন যে, কি করতে হবে এবং কি করতে হবেনা। তাছাড়াও জনগণের আছে বিবেকবুদ্ধি এবং এর মধ্যে তাদের ভেতর পরিপক্কতাও এসেছে।
দেখা যাচ্ছে যে অতিরিক্ত সচিব তথা সরকার গার্মেন্ট, অন্যান্য শিল্প-কারখানা এবং বিপণীবিতানসমূহ খোলার দায়ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এখন ৪ হাজারের ওপর গার্মেন্ট কারখানা খুলেছে। কোনোটাই কিন্তু সীমিত পরিসরে খোলে নাই। সব গুলোই পুরোপুরি খুলেছে এবং পূর্ণোদ্যমে উৎপাদনে গিয়েছে। এমনিতেই লকডাউন প্রথম থেকেই সঠিক ভাবে পালিত হয় নাই। তার ওপর আবার দোকান পাট খুলেছে। জনগণ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। রাস্তাঘাটে ভিড়-ভাট্টা এত বেড়েছে যে, যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য রীতিমত ট্রাফিক পুলিশকে রাস্তায় নামতে হয়েছে। দৈনিক ‘ইনকিলাবে’ গত শনিবার প্রথম পৃষ্ঠায় যে ছবি ছাপা হয়েছে, সেই ছবি থেকেই জানলাম, শুধুমাত্র বাস সার্ভিস চালু হয়নাই। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার আর সমস্ত মাধ্যম চালু আছে। ‘ডেইলি স্টারে’ গত বৃহস্পতিবার থেকে প্রতিদিন একাধিক ছবি ছাপা হচ্ছে। এসব ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে, বাস সার্ভিস ছাড়া আর কোথায়ও শাটডাউন মানা হচ্ছে না। যেখানে যতই লকডাউন এবং স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করা হোক না কেন, এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসুল্লীরা কঠোরভাবে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে তারাবী এবং জুম্মাসহ জামাতে নামাজ আদায় করছে। গত শনিবারের প্রায় সব পত্র পত্রিকায় মুসুল্লীদের সারিবদ্ধভাবে, কিন্তু নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে জামাতে নামাজ আদায় করার ছবি ছাপা হয়েছে।
এব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, কতগুলি গাইড লাইনের আওতায় সীমিত পরিসরে আমরা শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা বাণিজ্য খুলে দিচ্ছি। কারণ লম্বা সময়ের জন্য তো আমরা সব কিছু বন্ধ রাখতে পারিনা। একটি ইংরেজি দৈনিকের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সকলকেই স্বাস্থবিধি মেনে চলতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে হবে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে জনগণেরও একটি দায়িত্ব আছে। তাদের বিবেককে জিজ্ঞেস করতে হবে, এই মহামারীরর সময় তারা কতটুকু বা কতদূর তাদের ব্যবসা বাণিজ্য খোলা রাখবে। তিনি অবশ্য স্বীকার করেন যে, কাঁচা বাজারে সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। তিনি অবশ্য এই মর্মে ইঙ্গিত দেন যে, সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করলে ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো এই যে, সরকার যখন ব্যাপকভাবে লকডাউন শিথিল করে কলকারখানা এবং দোকানপাট খুলে দিচ্ছে তখন সরকারী জোটের সিংহভাগ সরকারের এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে। যারা এই আহবান জানিয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গত মন্ত্রিসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। গত শনিবার দৈনিক ‘যুগান্তরে’ এ সম্পর্কে ১৪ দলীয় জোটের একটি যুক্ত বিবৃতি প্রকাাশিত হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, চলতি মাসে দেশে করোনার ত্রাস বাড়ার শঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন, এমনিতেই মানুষ নানা অজুহাতে ঘরে থেকে বের হচ্ছেন। তাদের ঘরে রাখতে হিমসিম খাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আর যদি শপিংমল, বিপণীবিতান ও দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়, তাহলে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আইন মানানো কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এখন এ ধরণের একটি সিদ্ধান্ত করোনাভাইরাস আরো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যমুনা ফিউচারপার্ক, বসুন্ধরা শপিংমল, পিংকসিটি, বায়তুল মোকাররম, গাউছিয়া, চন্দ্রিমা মার্কেট বন্ধ রাখার ঘোষণা বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, এখন ব্যবসা করার সময় নয়। বরং যেসব মালিকদের সামর্থ রয়েছে তারা তাদের কর্মচারীদের সহায়তা করে এসময় পাশে থাকুন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে কেনাকাটা করা খুবই কষ্টকর বিষয়। সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যায়। নিরাপদ ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে সাময়িকভাবে ত্যাগ স্বীকার করার জন্য তাঁরা আহবান জানান। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আসন্ন পবিত্র ঈদকে সামনে রেখে শপিংমল ও দোকানপাট খুলে দেওয়ার সরকারী সিদ্ধান্ত জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। জীবিকার প্রয়োজনে এই সিদ্ধান্ত হলেও করোনা ভাইরাসের কারণে জনজীবন এখন বিপন্ন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা এখন চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন। মানুষকে ঘরে রাখতে ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে প্রাণঘাতি এই ভাইরাস সারা দেশে সংক্রমিত হয়েছে বলে সবাই জানেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, সারা বছর যারা কম বেশি ব্যবসা করেছেন তারা এই কটি মাস দোকানা কর্মচারী সহ নিজেদের আর্থিক সুরক্ষা করতে পারেবন না, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এবারের ঈদ কোনো উৎসব নয়। মহাদুর্যোগের সময় ঈদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি ছাড়া আনন্দ উৎসবের কিছু নাই। বরং বিত্তশালীরা ঈদের খরচটুকু দরিদ্র সমর্থহীন মানুষের মাঝে বিতরণ ও সাহায্য করতে পারেন। দোকান মালিক সমিতিকে আমরা অনুরোধ করবো- সাময়িকভাবে আপনারা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
তিন
বিষেশজ্ঞ মতামত ছাড়াও যদি আমরা সাধারণ মানুষ খালি চোখে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তথ্য-উপাত্তের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যায় যে, সংক্রমণের প্রথম মাসে সংক্রমণের তেমন বিস্তৃতি ঘটেনি। দ্বিতীয় মাসে সংক্রমণের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশে তৃতীয় মাসে করোনা সংহার মূর্তিতে আবিভূত হয়েছে। আমেরিকায় প্রথম দুই মাসে সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ২১৯। এর মধ্যে ৯৯.৯ শতাংশই হন দ্বিতীয় মাসে। ইটালীতে প্রথম দুইমাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৯২ হাজার ৪৭২। এর ৯৮.৭৮% দ্বিতীয় মাসে। স্পেনে দ্বিতীয় মানে ৯৯.৫%, যুক্তরাজ্যে স্পেনের প্রায় অনুরূপ। তবে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে তৃতীয় মাস থেকে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে করোনা প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। তারপর থেকে ৬ মে, অর্থাৎ ১ মাস ২৯ দিনের চিত্র পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, আলোচ্য সময়ে আমেরিকা, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থার চেয়েও খারাপ বাংলাদেশের চিত্র। আলোচ্য সময় বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৯৯ হাজার ৬৪৬টি এবং সংক্রমিত হন ১১ হাজার ৭১৯ জন এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন ১৮৬ জন। এখন শুরু হয়েছে করোনা আক্রান্তের তৃতীয় মাস। এমাসে করোনা পিক টাইমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চার
লেখাটি শুরু করেছি শনিবার। রবিবার শেষ পর্যায়ে যখন এসেছে তখন একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান সংবাদ হিসাবে একটি খবরের প্রতি চোখ আটকে গেল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবাদ। শিরোনাম, চবধশ রহ ৩ৎফ ড়ৎ ষধংঃ বিবশ. অর্থাৎ তৃতীয় বা শেষ সপ্তাহে পিক বা সর্বোচ্চ সময়।’ সংবাদে বলা হয়, সরকার নিযুক্ত কমিটি বলেছে, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে ঈদের আশে পাশের সপ্তাহ গুলিতে। কিন্তু স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলেন যে এই ধরণের ভবিষ্যদ্বানী করার সময় এখনও আসেনি। নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতো যদি নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা অনেক বেশি হতো এবং লকডাউন কঠোর ভাবে পালন করা হতো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিকট দাখিলকৃত পরামর্শক কমিটির ঐ রিপোর্টে বলা হয়ে যে চলতি মাসের তৃতীয় বা ৪র্থ সপ্তাহে সংক্রমণ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছবে। এই অবস্থা দুই সপ্তাহ চলবে, এমনকি জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে। জুন মাসের শেষের দিকে সংক্রমণ সহনীয় পর্যায়ে থাকবে, অবশ্য স্বাস্থ্যবিধি সমূহ যদি আরো শিথিল করা না হয়। উল্লেখ্য, মার্চ মাসে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য সরকার দেশের ১৭ জন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেন। সেই পরামর্শক কমিটিই আলোচ্য রিপোর্টটি সরকারের নিকট দাখিল করে।
রিপোর্টে বলা হয়, আমাদের টিমের পূর্বাভাস এই যে করোনার পিক সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। জুন মাসের শেষে যখন অবস্থা সহনীয় পর্যায়ে আসবে তখনও খুব কম সংখ্যক হলেও নতুন কেস দেখা দিতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঘরে থাকা ও শারীরিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালন করতে হবে। ঐ দিকে স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, এখন দৈনিক গড়ে ৬ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। দৈনিক ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করতে না পারলে সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হবেনা।
পাঁচ
সর্বশেষ খবরে দেখা যায় যে সরকার ১০ মে থেকে দোকানপাট খোলার কথা বললেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের অধিকাংশ সুপার শপ ও দোকান মালিকরা তাদের দোকানপাট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আরেকটি কারণেও এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেটা হলো, দোকানপাটে কেনাকাটার সময় শারীরিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা সম্ভব নয়। পুলিশ যখন স্বাস্থ্যবিধি পালনে কঠোর হবে তখন ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। যেসব শপিংমল ও দোকানপাট খুলবেনা সে গুলোর মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, পিংক সিটি, নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনী চক, চিশতিয়া, নিউ চিশতিয়া, নূর ম্যানসন, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, প্রিয়াঙ্গন, ইসলামী ম্যানসন এবং ইস্টার্ন মল্লিকা এবং গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া ও বাংলাবাজারের পাইকারী মার্কেট। তারা বলেন, জীবনের চেয়ে ব্যবসা বড় নয়। হ্যাট্স অফ্ টু দেম।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।