Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শিশুর সংশোধনের জন্য প্রবেশন আইনের উপযোগিতা ও নীতিমালা প্রসঙ্গে

পারভীন রেজা | প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

সুস্থ ও সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রত্যেক শিশুর একটি মৌলিক অধিকার। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার রক্ষা করা বড়দের দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশের শিশুরা নানা কারণে নিজের অজান্তেই বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার হয়ে অপরাধের সংস্পর্শে আসা এসব শিশুদের কখনই এককভাবে দায়ী করা যায় না। এদের বিচারের ক্ষেত্রে পৃথক সত্ত্বা হিসেবে আলাদা বিচার, শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের ব্যবস্থা এবং সমাজে পুণর্বাসন নিশ্চিত করার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না বিধায় কারাগাগুলোতে শিশুর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারাগারে এসব শিশুদের মুক্তির বিষয়ে শিশু আইন ১৯৭৪ এবং প্রবেশন অপরাধী অধ্যাদেশ ১৯৬০ এর যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে ‘প্রবেশন কার্যক্রম’ পরিচালিত হচ্ছে। এ কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি শিশুর অন্তরে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে আত্মশুদ্ধির সুযোগ দিয়ে সমাজে সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এভাবে অপরাধ জগত থেকে বের করে শিশুকে সুনাগরিকে পরিণত করা মানে একজন অপরাধীর সংখ্যা কমানো। কিন্তু প্রত্যাশানুযায়ী আমাদের দেশের প্রবেশন কার্যক্রম কোনো রকম নজির সৃষ্টি করতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ে প্রবেশনে মুক্তি দিয়ে সমাজে পুণর্র্বাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া শিশুদের সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায় না।

উন্নত বিশ্বে প্রবেশন পদ্ধতি অপরাধ সংশোধনের একটি কার্যকরী মাধ্যম হলেও আমাদের দেশে ‘প্রবেশন’ বিষয়টি সর্ম্পকে অনেকেই পরিচিত নন। প্রবেশন এক প্রকার আইনসম্মত সংশোধন ব্যবস্থা যা অপরাধীকে প্রদেয় শাস্তি স্থগিত রেখে শর্ত সাপেক্ষে একজন প্রবেশন অফিসারের তত্ত¡াবধানে সমাজে স্বাভাবিকভাবে চলার এবং চারিত্রিক সংশোধনের সুযোগ প্রদান করাকে বোঝায়। এ ব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো আত্মশুদ্ধি করার সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সমাজের পরিমন্ডলে রেখে সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়। সাধারণত সেসব শিশুদের জন্যই এটি ব্যবহৃত হয়, যাদের জন্য তত্ত¡াবধান প্রয়োজন এবং যাদেরকে শাস্তি না দিয়ে মানসিক উন্নয়ন, সংশোধন ও সমাজে পুণর্বাসনের সুযোগ দেয়া হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে শাস্তি অপরাধ প্রতিরোধে সাহায্য না করে বরং অপরাধ বিস্তারে সহায়তা করে। অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের কারাগারের অপ্রীতিকর পরিবেশ থেকে সরিয়ে এনে সামাজিক পরিবেশে আত্মশুদ্ধির সুযোগ দিয়ে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে প্রবেশন কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

বাংলাদেশে শিশুর বিচার ব্যবস্থায় মূল আইনসমূহ যথা-শিশু আইনের ১৯৭৪ এর ৩১ ধারায়, শিশু বিধি ১৯৭৬ এর ২১ ধারায় এবং প্রবেশন অপরাধী অধ্যাদেশ, ১৯৬০ (১৯৬৪ সালে সংশোধিত)-এর ১৩ ধারায় ‘প্রবেশন অফিসারের দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্ণিত হয়েছে। ১৯৬০ সালের প্রবেশন অপরাধী অধ্যাদেশের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে সংশোধনমূলক কার্যক্রম চালু হয়। এ অধ্যাদেশের আওতায় কোন শিশুর প্রথম ও লঘু অপরাধের বিচার পরিচালনা ও রায় প্রদানকালে তাকে কারাগারে রাখার পরিবর্তে মানবিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন কোন নিরাপদ আশ্রয়স্থলে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য প্রথম ও লঘু অপরাধে সংবেদনশীল প্রাপ্ত বয়স্ক অপরাধীদেরও প্রবেশনে রাখার বিধান এ আইনে রয়েছে। তবে শিশু ও কিশোরদের জন্য প্রবেশন ব্যবস্থার বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তান আমলে প্রণীত প্রবেশন আইনটি যেমন পুরোনো তেমনি যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। শিশু আইনটি কার্যকর করার জন্য ১৯৭৬ সালে শিশু বিধিমালা প্রবর্তন করা হলেও এ পর্যন্ত প্রবেশন কার্যক্রম পরিচালনা ও বাস্তবায়ন করার কোনো ধরনের নীতিমালা নেই।

শিশু আইনের অধীনে প্রবেশন কর্মকর্তার দায়িত্ব শিশু অপরাধীর গ্রেফতার থেকে শুরু করে তার সংশোধন ও সমাজে তাকে পুনর্বাসন পর্যন্ত বিস্তৃত। আইন অনুযায়ী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের পর গ্রেফতারকৃত শিশুর সমস্ত দায়দায়িত্ব প্রবেশন কর্মকর্তাদের। শিশু আইনের ৫২ ধারা অনুয়ায়ী পুলিশ কোনো শিশুকে প্রেফতারের পরপরই তা প্রবেশন কর্মকর্তাকে জানাবে। প্রবেশন কর্মকর্তা তখন পূর্ববতী সব ঘটনা ও পারিবারিক ইতিহাস এবং অন্যান্য অবস্থার তত্য সংগ্রহ করবে, যা আদালতকে তার নির্দেশনা দিতে সাহায্য করবে। কিন্তু বাস্তবে পুলিশ অফিসার প্রবেশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখার নজির দেখা যায় না। ফলে এ বিষয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কোন কাজ হয় না।

প্রবেশন আইন অনুসারে দেশের ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট আদালত অর্থাৎ হাইকোর্ট বিভাগ, জেলার দায়রা আদালত, জুডিসিয়াল ম্যজিস্ট্রেট এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোনো ম্যজিষ্ট্রেট প্রথম ও লঘু অপরাধে জড়িত শিশু, কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে শর্ত সাপেক্ষে সর্বনি¤œ ১ বছর ও সর্বোচ্চ ৩ বছরের জন্য প্রবেশন মঞ্জুর করতে পারেন। তবে প্রবেশন দেওয়ার এই ক্ষমতা শুধুমাত্র বিচারকারী আদালত নির্ধারণ করে থাকেন। প্রবেশন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক রূপ হচ্ছে আদালত কর্তৃক নিয়োজিত প্রবেশন অফিসারের অধীনে অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের সামাজিক ব্যবস্থায় সমাজে স্থান দেয়া ও তত্ত¡াবধান করা। যে শিশুরা প্রবেশনের অধীনে থাকে তাদেরকে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত কিছু শর্ত ও নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। শিশুরা এসব শর্ত ও নিয়ম মানতে ব্যর্থ হলে তাদের উপর থেকে প্রবেশন নির্দেশ প্রত্যাহার করা হয়।

এভাবে আদালত শিশু আইনের অধীনে শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের অনুর্ধ্ব তিন বছরের জন্য ভালো হবার শর্তে প্রবেশনের অধীনে ছেড়ে দিতে পারে। আদালত যদি প্রবেশন অফিসারের কাছ থেকে এমন প্রতিবেদন পায় যে, উক্ত শিশু প্রবেশনাধীন সময়ে ভাল আচরন করেনি, তাহলে বাকি সময়ের জন্য তাকে কোনো অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে আটকাদেশ দিতে পারে। ব্যতিক্রম হলো, প্রবেশন অপরাধী অধ্যাদেশ, ১৯৬০ আদালতকে শাস্তিযোগ্য অপরাধীদের প্রবেশনের ক্ষমতা দিলেও মৃত্যুদÐযোগ্য, যাবজ্জীবন কারাদÐযোগ্য ও ফৌজদারি দÐবিধির অধীনে অন্যান্য আরো কিছু অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। তবে প্রবশন ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদের কারাদন্ডের একটি বিকল্প হিসেবে প্রবেশনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও বিচার ব্যবস্থায় এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় না।

শিশু আইন সরকারকে প্রতিটি জেলায় প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষমতা দিয়েছে এবং যেখানে এ ধরনের একজন ব্যক্তি নিয়োজিত আছে সেখানে ঐ জেলার আদালত কর্তৃক কোনো নির্দিষ্ট কেসের প্রয়োজনের সময় অন্য আরেকজন প্রবেশন কর্মকর্তা নিয়োগ করা যেতে পারে। আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে যে প্রবেশন কর্মকর্তা তার দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কিশোর আদালতের অধীনে থাকবে অথবা যদি কিশোর আদালত না থাকে তাহলে ফৌজদারি আদালতের অধীনে থাকবে।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, প্রবেশন আইনটি ১৯৬৪ সালে সংশোধিত হলেও ৪৬ বছর ধরে আমাদের দেশে প্রবেশন কার্যক্রম পরিচালনার কোনো নীতিমালা তৈরী হয়নি। এমনকি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রবেশন অফিসারও নেই। বর্তমানে ৬৪টি জেলার মধ্যে মাত্র ২২টি জেলাতে ২৩ জন প্রবেশন অফিসার আছে। বাকী ৪২টি জেলার মধ্যে ২১টি জেলায় প্রবেশন অফিসারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু এখনও তা অনুমোদন হয়নি। উক্ত ৪২ জেলায় উপজেলা সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রবেশন অফিসারের দায়িত্ব পালন করছে। অন্যদিকে ৪৮২টি উপজেলার সমাজসেবা অফিসার নিয়োজিত আছে যারা নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রবেশন অফিসারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এই দায়িত্বটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত মনোযোগের সাথে করতে হয়। তাই এটি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে করা কখনও পর্যাপ্ত হতে পারে না।

শিশুদের বেড়ে ওঠার উপর দেশের ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু শিশুরা তাদের কাজের পরিণতি যেমন বুঝতে পারে না, তেমনি নিজেদের রক্ষা করতেও অসমর্থ। তাই শিশুকে সংশোধন করে সৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। সুতরাং অপরাধ বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রবেশন কার্যক্রম ফলপ্রসূ ও যুগোপযোগী করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। প্রত্যেক জেলায় সংশোধনমূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত উপযুক্ত সংখ্যক প্রবেশন অফিসার নিয়োগ করা প্রয়োজন এবং প্রবেশন কার্যক্রম যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণকে প্রবেশন আইন সর্ম্পকে সচেতন এবং প্রয়োগ করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশু আইনের সাথে প্রবেশন আইনের সঠিক বাস্তবায়ন হলে শিশুদের অপরাধ মুক্ত করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সহজ হবে।

 



 

Show all comments
  • jack ali ৬ মার্চ, ২০২০, ৯:১৮ পিএম says : 0
    Allah is the creator--- our country is ruled by Taguth... When we rule our country by the Law of Allah [SWT] then there will be no problem at all... we will live in peace and prosperity... that's the only solution..
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আইন


আরও
আরও পড়ুন