শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
নদীর আছে গন্তব্য, মিশে যায় মোহনায়। ম্রিয়মান ছায়া পেছনে ফেলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনও বাড়ি যায়। অস্তমিত হয় শেষ বিকেলের সূর্য। সময় এমনি হয়। সেই সময়ের পথ ধরে পুরনো হয়ে গেলো আরো একটি গল্পের পান্ডুলিপি। কবির ভাষায়- বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক---/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভূলে যাওয়া গীতি/অশ্রুবাস্প সুদূরে মেলাক--। বাংলা নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন প্রধান একটি উৎসব পহেলা বৈশাখ। প্রতিটি বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে উৎসব আমেজ আর ফুরফুরে বাতাসের দিন বসন্ত। আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। জীর্ণ-শীর্ণ পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুনের আহবানে সামনে এগিয়ে যাওয়ার, বাঙালির চিরায়ত উৎসবে মেতে ওঠা, প্রাণ খুলে আনন্দে ভেসে যাওয়া। অতীতের ভুলত্রু টি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় বাঙালির নববর্ষ। বাংলাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। শিশু-যুবা-বৃদ্ধসহ সব বয়সের সব শ্রেণি মানুষ এ দিনটি উদযাপন করে। বাংলা নববর্ষ বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। এ উৎসবে প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। এছাড়া আমানি, রাজপুণ্যাহ, হালখাতা, গাজনের গান ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান যা আগের দিনে মাস জুড়ে চলতো। বাংলা নববষের্র সূচনা মুসলমানদের হাতে। হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি। মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে বাংলার কৃষকদের সুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। বাংলা নববর্ষের যাত্রা খুব বেশি দিন আগের নয়। সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহনের বছর ৯৬৩ হিজরি (১৫৫৬ ঈসায়ী) সনকে শুরুর বছর ধরে ফসলী সন নামে যে সন প্রবর্তন করেন যা কালক্রমে বাংলা সন নামে পরিচিত লাভ করে। মূলত মুঘল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এ দেশের ঋতু পরিবর্তনের সাথে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা হয়। অধিকন্তু কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দেয়। কৃষক ও জমিদারের সমস্যা দূর করতে জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। বাংলা নববর্ষ বাঙালির হলেও উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশি । উল্লেখ্য, হিজরি সন গণনা হয় রাসুল (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনা হিজরত কেন্দ্র করে। ওমর (রা.) রাসুল (সা.)-এর হিজরতকে স্মরণীয় রাখতে হিজরি সনের প্রবর্তন করেন। পরে মুঘল সম্রাট আকবর তার সভাজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর (দৈবে দশমরত্ম) পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন।
বাংলা সন প্রবর্তনে মুসলমান ও হিন্দু উভয় ধর্মে প্রভাব পড়ে। বাংলা সন ছাড়াও প্রায় সকল সনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাবের একটি দিক থাকে। বাংলা সনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিমের মিলিত স্রোতে সনটি অসাম্প্রদায়িক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে যা উদার ইসলামী সংস্কৃতির পাশাপাশি বাংলা সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল। কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থেই এ সন প্রবর্তন হয়েছিল। বাংলা সন প্রবর্তন থেকেই সাধারণ মানুষের সাথে এ সনের পরিচয় সুগভীর। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হলে আজ বাংলা কত তারিখ, তারা হাতের আঙ্গুলে গুণে তা বলে দেবেন। গ্রামের মানুষের কাছে বাংলা সনের পর গুরুত্ব হচ্ছে হিজরি সন। বাংলা সন প্রবর্তনের বছর থেকেই জমির খাজনা পরিশোধ করা হচ্ছে। এ নিয়মই আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। ইংরেজ শাসনামল অবসানের পর কালক্রমে ‘নববর্ষ’ উদযাপন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তীকালের ঘটনা বাংলা ‘নববর্ষ’ উদযাপনকে প্রাণবন্ত ও বিস্তৃত করেছে। অবশ্যই সা¤প্রতিককালের ‘নববর্ষ’ বা ‘বর্ষবরণ’ ও আগের দিনের ‘নববর্ষ’ বা বর্ষবরণের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক যুগের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মনোহরি চাকচিক্য বাড়লেও আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সময়ের ‘নববর্ষ’ উদযপানে পান্তাভাত ও ইলিশ ভাজাসহ মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটালেও এতে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। ধনী ও বিলাসী মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র ও অসহায় মানুষের অন্তরে প্রকৃত সুখ আসে না। আধুনিক যুগের শহরের মানুষের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের কৃত্রিম নিবীঢ় পল্লীর প্রীতিপূর্ণ ছোট ছোট উৎসব অতল গহবরে হারিয়ে যায়। শিল্পপতি, চাকরিজীবী ও টাকাওয়ালাদের উৎসবের গহবরে পিষ্ট বাঙালি কৃষকদের নববর্ষ উৎসব। অথচ বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়েছে বাঙালি কৃষকের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্র করে। বাংলা নববর্ষের মূল উৎস কৃষক ও কৃষি। বাংলা ‘নববর্ষ’ কেন্দ্র করে গ্রামগঞ্জে বৈশাখী মেলা বসে। কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খেলনা ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে মেলায়। আগের দিনে মেলায় প্রদর্শনী হতো বাঁশের বেতের তৈজষ পত্র, নানা জাতের খেলনা সামগ্রী, নারকেল মুড়কিসহ কত কি থাকে মেলায় তার ইয়ত্তা নেই। মেলার সময় নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর এমন কি মেলায় ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বলী খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠান বসতো। তখন মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আর বিবাহিতা মেয়েরা নাইয়র আসতো বাপের বাড়ি। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই বৈশাখী মেলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো। এমনিভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাংলার গ্রামে গ্রামে আনন্দের ধুম পড়ে যেতো। বৈশাখী মেলার আগের দিন লাঙ্গল জোয়াল মইসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামাদি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় মাটির হাড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেলায় মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল গলার হার ইত্যাদি দ্রব্যও বেচা-কেনা হতো। এছাড়া জুড়ি-বুন্দি জিলাপি রসগোল্লাসহ মুখরোচক খাবারের সমারোহ ছিল বেশ চমৎকার। প্রাচীন রীতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবেই জড়িত শুভ হালখাতা। প্রত্যেক চাষাবাদ চৈত্র মাসের শেষ দিনে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। এরপর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা তাদের প্রজা সাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। পরবর্তীতে তা ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানীরা সারা বছরের বাকীর খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসেন দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসব গুলো সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো ‘নববর্ষে’ হালখাতার হিড়িক পড়ে প্রত্যেক গ্রামগঞ্জে।
বিশ্বায়নের বিভ্রান্তি থেকে নতুন প্রজন্মকে হতে হবে শেকড়সন্ধানী। তরুণ-যুব ও শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয় মূল্যবোধ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার চেতনা জাগ্রত করতে হবে। আকড়িয়ে ধরতে হবে বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতিকে। বাহ্যিক চাকচিক্যময় কুরুচিপূর্ণ আগ্রাসী অপসংস্কৃতি আমাদের যুব ও তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করছে। নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে ভিনদেশী সংস্কৃতিতে মোহচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তাদের অপসংস্কৃতি হতে প্রতিহত করতে না পারলে প্রাণশক্তি হারিয়ে আমাদের জাতি কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে। তাই অপসংস্কৃতি প্রতিহত করতে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। উচ্চকিত করতে হবে মানবিক ও সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির বাঙালি সংস্কৃতি। পরিহার করতে হবে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি। তাহলেই আমাদের বাঙালির ‘নববর্ষ’ উদযাপন সার্থক হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।