পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনা মহামারীর এই সময়ে ‘গুজব ছড়ানো’র অভিযোগে সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট ও লেখকসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে র্যাব। এ ছাড়া অজ্ঞাত আসামি হিসেবে আরও পাঁচ-ছয়জনের কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে চারজনকে গ্রেফতারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রমনা থানায় র্যাবের করা মামলায় বলা হয়, র্যাবের খিলগাঁও ক্যাম্পের (সিপিসি-১) সাইবার ইউনিট গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে, কিছুসংখ্যক লোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট, আইডি পর্যবেক্ষণ করে ‘আই এম বাংলাদেশী’ নামের একটি পেজ শনাক্ত করে। ওই পেজ থেকে রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, মহামারি, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার প্রমাণ পাওয়া যায়। মামলায় এ ধরনের অভিযোগের কথা বলা হলেও, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা এবং গ্রেফতারের ঘটনাকে বিশিষ্টজনরা স্বাধীন মত প্রকাশকে স্তব্ধ করা এবং বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ হিসেবে দেখছেন। এ নিয়ে তারা বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন। সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ এ ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, কোনো ধরনের যথাযথ কারণ এবং অভিযোগের সারবত্তা ছাড়া মামলা ও গ্রেফতার করা শুধু মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেই খর্ব করে না, সরকারের ভাবমর্যাদাও ক্ষুন্ন করে। এ দিকে সাত রাষ্ট্রদূত এ নিয়ে টুইট বার্তার মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা সাতটি দেশ ও জোটের রাষ্ট্রদূতরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।
অস্বীকার করার উপায় নেই, করোনার শুরুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গুজব ও ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করা হয়। পরবর্তীতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ এবং প্রচারণার কারণে এ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গুজব কমে যায়। তবে অনেকে গঠনমূলক এবং তথ্যসমৃদ্ধ পোস্ট ও মন্তব্য করেন। সেগুলো জনসচেতনতায় অনেক কাজে লাগে। বলা বাহুল্য, এসব মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, সিদ্ধান্ত এবং তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করতেও দেখা যায়। করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার সমালোচনা, হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়া, মন্ত্রীসভার কোনো সদস্য কিংবা জনপ্রতিনিধিদের নির্লিপ্ততাসহ সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তেরও গঠনমূলক সমালোচনা করা হয়। এসব সমালোচনা সরকারের বিরুদ্ধে গেলেও বাস্তবতার সাথে অমিল রয়েছে, তা সরাসরি অস্বীকার করার উপায় নেই। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা গ্রুপ পেইজে, ম্যাসেঞ্জারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে সমালোচনা করেছে। করোনার ক্রান্তিকালে মানুষ যখন দিশেহারা এবং এ থেকে কীভাবে কত দ্রুত মুক্তি লাভ করা যায়, তা নিয়ে অধীর হওয়া তাদের পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারো কারো ক্ষুদ্ধ মনের বহিঃপ্রকাশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কেউ কেউ নানা অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরে সরকার এবং জনপ্রতিনিধিদের সমালোচনা করেছে। সরকারকে এ বিষয়গুলো সহনশীলতার মাধ্যমে দেখা উচিৎ বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। তবে দেখতে হবে, এতে রাষ্ট্রবিরোধী বা জনস্বার্থবিরোধী কোনো উপাদান রয়েছে কিনা। এ কথা স্পষ্ট যে, উল্লেখিত সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট ও লেখকদের বিরুদ্ধে যে মামলা এবং গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে, তাতে সরকারের সমালোচনা ছাড়া রাষ্ট্রবিরোধী কোনো উপাদান নেই। সরকার এই সমালোচনা সহ্য করতে পারেনি বা পারছে না। অভিযুক্তরা যে মতামত প্রকাশ করেছে, তার বিপরীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি দিয়ে খন্ডাতে পারত। মতামতের বিরোধিতা মতামত দিয়ে করাই সমীচীন। এর কোনো মানে হয় না, কারো মতামত পছন্দ না হলে তাকে মামলা-মোকদ্দমা ও গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়ে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা মানুষের মতপ্রকাশের প্রতি রাষ্ট্রের অসহিষ্ণুতারই বহিঃপ্রকাশ। বরং দেশের ক্রান্তিকালে ধৈর্য্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে মানুষের মতামতকে মূল্যায়ণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই শ্রেয়।
সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট ও লেখকসহ যাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে, তা এ মুহূর্তে দেশের ভাবমর্যাদার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। পর্যবেক্ষকরা এ ঘটনাকে হয়রানিমূলক বলেই মনে করছেন। এমনিতেই আমাদের দেশে বাকস্বাধীনতা ও ভিন্ন মতপ্রকাশের সংকোচন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও অনেক বিতর্ক ও বিরোধিতা রয়েছে। দেশের মতপ্রকাশের সূচক নিম্নগামী বলে বলা হচ্ছে। এখন করোনার ভয়াবহতার কারণে দেশের অর্থনীতি মন্দাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সংকট মোকাবেলায় সরকারকে বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। বিদেশী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে এডিবি’র কাছ থেকে প্রথম দফায় ১০০ মিলিয়ন ডলার এবং দ্বিতীয় দফায় আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে। অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার কাছ থেকেও হয়তো অর্থ সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। এ প্রেক্ষিতে, দেশের বাকস্বাধীনতা খর্ব করার বিষয়টি যদি আবার সামনে চলে আসে, তবে আর্থিক সহায়তা ও ঋণ পাওয়ার বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ, এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চালিকাশক্তি পশ্চিমাবিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো। আর আমাদের দেশের বাকস্বাধীনতার বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার এবং উদ্বেগ প্রকাশ করে। কাজেই, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকারের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। সমালোচনা সহনশীলতার সাথে গ্রহণ করা জরুরী। গণতান্ত্রিক সরকারের এটা দায়িত্বও বটে। যদি এমন হয়, যা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি বা ক্ষতিকর, সে ক্ষেত্রে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তবে শুধু সরকারের সমালোচনার জন্য মামলা ও গ্রেফতারের মাধ্যমে বাকরুদ্ধ করে কারাগারে প্রেরণ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।