Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গার্মেন্টস পণ্য চুরিতে ৪০ সিন্ডিকেট

জড়িত প্রশাসন ও কাস্টমস কর্মকর্তা চোরাই পণ্য রাখতে গোডাউন ভাড়া ২০ কোটি টাকার বাড়ি ও মাছের খামার করেছে শাহেদ। চারজন গ্রেফতার

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

গার্মেন্টসের বিভিন্ন পণ্য চুরিতে সক্রিয় ৪০ সিন্ডিকেট। ঢাকা, সাভার ও আশুলিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে গার্মেন্ট পণ্য চুরিতে ওই সিন্ডিকেটের নেপথ্যে রয়েছে কতিপয় পুলিশ এবং কাস্টর্মস কর্মকর্তা। রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারাও গার্মেন্টস পণ্য চুরির সাথে সম্পৃক্তদের সেল্টার দিয়ে কামিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। বিভিন্ন সময় প্রশাসনের হাতে গ্রেফতার হলেও এ সব সিন্ডিকেটের সদস্যরা যাতে দ্রুত জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসতে পারে সে জন্য মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে সখ্যতা তৈরি করে কতিপয় আইনজীবীদের সাথে। এ সিন্ডিকেটে পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের চালক ও হেলপার সরাসরি জড়িত।

অনেক সময় পণ্য নির্দিষ্ট দেশে পৌঁছার পর চুরির বিষয়টি প্রকাশ হয়। ফলে পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার পাশাপাশি দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হলেও চোর চক্রের কারণে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ্ হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা ও সাধারণ চুরির মামলা একই ধারায় হয়। এ কারণে গার্মেন্টস পণ্য চোর চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হলেও দ্রুত জামিন পেয়ে যায়। জামিনে বের হয়ে তারা আবারও একই কাজে লিপ্ত হয়।

পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথমে এক বা একাধিক মাস্টারমাইন্ড থাকেন যারা গার্মেন্টস পণ্য পরিবহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার ও হেলপারদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। পরে তাদের বিভিন্ন প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে। অল্পসময়ে অধিক অর্থ প্রাপ্তির আশায় ড্রাইভার ও হেলপাররা চোর চক্রের প্রস্তাবে রাজি হয়ে এই কাজে সহায়তা করে। কাভার্ড ভ্যানে পণ্য লোড করার সময় বন্দরে প্রদর্শনের জন্য গার্মেন্টেসের পক্ষ থেকে পণ্যের স্যাম্পল ড্রাইভারের কাছে দেয়া হয়ে থাকে। এ স্যাম্পল পাওয়ার পরপরই ড্রাইভার সুযোগ বুঝে ছবি তুলে মূলহোতার কাছে পাঠায়। পণ্যের বাজারমূল্যের বিবেচনায় অধিক লাভজনক হলে মূলহোতা উক্ত ড্রাইভার ও হেলপারের সঙ্গে পরে চুক্তি করে।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, চোর চক্রের সঙ্গে কতিপয় কাস্টমস কর্মকর্তা, প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কাভার্ডভ্যান পরিবহণ মালিক ও ছোট ছোট কিছু বায়িং হাউজ জড়িত। সংঘবদ্ধ এই চক্রের সদস্যরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় আগে থেকেই গোডাউন ভাড়া করে রাখে। চালকের যোগসাজশে গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের পণ্য পরিবহণের সময় কাভার্ডভ্যান সেই গোডাউনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাভার্ডভ্যান থেকে বিদেশে রফতানি করা পণ্য শিপমেন্টের প্যাকেট থেকে সরিয়ে ফেলে চোর চক্রের সদস্যরা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে চোর চক্রের সদস্যরা জানিয়েছে, তারা পণ্যের প্যাকেটগুলো কাভার্ডভ্যান থেকে নামিয়ে নিচের দিকে কেটে প্রতি প্যাকেট থেকে ৪ থেকে ৬টি করে পোশাক বের করে স্কচটেপ দিয়ে আবার লাগিয়ে দেয়। কখনও কখনও প্যাকেটের ওজন ঠিক রাখতে ভেতরে ইট-পাথরের টুকরা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সেই প্যাকেট আবারও কাভার্ডভ্যানে তুলে নির্দিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কাছে পৌঁছে দেয় তারা।

নাম প্রকাশ না করার শতের্, একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, গার্মেন্টস পণ্য চুরিতে ঢাকা-চট্টগ্রামকেন্দ্রিক অন্তত ৪০টি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরমধ্যে অন্যতম একজন হলো সাহেদ ওরফে সিলেটি সাঈদ। সিলেটি সাঈদ একসময় একাধিক কাভার্ডভ্যানের মালিক ছিল। নিজের কাভার্ডভ্যান দিয়ে গার্মেন্টস পণ্য পরিবহণ করতে গিয়ে নিজেই একটি চোর সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। অন্তত একযুগ ধরে পণ্য চুরি করে আসছিল এই সিলেটি সাঈদ। চুরির টাকায় কাটাতো বিলাসী জীবনও।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা যেসব চক্রের সন্ধান পেয়েছেন, তার মধ্যে ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী ও বায়িং হাউজের কর্ণধারও রয়েছে। চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের স্বার্থে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। একাধিক চক্রের সদস্যদের ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
হাইওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, গার্মেন্ট পণ্য চুরির সিন্ডিকেটের সদস্যরা নারায়ণগঞ্জ, কাঁচপুর এলাকায় গোডাউন ভাড়া করে রাখে। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গোডাউন। চুরি ঠেকাতে পুলিশের পক্ষ থেকে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এদের নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, গার্মেন্টস পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী অনেকের নাম আমরা পেয়েছি। তাদের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। চোর চক্রের অন্যতম সজিব, রিপন, স্বপন, মো. রিপন ওরফে ছোট রিপন, বিল্লাল, নাঈম।

২০ কোটি টাকার বাড়ি ও মাছের খামার করেছে শাহেদ : শতকোটি টাকা মূল্যের রফতানিযোগ্য চোরাই গার্মেন্টস পণ্যসহ সংঘবদ্ধ চোর চক্রের হোতা শাহেদ ওরফে সাঈদ ওরফে বদ্দাসহ চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। চক্রটি গত দেড় যুগ ধরে রফতানিযোগ্য গার্মেন্টস পণ্য চুরি করে আসছিল। গাজীপুরের কারখানা থেকে কাভার্ডভ্যানে পোশাকের একটি চালান ব্রাজিলে রফতানির উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়। পরের দিন ৮৯৮ কার্টন ভর্তি সোয়েটার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। ক্রেতা-মনোনীত শিপিং প্রতিষ্ঠান এক লাখ ২৫ হাজার ডলারেরও বেশি মূল্যের চালানটি গ্রহণ করে ব্রাজিলে পাঠায় এবং সে মোতাবেক বন্দর থেকে চালানবহনকারী জাহাজটি রওনা দেয়ার পরপরই ক্রেতা পুরো অর্থ পরিশোধ করে। তবে গত ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের ক্রেতার কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও দেখে হতবাক হয়ে যান গার্মেন্টস মালিকপক্ষ।

সেখানে দেখা যায়, কিছু কার্টন সম্পূর্ণ খালি এবং অনেকগুলো কার্টন থেকে পচুর পরিমাণ পণ্য খোয়া গেছে। পরবর্তী সময়ে চুরি হওয়া গার্মেন্টস পণ্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা হিসেবে পরিশোধ করতে হয় মালিকপক্ষকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ গত ২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গাছা থানায় চুরির ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি করে। পরে চোর চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারসহ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় র‌্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার রাতে র‌্যাব-৪ পৃথক অভিযানে মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে আলোচিত ব্রাজিলে রফতানি করা গার্মেন্টস পণ্য চুরিসহ দেশের গার্মেন্টস পণ্য চুরি কা-ের মূলহোতাসহ গ্রেফতার করা হয় চারজনকে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০১৮ সালের পর শাহেদ পর্দার আড়ালে থেকে চুরির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ শুরু করে এবং প্রতিটি চুরির ঘটনায় আয় করা অর্থের সর্বোচ্চ অংশ পেতো সে। শাহেদ গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে এই গার্মেন্টস পণ্য চুরির জগতে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করছে। মৌলভীবাজার শহরে সাহেদের প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি রয়েছে। মৌলভীবাজারের দূর্লভপুরে ২০ একর জমির উপরে মাছের খামারসহ বিশাল দু’টি হাঁস-মুরগির খামারও রয়েছে তার। এছাড়াও বর্তমানে তার নিজস্ব চারটি কাভার্ডভ্যানসহ সহযোগীর আরো ১৫টি কাভার্ডভ্যান রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১৭-১৮টি গার্মেন্টস পণ্য চুরির মামলা রয়েছে। অধিকাংশ মামলায় সে কারাভোগ করেছে। এমনকি তার বিরুদ্ধে আদালতে ছয়টি মামলার বিচারকাজও চলমান রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পণ্য চুরি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ