Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোদেলা

মনির হোসেন চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০২০, ১২:০৩ এএম

রোদেলা আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠল। ঝটপট তৈরি হতে হবে। আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। বন্ধুদের কাছ থেকে নোট নিতে হবে। ওয়াশ রুমে ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির দিকে রওয়ানা হলো। ক্যান্টিন থেকে নাস্তা সেরে নিতে হবে। আজ সকালটা বেশ সুন্দর, না রোদ না ছায়া, ভীষণ ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠে। রোদেলা বেশ শান্ত ও মিষ্টি একটা মেয়ে। পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে। সরকারি চাকরির মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল ভালোবেসে, সংসার টিকেনি। সেই থেকে ছেলেদের প্রতি রোদেলার অনীহার জন্ম নেয়। ভালোবাসা, ভালোলাগার প্রতি দেখা দেয় বৈরাগ্য। বন্ধুরা প্রায় সবাই ক্লাসমেট কিংবা পছন্দের মানুষের সাথে চুটিয়ে প্রেম করে, ড্রেটিংয়ে যায়, ঘুরে বেড়ায়। রোদেলা শুধুমাত্র এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম। জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটিতে ক্যাম্পাস, ক্লাস শেষ করে ভার্সিটির গাড়িতে উঠতে হবে। ফাগুনের শেষ বিকেল গাছ থেকে পাতা ঝড়ে পড়ছে। শহরের যান্ত্রিক ব্যস্ততম জীবন থেকে এদিকটা বেশ নীরব। বাসায় প্রবেশের মুখে খুব দামি ধবধবে সাদা গাড়ী। ড্রয়িংরুমে বেশ কয়েকজন মহিলা পুরুষের উপস্থিতি। পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী সোমা মুচকি হেসে জানালো পাত্র পক্ষ তাকে দেখে ফাইনাল কথা বলতে এসেছে। রোদেলার মন খারাপ হয়ে গেল। বিয়ের ব্যাপার পরিবারের ইচ্ছাটাকেই সে বরাবর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তবুও পড়াশোনা শেষ না করে এই ব্যাপারটাকে সে এভোয়েট করতে চায়। বাসায় তার ছোট মামী, কাজিনরা হৈচৈ করে উঠে। মা বাবার ইচ্ছে ইমপোর্ট এক্সপোর্টের বড় ব্যবসায়ী পরিবারের ছোট ছেলের সাথে খুব শীঘ্রই রোদেলার বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে চায়। ছোট মামা এ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, সাথে প্রচুর মিষ্টি, ফলমূল নিয়ে হাজির। পড়াশোনার ব্যাপারে রোদেলার বাবা আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার মায়ের একগুঁয়েমিতে এ বিয়ে সম্পন্ন হয়। তার মায়ের কথা সব সময় এত ভালো পাত্র পাওয়া যায় না। ছেলেদের অভিজাত এলাকায় বসবাস, পাত্র পক্ষ এক প্রকার তড়িগড়ি করে রোদেলাকে আংটি পড়িয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেন, পাত্র নাকি বেশ কয়েকদিন রোদেলাকে ভার্সিটিতে যাওয়ার পথে ফলো করছে, পাত্র দেখতে সুন্দর, লম্বা, গৌড়বর্ণ, বিয়ের পরেও পাত্র পক্ষ রোদেলার পড়াশোনা শেষ করাবেন এ প্রতিশ্রুতি দিলেন। বিয়ের পর পড়াশোনা, সংসার, সবকিছু নিয়ে রোদেলার বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। রোদেলার স্বামী মেহরাব ব্যস্ত ব্যবসায়ী। শাশুড়ি এবং শ্বশুড় বাড়ির আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়ে রোদেলার সুখের সংসার কাটতে লাগল, এবার সংসারে নতুন অতিথির ব্যাপারে শ্বশুড় বাড়ীর পক্ষরা আগ্রহী হয়ে উঠল। অর্থাৎ রোদেলার কোলে নতুন বাচ্চা প্রত্যাশা করল। কিন্তু রোদেলা ও মেহরাবের সংসারে নতুন অতিথির কোনো আভাস পাওয়া গেল না। শাশুড়ি দিনদিন উড়তে বসতে রোদেলাকে আকার ইঙ্গিতে অনেক কটূ কথা বলতে লাগল। রোদেলা চুপচাপ সব সহ্য করতে লাগল, একসময় শাশুড়ি বলতে লাগল মেহরাবের বংশ রক্ষার জন্য প্রয়োজন বোধে আবারো ছেলেকে বিয়ে করাবেন। রোদেলা চিন্তিত হয়ে পড়লো, সে তার মা-বাবার এবং কিছু শুভাকাক্সক্ষী-বান্ধুবীদের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করলেন। তারা সবাই রোদেলাকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, এও বললেন যে, রোদেলা না মেহরাব কার সমস্যা এটা ডাক্তার পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করবেন।
রোদেলার মন খারাপ হয়ে গেল, সে এখন প্রায় আনমোনা হয়ে যায়, সে তার রুমের খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূর-দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আনমোনা হয়ে যায়, স্নিগ্ধ সকাল, অলস দুপুর শান্ত বিকেল স্বর্ণালী সন্ধ্যা সবই তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। ভার্সিটির অতীত রোদেলাকে খুব বিমোহিত করে তোলে। অবশেষে মেহরাব ও রোদেলার সিদ্ধান্তে তারা উভয়ে ডাক্তারের কাছে যায় এবং টেস্ট করায়। কিছুদিন পর টেস্ট রিপোর্ট বের হয়, রিপোর্টে দেখা যায় যে, রোদেলার বাচ্চা নেয়ার ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই, মূলত: সমস্যা মেহরাবের।
মেহরাবের অক্ষমতা রোদেলাকে ভীষণ ভাবিয়ে তোলে, মেহরাব নিশ্চুপ হয়ে যায়। মুখড়া শাশুড়ি এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বলে না। রোদেলা ভাবে যে, তার জীবনটা কেন এরকম হয়ে গেল? মেহরাবের মা অর্থাৎ রোদেলার শাশুড়ি এবার ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে লাগল যে, মেয়েদের আসল ঠিকানা তার স্বামীর সংসার। তিনি পরামর্শ দিলেন যে, একটা বাচ্চা দত্তক নিয়ে বাকী জীবনটা মেহরাবের সাথে কাটিয়ে দিতে। রোদেলার কত স¦প্ন ছিলো যে, স্বামী, সন্তান, সংসার নিয়ে বাকী জীবনটা সুন্দরভাবে কাটিয়ে দিবে। রোদেলা চিন্তা করে ভেবে পায় না যে সে এখন কি করবে? তার স্বামীর সাথে এভাবে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিবে? নাকি অন্য সিদ্ধান্ত নিবে? বাড়ির খোলা ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে চিন্তিতভাবে তাকিয়ে থাকে, নিঃস্তব্দ চরাচর, অনেক রাত, কাঠ পাথরের ঢাকা এখন নিঃস্তব্দ ও শান্ত। রোদেলা জানে না কখন ভোর হবে, পাখি ডাকবে, কখন কি এ রাত শেষ হবে না? পাখি ডাকবে না? আরেকটি সুন্দর সকাল আসবে না? রোদেলা এটা ভেবে পায় না যে, অসীম আকাশের যেন শেষ নেই, শেষ নেই দুই ভূবনের, দুই মানব মানবীর প্রত্যাশারও।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোদেলা

১৩ মার্চ, ২০২০
আরও পড়ুন