Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জুয়াড়ি

অয়েজুল হক | প্রকাশের সময় : ৬ মার্চ, ২০২০, ১২:০৪ এএম

হায়দার সাহেব ইদানীং রাত দুইটার আগে বাসায় ফেরেন না। তার বয়স পঞ্চাশ ওভার হলেও চেহারা বলে টুয়েন্টি! চেহারা থেকে দিন দিন বয়সের ছাপ কমছে! অনেকটা ক্রিকেট ম্যাচের মতো। পঞ্চাশ ওভার তারপর টুয়েন্টি। যে হাবভাব তাতে হায়দার সাহেব সমনের দিনে সিক্স এ সাইড ম্যাচের মতো ছয় বছরের শিশু হয়ে যাবেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। উল্টো দিকে রাবেয়া বেগম হায়দার সাহেবের স্ত্রীর বয়স চলি­শ হলেও চেহারা ইট ভাংগা খোয়ার মতো ভেঙে চুরে যাচ্ছে। দেখলে মনে হয় পঞ্চাশ ওভার। চেহারা ভেঙে গেলেও মেজাজ দেমাগ এখনো ঠিক আছে। পান থেকে চুন খসলে তার মেজাজ গরম হয়ে যায়। মেজাজের সবটুকু ঢেলে দেন হায়দার সাহেবের ওপর। হায়দার সাহেব তো প্লাস্টিক না যে মেজাজের গরমে গলে যাবেন। ডিম ও না যে ভাজি হবেন। তিনি নিতান্ত শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক। মফস্বল শহরে বড় ব্যাবসায়ী হিসাবে সুপরিচিত। গভীর রাতে বাড়ি ফেরা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। ছেলে মেয়ে দুটো লেখা পড়ার সুবাদে বাইরে থাকায় মায়ের পক্ষে দাড়াতে পারছে না। রাবেয়া বেগমের একটাই প্রশ্ন, বয়স হয়েছে এতো রাত পর্যন্ত বাইরে কী?
- ব্যাবসায়ী মানুষ। ব্যাবসা করি।
- রাতের বেলা কিসের ব্যাবসা? রাবেয়া বেগমের কথার ঝাঝ যতো বাড়ে হায়দার সাহেবের মুখে ততোধিক প্রশান্তির হাসি ফোটে। যেন চিতকার দিতে দিতে মহিলার গলা ফেটে মরে যাবার অপেক্ষায় আছেন। মুখে হাসি নিয়ে বলেন, ছোট শহরের বড় ব্যাবসায়ীরা সারাদিন ব্যাবসা করে রাতের বেলা ক্লাবে বৈঠকে বসে। কিভাবে আরও উন্নতি করা যায়।
- ব্যাবসায়ী রা ক্লাবে যাবে কেন! ক্লাব তো খেলাধুলার জন্য।
- ব্যাবসাও একটা খেলা। হারজিতের খেলা। লাভ লোকসানের খেলা।
চিৎকারে ক্লান্ত রাবেয়া বেগম এক সময় নিরব হয়ে যান। দিন যায় রাত আসে, কিন্তু সে রাতের তিন ভাগ পার করে তবেই ঘরে ফেরেন হায়দার সাহেব। প্রতিদিনের মতো বেলা বারটায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়েন। হান্নানের চায়ের দোকানে বেশ কয়েকজন রথি-মহারথিদের চা খাওয়া পর্ব চলে। নেতা রাতুল, হোতা বিপুল, সন্ত্রাসী শিপুল, ক্লাব গ্রুপের চেয়ারম্যান মিতুল। হায়দার সাহেব বাদে সবার নামের সাথে তুল যুক্ত আছে! মিতুল সাহেব বলেন, সব ক্লাবের ভি.আই.পি দের নিয়ে একটা জম্পেশ আড্ডার আয়োজন করলে কেমন হয়? ক্যাসিনো চলবে, সারারাত খেলা হবে। সন্ত্রাসী শিপুল চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হেলেদুলে (যেন চায়ের সাথে মদ মেশানো হয়েছে) বলে, খুবই চমৎকার হয় বস।
- তাহলে সবাইকে বলে দিয়েন। সবাই ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। চা চক্র শেষ হলে গাড়ি চড়া সাহেবের দল বিদায় নেয়। প্রবীণ রিকশা ড্রাইভার নান্নু একপাশে ঘুপচি মেরে বসে ছিল। নামি-দামি মানুষ দেখলে ঘুপচি মেরে থাকতে হয়। যত ঘুপচিতে থাকা যায় ততই মঙ্গল। ওরা চলে যেতেই চা বিক্রেতা হান্নান কে প্রশ্ন করে, ভাই ক্যাসিনো কী কইতে পার? চায়ের কাপ ধুতে ধুতে হান্নান জবাব দেয়, ওই রেডিও, ক্যাসেটের মতো কিছু একটা হবে। খবর হয়, গান হয়।
- ওই যে কইলো সারারাত খেলা হবে!
- কী জানি বড়লোকদের কারবার। নান্নু মিয়া কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে বলে, আমি রিকশা চালাই। দুই টাকার ফকির। তয় কইলাম, ক্লাবের অবস্থা কিন্তু সুবিধার না। রাত বিরাত মাইয়া মানুষ আসে যায়। যুবক যুবক পোলা পাইন মাতাল হয়ে রিকশা চড়ে। নান্নু মিয়া কিছু বলেনা। চুপ করে থাকে। মুখে টেপ মারা চুপ। জম্পেশ আড্ডার বিরাট আয়োজন। রাতের ক্লাবে ঝলমলে আলো। চকচকে অভিজাত মানুষের চেহারা গুলোও ঝলমলে। ঝিলিক বাতির সাথে তাদের চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়। লাল,নীল, সবুজ। সাজানো পরিপাটি চেয়ার টেবিল। রং বেরংয়ের বোতল নিয়ে বসা তরুন- বয়স্ক। জটলা পাকিয়ে কিছু একটা ঘিরে কৌতূহলী মানুষ। ড্রাইভার হারুন কে হায়দার সাহেব একটা চেয়ারে বসে থাকতে বলে এগিয়ে যান। হারুন বসে আছে মূর্তির মতো। মাঝখানে একটা সিগারেট জ্বলিয়েছে। সিগারেটের ধোঁয়াও রংগিন আলোয় লাল নীল দেখায়। তরুণ তরুণীর ঢলাঢলি। আসা যাওয়া। ভেসে আসা উল­াস। সময় ভালোই যাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই সব গোলমেলে হয়ে যায়। একঝাঁক খকি পোশাকের মানুষ। হ্যান্ড মাইক ও আছে। হুড়োহুড়ি দেখে ঘোষণা হয়, যে যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকুন। পালাতে চেষ্টা করবেন না। ড্রাইভার হারুনের বুক শুকিয়ে আসে। তার সবচেয়ে নিকটে টয়লেট। দৌড়ে টয়লেটের ভেতর গিয়ে আশ্রয় নেয়। বিষয় টা হায়দার সাহেবের স্ত্রী কে জানানো দরকার।
- হ্যালো ভাবি।
- হু।
- আপনাকে তো আগেই বলেছি স্যার কিন্তু....
- কিন্তু কী!
- নিজ চোখে দেখে যান।
- কী!
- ক্লাবে কী সব হয়।
- হয় মানে! কন্ঠস্বর শুনে মনে হয় মহিলা যে কোন সময় বেহুশ হয়ে পড়ে যাবেন। আপনি দ্রæত ক্লাবে আসেন। সুযোগ হাতছাড়া করতে নেই। কথা শেষ হয়না, বাইরে থেকে কে একজন বলে ওঠে, টয়লেটের ভেতর কথা বলে কে? দরজায় হাতুড়ি পেটানো শব্দ। চিতকার, দরজা খোল। দরজা খুলে বেরিয়ে আসে হারুন। তার সামনে তিনজন। হ্যান্ডসাম চেহারা।
- টয়লেটে কী?
- একদম কিছু না স্যার।
- কথা শুনলাম।
- ও....। রাবেয়া বেগম। হায়দার সাহেবের স্ত্রী। ওনার সাথে কথা বলছিলাম। সাথে সাথে দু’জন টয়লেটের ভেতর প্রবেশ করেন। একটু বাদেই বেরিয়ে এসে বলেন, ভেতরে কোন মহিলা নেই। শালা জোচ্চর। জুয়াড়ি। রাবেয়া বেগম কোথায়?
- তিনি আসছেন।
- আসছেন মানে? গেল কোথায়!
- তিনি তো বাড়িতে।
- এইমাত্র বললি হয়দার সাহেবের স্ত্রী রাবেয়া বেগমের সাথে কথা বলছিলি।
- স্যার....
- স্টপ, আরেকটা কথাও বলবি না।
হারুন কে পিঠমোড়া দিয়ে বাধা হয়। সময়ের সাথে সাথে সংখ্যা ভারী হতে থাকে। হায়দার সাহেব ও পিঠমোড়া দলের সদস্য তালিকায় স্থান পেয়ে যান। তাকে দেখতে চোর চোর লাগে। হারুন নিজের কথা ভুলে যায়। বুকের ভেতর খুশির সানাই বাজে। মুচকি হেসে বলে, কী অবস্থা স্যার?
হায়দার সাহেব মৃদু হুংকার দেন, আমাকে বিদ্রুপ করিস?
- কী যে বলেন, দেখেন না আমিও তো পিঠমোড়া দল।
মহল্লার উৎসুক জনতা ভীড় করে। রাবেয়া বেগম এসে দেখেন হায়দার সাহেবের হাতে হাতকড়া পড়েছে। হারুনও বাদ পড়েনি। স্ত্রীকে দেখে হায়দার সাহেব করুন চোখে তাকান। রাবেয়া বেগমের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, জুয়াড়ি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জুয়াড়ি

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
২০ জানুয়ারি, ২০২২
৬ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন