Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শেকড়ের সন্ধানে কলের গান

জোবায়ের আলী জুয়েল | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০২০, ১২:০৩ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)

১৯০০ সালে তিন পাশ্চাত্য থেকে গ্রামোফোন বা কলের গান তৈরির প্রযুক্তি আমদানি করে কলকাতায় একটি গ্রামোফোন বা কলের গান রেকডিং কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর মাধ্যমে গ্রামোফোন রেকর্ড প্রস্তুত ও বিতরণ শুরু করেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম এবং এ ব্যবসায় তাঁর সাফল্য পূর্ববর্তী সকল অর্জনকে ছাড়িয়ে যায়। বাজারে তাঁর রেকর্ড “এইচ বোস’স রেকর্ড” নামে পরিচিতি লাভ করে।
তাঁর তৈরি রেকর্ডের মাধ্যমেই জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের আবৃত্তি, বাণী ও সাক্ষাৎকার ধারণ করা সম্ভব হয়, বোস’স রেকর্ড বাংলা, হিন্দি ও উর্দূতে অনেক অনুষ্ঠান ধারণ করেন। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে তাঁরই রচিত গান ও কবিতার রেকর্ড ও বের করেন।
১৯০৭ সাল থেকে এইচ বোস’স রেকর্ড এর অসংখ্য ডি¯‘ বাজারে মুক্তিপায় এবং এর চাহিদা ক্রমশ এুই বৃদ্ধি পায় যে, হেমেন্দ্র মোহন বসু অবিভক্ত ভারতের একজন খ্যাতিমান ও সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হন, কারণ তিনি ছিলেন একজন বাঙালি উদ্যোক্তা এবং স্বদেশী আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদের ওপর অনেক রেকর্ড প্রকাশ করেছিলেন। ১৯১৬ সালের ২৮ আগষ্ট তিনি মারা যান।
গ্রামোফোন তৈরি ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন কলকাতার মানিক লাল শাহা (এম, এল, শ্ব)। এর আগে তিনি ছিলেন একজন সফল হারমোনিয়াম নির্মাতা।
মানিকলাল শাহা লন্ডনের নিকল ফেরেস লিঃ এর নিকল রেকর্ডস ও নিকল ফোনের প্রথম ও প্রধান এজে’ট ছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত বিখ্যাত ইন্ডিয়ান রেকর্ডস ম্যানিউফ্যাকচারিং কোম্পানী লিঃ প্রতিষ্ঠা করেন। বিংশ শতকের বিশের দশক থেকে গ্রামোফোন ও গ্রামোফোন রেকর্ডস বাঙালি পরিবারে একটি মর্যাদা পূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়। যখন স্টেরিও গ্রামোফোন স্থান দখল করেছিল তখন পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের জমিদার পরিবারের সন্তান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ স্যার আব্দুল হালিম গজনবী হলেন প্রথম বাঙালি মুসলমান, যিনি গ্রামোফোন সামগ্রীর ব্যবসায় নেমে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন।
এছাড়াও মীনা পেশোয়ারি নামক এক অবাঙালি ধনী মুসলমান ১৯২৬ সালে “শাহন শাহ” রেকর্ড কোম্পানী নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
চন্ডীচরণ সাহা, বিভূতিভূষণ ও জিতেন্দ্র নাথ ঘোষ তিরিশের দশকের গোড়ার দিকে গড়ে তোলেন স্বদেশী রেকর্ড কোম্পানী “মেগাফোন”, “হিন্দুস্তান” ও “সেনোলা”।
পরবর্তীতে এদের সাফল্য ও প্রেরণায় আরও বেশ কয়েকটি দেশীয় রেকর্ড কোম্পানীর জন্ম হয় যেমন- পাইওনিয়ার, ভারত, রিগ্যাল, মেল-ও-ডি এবং কোহিনূর। দেশভাগের আগ পর্যন্ত এই দেশী কোম্পানী গুলো সাফল্যের মুখ দেখেছিল।
গ্রামোফোন বা কলের গান ৮০ বছরের ইতিহাসে এক মহা গৌরব ও অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। গ্রামোফোনকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে সঙ্গীত শিল্পী সৃষ্টি হয়েছিল তাঁদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্যরা হলেন- গওহ জান, লালচাঁদ বড়াল, কে মল্লিক (কাশেম মল্লিক), ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ, ভীস্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বিমল দাশ গুপ্ত, তুলসী লাহিড়ী, আব্বাস উদ্দীন আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কুন্দ লাল সায়গল, আঙ্গুর বালা, ইন্দু বালা, শচীন দেব বর্মন, কানন বালা দেবী, জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী, বেগম আখতার, সুধীর লাল চক্রবর্তী, কমলা ঝরিয়া, জগন্ময় মিত্র, যুথিকা রায়, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এবং আরো অনেক শিল্পী।
কাজী নজরুল ইসলামকে গ্রামোফোনের (কলের গান) শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলা যায়। ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত (নজরুল অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত) কাজী নজরুলই ছিলেন গ্রামোফোনের প্রধান গীত রচয়িতা, সুর স্রষ্টা ও সঙ্গীতের প্রশিক্ষক।
নজরুল আনুষ্ঠানিক ভাবে হিজ মাস্টারর্স ভয়েস (এইচ.এম.ভি) গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানীতে যোগ দেন ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে। নজরুলের নিজস্ব কণ্ঠে গাওয়া বেশ কয়েটি গান গ্রামোফোন থেকে সেই সময় রেকর্ড বের হয়।
আনুষ্ঠানিক ভাবে এইচ এম.ভি তে যোগদানের পর নজরুলের লেখা ও সুরে গান গেয়ে অনেক গায়ক-গায়িকা অর্থ ও খ্যাতির শিখরে পৌঁছেন। সেই সাথে এই কোম্পানীও আয় করেছে প্রচুর অর্থ। তবে এইচ.এম.ভি’র মধ্য মনি “সুরের জাদুকর” নজরুলের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন সে সময় হয় নি।
গ্রামোফোন রেকর্ডের সুর সংযোজন ও সঙ্গীত পরিচালনায় আর যাঁদের স্মরণ করতে হয় তাঁরা হলেন- তুলসী লাহিড়ী, রাইচাঁদ বড়াল, কমল দাশ গুপ্ত, হীরেন বসূ, সুর সাগর হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটক, দূর্গা সেন, তিমির বরণ, সুধীরলাল প্রমূখের নাম। নজরুলের লেখা ও সুর করা গানের রেকর্ড এইচ.এম.ভি, মেগাফোন, টুইন, কলম্বিয়া, সেনোলা-পাইওনিওর, হিন্দুস্তান, শাহান শাহ, ভিয়েলোফেন এই সব কোম্পানী থেকে শুধু বের হয়নি সমাদরও পেয়েছে। এর পরবর্তী যাঁরা গীতিকার হিসেবে গ্রামোফোন কোম্পানী তে নাম করেন তাঁরা হলেন- প্রণব রায়, হীরেন বসু, শৈলেন রায়, অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ রায়, মোহিনী চৌধুরী, পবিত্র মিত্র এবং আরো অনেকে। এক সময় গ্রামোফোন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। সৌখিন ব্যক্তিরা বিভিন্ন শিল্পীর গানের রেকর্ড সংগ্রহ করে রাখতেন। সে সময় বাংলার ঘরে ঘরে গ্রামোফোনে গান শোনাটাই ছিল বিনোদনের সেরা মাধ্যম।
জ্ঞানের অসামান্য অগ্রগতির ফলে নতুন প্রযুক্তির কাছে হার মেনে কলের গান বেশ কয়েক দশক আগেই বাঙালির জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে।
এখন শুধু স্মৃতির বেদনা হয়ে পড়ে আছে কলের গান।
অত্যাধুনিক ডিজিটাল যন্ত্রপাতির যুগে গ্রামোফোন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নব প্রজন্ম আর প্রকৃত গ্রামোফোন বা কলের গান চিনবে না। বাংলার ঘরে ঘরে কলের গান আর কখনও বাজবে না।
এখন কলের গানের চেহারা বদলিয়ে আধুনিক রেকর্ড প্লেয়ার, ডিস, স্টেরিও এবং সি.ডি করা হয়েছে। এগুলোর পূর্বের রূপই হলো গ্রামোফোন বা কলের গান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন