পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনাভাইরাসের আতঙ্ক সবাইকে পেয়ে বসেছে। কে, কখন, কিভাবে আক্রান্ত হয়-এ শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এ এক মহাবিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। এই বিপদের উপর বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার উপকরণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অত্যধিক দাম বৃদ্ধি। এ যেন গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া। গত দুই দিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের দাম এক লাফে দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। খাদ্যসংকটের আশঙ্কায় মানুষের মধ্যে হুলুস্থুল কান্ড শুরু হয়ে গেছে। কে কত পণ্য কিনে বাসায় স্টক করতে পারে, এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুতদাররাও দাম বৃদ্ধি করে দিয়েছে। অভিজাত সুপারশপগুলোতে পণ্য কিনতে গিয়ে অনেকে তা পাননি। কাঁচাবাজারে গিয়ে দ্বিগুণের বেশি দামে জিনিসপত্র কিনেছেন। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেল, চিনি, লবণ, ডিম, মাছ-গোশত, শাক-সবজি থেকে শুরু করে হেন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। বিক্রেতারা যে যেমনভাবে পারছে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজারে যেন এক হরিলুট অবস্থা চলছে। এর নিয়ন্ত্রণে কোথাও কোনো ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী। খাদ্যাভাবের শঙ্কায় তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে করোনাভাইরাস, অন্যদিকে খাদ্যসংকটের শঙ্কায় তারা যারপরনাই আতঙ্কিত। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তারা কোনো পথ পাচ্ছে না।
আমাদের দেশে গুজব এবং হুজুগ দুটোই খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে সাধারণ মানুষও দ্রুত আক্রান্ত হয়। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক এখন দেশজুড়ে। প্রায় প্রত্যেকেই এ নিয়ে ভীত হয়ে পড়েছে। এ থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও সতর্কতা অবলম্বন করা। ফলে অনেকে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে দ্রুত ঘরে ফিরে যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের এই আতঙ্ক পুঁজি করে ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্রেতাদের মধ্যে এ শঙ্কা কাজ করছে যে, জিনিসপত্রের সংকট দেখা দিতে পারে। তাই প্রয়োজনীয় খাদ্য মজুত করে রাখতে হবে। এ আশঙ্কায় তারা বেশি বেশি খাদ্যপণ্য কেনার দিকে ঝুঁকেছে। যার এক কেজির প্রয়োজন, সে পাঁচ কেজি কিনছে। এ সুযোগ অসাধু ব্যবসায়ী শ্রেণী নিচ্ছে। অথচ সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, দেশে খাদ্য সংকট নেই, দাম বৃদ্ধিরও কারণ নেই। প্রকৃত অবস্থাও তাই। কারণ করোনাভাইরাসে গণযোগাযোগ বন্ধ বা সীমতি হলেও পণ্যপরিবহনে তার কোনো প্রভাব নেই। সারাবিশ্বেই পণ্যপরিবহন চলছে। আমাদের দেশেও পণ্যপরিবহন স্বাভাবিকভাবেই চলছে। ফলে খাদ্যসংকট দেখা দেয়ার কোনো কারণ নেই। দুঃখের বিষয়, এ বিষয়টি ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই উপলব্ধি করছে না। বিক্রেতারাতো যে কোনো ছুঁতোয় দামবৃদ্ধির জন্য ওঁতপেতে বসে থাকে। আর বড় ধরনের কারণ ঘটলে তো কথাই নেই। করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে কেন্দ্র করে তারা দাম বাড়াবে, তা আগে থেকেই জানা। এই দামবৃদ্ধির ক্ষেত্রে মজুদদার ও বিক্রেতারা যেমন দায়ী, তেমনি ক্রেতাদের আগাম দামবৃদ্ধির আশঙ্কা কিছুটা হলেও দায়ী। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে কোনো ধরনের দুযোর্গ দেখা দিলে মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি সহমর্মী ও মানবিক হওয়া স্বাভাবিক। একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করাই মানবিকতা। আমরা ঝড়-ঝঞ্ঝায় ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা বন্যাদুর্গতদের পাশে সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষকে দাঁড়াতে দেখেছি। পরিতাপের বিষয়, করোনাভাইরাসে সৃষ্ট দুর্যোগে তা দেখছি না। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য কেনার ক্ষেত্রে এক ধরনের অমানবিক পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। খাদ্যসংকট না থাকা সত্তে¡ও অসাধু মজুদদাররা চরম অমানবিকতা দেখিয়ে যাচ্ছে। তারা শুধুমাত্র নিজেদের মুনাফার লোভে দাম বাড়িয়ে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের মধ্যে ন্যূনতম মানবিকতা কাজ করছে না। অন্যদিকে একশ্রেণীর ক্রেতা বিশেষ করে যাদের অঢেল অর্থ-বিত্ত রয়েছে, তারা পারলে পুরো বাজার ঘরে নিয়ে আসতে চায়। তাদের মধ্যে এ মানসিকতা কাজ করে, ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’। মজুদদারদের অতিলোভ এবং ধনী শ্রেণীর অতিরিক্ত কেনার মানসিকতার কারণে গরিব মানুষগুলো অত্যন্ত শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছে।
অতি মুনাফার লোভে খাদ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা শুধু অপরাধ নয়, এটি অন্যায়। ইসলামে এ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ রয়েছে। রাসূলে পাক (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো খাদ্যদ্রব্য ৪০ দিনের বেশি গুদামজাত করে রাখবে, সে উক্ত খাদ্যদ্রব্য সদকা করে দিলেও তার গুদামজাত করার গুনাহ মাফ হবে না (মিশকাত)’। করোনাভাইরাসকে পুঁজি করে যেসব মুনাফাখোর খাদ্যপণ্য মজুত করে অতি মুনাফা করছে, তারা শুধু গুনাহ করছে না, মানবতার শত্রু তে পরিণত হচ্ছে। এসব মুনাফাখোর প্রতিরোধ করা সরকার তো বটেই জনসাধারণেরও দায়িত্ব রয়েছে। সরকারের একার পক্ষে এদের প্রতিহত করা সম্ভব নয়। এজন্য ক্রেতাসাধারণেরও সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদেরও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তারা যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য না কিনে স্বাভাবিক কেনাকাটার বিষয়টি ধরে রাখে, তবে বিক্রেতারা দামবৃদ্ধি করে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। তবে এক্ষেত্রে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ভাল করেই জানে, কারা খাদ্যপণ্য মজুদের মাধ্যমে ক্রাইসিস সৃষ্টি করে দামবৃদ্ধি করে। এদের বিরুদ্ধে সরকার আইনানুগ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক থাকবে এবং এ পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে। করোনাভাইরাস আতঙ্কে কাবু হয়ে পড়া জনজীবনে যদি খাদ্যসংকট বা অতিরিক্ত দাম চলতে থাকে, তবে এর চেয়ে বিপর্যয়কর আর কিছু হতে পারে না। জীবন-মরণ শঙ্কা এবং সার্বিক দুযোর্গময় পরিস্থিতির মধ্যে প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি সহমর্মী হয়ে পাশে দাঁড়াবে, এটাই আমরা কামনা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।