Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রাণহীন প্রমত্তা পদ্মা

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতু পয়েন্টে মৃতপ্রায় রূপ

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

ভারতের পানি আগ্রাসনে প্রমত্তা পদ্মা কাঁদছে। প্রাণহীন হয়ে পড়েছে পদ্মা। নদীদেহের অন্যতম হৃদপিন্ড পদ্মা সর্বনাশা ফারাক্কা বাঁধের কারণেই স্পন্দনহীন। পদ্মায় পানি নেই, কোনরকমে চুইয়ে পড়ছে গড়াইয়ে। পানি আছে পদ্মাপাড়ের মানুষের চোখে। পদ্মার বুক জুড়ে চলছে হাহাকার। হার্ডিঞ্জ পয়েন্টে দাঁড়ানো বৃদ্ধ ভেড়ামারার মোশাররফ হোসেনের কাছে পদ্মার কী অবস্থা জিজ্ঞাসা করতেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন, ‘পদ্মার আর খোঁজ নিয়ে কী হবে? পদ্মা তো প্রায় শেষ। বাঁচার কোন পথই নেই। পদ্মায় পানি নেই, আছে শুধু বালু আর বালু। ঐ যে দেখছেন না কোনরকমে চুইয়ে পড়ছে পানি, ওটাকে কী নদী বলা যায়?’ আসলেই শূন্য গভীরে যেন অণু। বিশাল নদীতে এক চিলতে পানি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর উপর দাঁড়ালে পদ্মার আসল রূপ দেখা যাবে। বিশাল পদ্মা পরিণত হয়েছে মরা খালে। পাল তুলে নৌকা যাতায়াত তো দুরের কথা, পদ্মা পায়ে হেঁেটও পার হওয়া যায়।
পদ্মার দুইপাড়ে ভেড়ামারা ও ঈশ্বরদী পয়েন্টে সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মা খাঁ খাঁ করছে। পদ্মায় সেই ঢেউ নেই। নেই স্রোত। পদ্মার বর্তমান চেহারা দেখলে যে কারো প্রাণ কেঁদে উঠবে। ভারতের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে পদ্মার যৌবন হারিয়ে গেছে বেশ আগেই। এখন হাঁড় জিরজিরে দেহ নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। পদ্মার চিরচেনা চেহারা দ্রুত বদলে গেল, চোখের সামনেই ধুকে ধুকে মৃতপথযাত্রী হল। অথচ কোন বাদ-প্রতিবাদ হলো না। ভারত আর্ন্তজাতিক আইন লংঘন করে পানি প্রত্যাহারের ফলে পদ্মার এই দশা। পদ্মা ও গড়াইয়ের অবস্থা যদি এই হয় তাহলে এর শাখা নদ-নদীর অবস্থা কী তা সহজেই অনুমান করা যায়। নদ-নদীর পানি শূন্যতায় মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রাণীকুল, জলজ, উদ্ভিদ, বনজ, মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশের অপুরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়ছে। জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে। সূত্রমতে, নদ-নদীতে পানি প্রবাহ কম হওয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এবং মংলা সমুদ্রবন্দর ও নওয়াপাড়া নদীবন্দর হচ্ছে ক্ষতির সন্মুখীন। স্রোতহীন হওয়ায় লবনাক্ততা গ্রাস করছে নতুন এলাকা। দেশের বৃহত্তম গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প (জিকে প্রজেক্ট) মহাসঙ্কটে।
গত কয়েকদিন গোটা এলাকা ঘুরে জানা যায়, পদ্মা ও গড়াইয়ের উপর নির্ভরশীল দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য। ভারত ফারাক্কা বাঁধে গঙ্গার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় পদ্মাপাড় থেকে সমুদ্রপাড়ের গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার ২২ হাজার ৭শ’ ৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকার নদ-নদীর অবস্থা দিনে দিনে করুণ হয়ে পড়েছে। পদ্মা ও গড়াইএর শাখা নদ-নদী চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা, শৈলকুপার কুমার নদী, ঝিনাইদহ ও মাগুরার নবগঙ্গা, যশোরের ভৈরব, মুক্তেশ্বরী ও কপোতাক্ষ, নড়াইলের চিত্রা ও মধুমতি, কালীগঞ্জের চিত্রাসহ ছোট-বড় প্রায় ২৬টি নদ-নদীতে শুষ্ক মৌসুম শুরুর প্রাক্কালেই প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। ফারাক্কার ধাক্কা আর সহ্য করতে পারছে না নদ-নদী। ক্রমেই কাতর হয়ে পড়ছে। এবারের ভরা শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদীর অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ার আশঙ্কা করেছেন নদী বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা। ইতোমধ্যেই ভূপৃষ্ঠের পানি কমতে শুরু করেছে। চাষাবাদ এখন পুরোপুরি ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর ক’দিন পরই পানির নাগাল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগ সূত্র জানায়, নদ-নদীর অবস্থা খুবই খারাপ। বেশীরভাগই স্রোতহীন হয়ে পড়েছে। মধুমতির বড়দিয়া পয়েন্টে পানি জরিপের তথ্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। হাইড্রোলজি বিভাগ বলেছে, পানি জরিপ অব্যাহত রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের রিপোর্ট হচ্ছে, সব নদ-নদীই শুকিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে পদ্মা থেকে বের হওয়া মাথাভাঙ্গা নদী এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টের তালবাড়িয়ায় গড়াই নদীর উৎস মুখে পানি প্রবাহ কমে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ সংশিষ্ট বিভাগগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতে, নদী, খাল-বিলের পানিশূন্যতা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে।
সূত্র আরো জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মোট ২৬টি শাখা প্রশাখা নদ-নদী, ১ হাজার ৭শ’ ৮১টি খাল-বিল ও ৯৫ হাজার ৮শ’৭৯টি পুকুর ও দীঘি রয়েছে। যার সিংহভাগই প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। চলতি মৌসুমে এই অঞ্চলের প্রায় ৬লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের প্রস্ততি চলছে। একযোগে চলবে গোটা অঞ্চলে ৩লাখ ৩৬হাজার ৯শ’২৫টি অগভীর নলকুপ ও ৩হাজার ২শ’৮৮টি গভীর নলকূপসহ প্রায় ৫লাখ সেচযন্ত্র। এছাড়া ঘর-গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত টিউবওয়েল, মোটর ও পৌরসভাগুলোর পাম্পহাউজ তো আছেই। ফলে ভূপৃষ্টের মতো ভূগর্ভস্থ পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়ার আশংকা থাকবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. আখতারুজ্জামান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেছেন. নদ-নদী, খাল-বিলে পানি একেবারেই কমে যাওয়ায় অব্যাহতভাবে ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ পড়ছে। সেজন্য কৃষি বিজ্ঞানীরা সেচ সাশ্রয়ে বিকল্প পদ্ধতি বের করতে বাধ্য হয়েছেন। ইতোমধ্যেই এডব্লিউডি (অলটারনেট ওয়েটিং এন্ড ড্রাইয়িং) পদ্ধতিতে সেচ সাশ্রয়ের কাজ শুরু হয়েছে। সূত্র জানায়, শুষ্ক মৌসুমকে ‘বিপজ্জনক মৌসুম’ বলা হয়ে থাকে। একসময় নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি দিয়ে দোনা ও সেউতি পদ্ধতিতে সেচ দিয়ে চাষাবাদ হতো। এখন আর সেই সুযোগ নেই। সেচনির্ভর কৃষি জমিতে চাষাবাদে ভূপৃষ্ঠের পানির অভাবে পুরোপুরি ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করতে হচ্ছেন কৃষকরা।



 

Show all comments
  • parvez ২ মার্চ, ২০২০, ১০:০৫ এএম says : 0
    পদ্মার ব্রিজ রে .........
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Kowaj Ali khan ২ মার্চ, ২০২০, ১০:৪৪ এএম says : 0
    জাতীয় বেঈমান ভারতীয় দালাল হটাও। ইনশাআল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পদ্মা

১১ জানুয়ারি, ২০২৩
৩১ অক্টোবর, ২০২২
৪ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ