পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অর্ধেকই সরকারি ব্যাংকগুলোর। গত শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। খেলাপি ঋণের পরিমাণ যে লাখ কোটি টাকার অংক ছাড়িয়ে গেছে সেই তথ্য গত দু’মাস হল শোনা যাচ্ছে এবং বিষয়টি নিয়ে লেখা লেখিও চলছে। ধারণা করা হয়েছিল যে, খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না। বরং, সেটি দ্রুত লক্ষ কোটি টাকার অংকের নিচে আসবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গত বছরের শেষের দিক থেকে শুরু করে চলতি বছরের মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র দেড় দুই মাসে বৃদ্ধি পেয়েছে ২১ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। আরও ধারণা করা হয়েছিল যে, খেলাপি ঋণের এই বিশাল অংক পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। সেই সাথে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ঋণ খেলাপিদের পরিচিতি জনসমক্ষে উন্মোচন করার উদ্দেশ্যে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম মুস্তফা কামালের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তিনি গত বছরের ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ৮ হাজার ঋণ খেলাপির একটি তালিকা প্রকাশ করেন। এর আগে গত বছরের জুনে সংসদে ২০০ ঋণ খেলাপির তালিখা প্রকাশ করা হয়। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১১ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৪ হাজার ৩শত ১৩ কোটি টাকা। বর্তমানে অর্থাৎ চলতি ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে সেটি দাঁড়ায় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধির পরিমাণ ৯৩ হাজার ৬ শত ৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্য আবার ৫০ হাজার ১ শত ৮৬ কোটি টাকার মত বিশাল অংকের খেলাপি ঋণ পুনর্বিন্যাস (ৎবংপযবফঁষবফ) করা হয়েছে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম মুস্তফা কামালের কিছু তথ্যে ব্যাংকিং খাতে পরিচালকদের প্রভাবের উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। অর্থমন্ত্রী এই প্রথমবারের মতো সংসদে ব্যাংক পরিচালকদের ঋণের ব্যাপারে একটি স্টেটমেন্ট উপস্থাপন করেছেন। এতে দেখা যায়, দেশের ৫৫টি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা ১ লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ব্যাংকগুলোর প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ ১২ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ পরিচালকদের নিকট প্রদত্ত ঋণ মোট ঋণের ১৩.৭৬ শতাংশ।
চলতি ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে একটি বাংলা দৈনিকে ঋণ খেলাপিদের সম্পর্কে একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে। ঐ খবরে বলা হয়েছে যে, কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ.হ. ম. মুস্তফা কামাল দুদক সরবরাহকৃত ২০০ জন ঋণ খেলাপির তালিকা পেশ করেছেন। এই ২০০ জনের মধ্যে কয়েক জনের নাম আলোচ্য সংবাদে প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ঐসব ব্যক্তিসহ ঐ ২০০ ঋণ খেলাপি ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছিলেন সেই ঋণের টাকা শোধ না করে তার মধ্য থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। তালিকায় যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকে শুধুমাত্র টাকাই পাচার করেননি, তারা সপরিবারে ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন এবং এখন বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ইনভেস্টর বা বিনিয়োগকারী, সেকেন্ড হোম ইত্যাদি বিভিন্ন ক্যাটাগরি অনুযায়ী এরা বিদেশের নাগরিকত্ব বা স্থায়ী আবাসনের অধিকার লাভ করেছেন। ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এসব ঋণ খেলাপি এবং অর্থ পাচারকারীদের নাম বিক্ষিপ্তভাবে এবং আংশিকভাবে এসেছে। তবে এসব রিপোর্ট একত্রে সংকলিত করলে মোটামুটি একটি চিত্র পাওয়া যায়। সেই চিত্র থেকে দেখা যায় যে, ২০১১-২০১২ সালে হলমার্ক গ্রæপ সোনালী ব্যাংক থেকে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়। বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে ১২০০ কোটি টাকা ঋণ নেয় এবং তার সম্পূর্ণ অর্থই বিদেশে পাচার করে। বেসিক ব্যাংকের সাবেক কর্ণধার আব্দুল হাই বাচ্চুর অর্থ লুটপাটের কাহিনী এখন মশহুর। কয়েক মাস আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র এবং সাবেক এমপি ফজলে নূর তাপস প্রশ্ন রেখেছিলেন যে, দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চলছে, সেটি ভালো কথা। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করার পরেও আব্দুল হাই বাচ্চু এখনও প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কীভাবে? বেসিক ব্যাংকের সাবেক এমডি ফখরুল ইসলাম ঐ লুটপাটের সাথে জড়িত ছিলেন। এখন তিনি কানাডায় আছেন।
দুই
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক যে ২০০ ব্যক্তির তালিকা দুদক সরকারের কাছে প্রেরণ করেছে ওদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের ওপর পড়েছে এক গুরু দায়িত্ব। তিনি জনসমক্ষে এখন অনেক সত্য উদঘাটন করছেন যেগুলো এর আগে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং সচেতন জনগণের মুখে উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রী সেসব ঘটনার কোনো কোনোটিকে সামান্য অর্থ বলে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনকে তিনি সামান্য অর্থ বলেছেন। কিন্তু মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এক শ্রেণির ব্যাংক মালিক ও পরিচালকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে, আপনারা অন্যায় এবং নিয়ম বহির্ভূত কাজ করবেন আর গালি শুনতে হবে আমাকে (অর্থাৎ অর্থমন্ত্রীকে)।
বিষয়টিকে অর্থমন্ত্রী সিরিয়াসলি গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। তাই ব্যাংকিং সেক্টরে সমস্ত অনিয়ম ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখার জন্য একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা হবে বলে তিনি ঘোষণা করেছেন। রবিবার এই কলাম লেখার সময় পর্যন্ত কমিশন প্রধানের নাম ঘোষণা করা না হলেও অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদুদ্দিন মাহমুদের নাম জোরে শোরে শোনা যাচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি’র দুই জন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং ড. মোস্তাফিজুর রহমান ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। গত শনিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে তারা একই সঙ্গে একথাও বলেছেন যে, প্রস্তাবিত কমিশনকে যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া না হয় তাহলে কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। সিপিডি’র ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে আরও বলা হয় যে, গুটি কয়েক ব্যক্তি ও গোষ্ঠির কাছে পুরো ব্যাংক খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে যে, অর্থনৈতিক সমস্যা এখন রাজনৈতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সিপিডি বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করছে না। ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা, স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ কারণে ব্যাংক কমিশন গঠন করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
এ কমিশনের সফলতার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের পূর্ণ সমর্থন থাকতে হবে। তা না হলে ব্যাংক খাতের কার্যকর পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। দেবপ্রিয় বলেন, এ মুহূর্তে ব্যাংক খাত নিয়ে আস্থার সঙ্কট আছে। একটা স্বচ্ছতার সঙ্কট আছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ^স্ততার সঙ্কট কাটিয়ে উঠে এ কমিশনকে (ব্যাংকিং কমিশন) কাজ করতে হবে।
তিন
এই মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক ফ্রন্ট শান্ত। পরিস্থিতি অশান্ত হওয়ার কোনো আলামত দৃশ্যমান নয়। কিন্তু অর্থনৈতিক ফ্রন্টে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে, পরিস্থিতি ভালো নয়। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরু দায়িত্ব পড়েছে অর্থমন্ত্রীর ওপর। তিনিই কয়েকদিন আগে বলেছেন যে, অর্থনীতির অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। এই চরম সত্যি কথা বলার জন্য অর্থমন্ত্রী ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এবছর বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অথচ অর্থবছরের ৬ মাসের মধ্যেই সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৫১ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ইতোমধ্যেই ৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। বাকী ৬ মাসে কী অবস্থা হবে সেটি অনুমান করতে কষ্ট হয় না। একদিকে যেমন ঋণ নিয়ে চলছে সরকার, পাশাপাশি বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত এবং সেক্টর কর্পোরেশনের উদ্বৃত্ত অর্থও তুলে নেওয়া হচ্ছে।
সঞ্চয়পত্রের সুদের হার প্রায় অর্ধেক কমানো নিয়ে দেশে জনগণের মধ্যে নীরবে প্রবল অসন্তোষ বিরাজ করছিল। প্রথমে মানুষ ভেবেছিল যে সব ধরণের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছে। অবশ্য পরে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, শুধুমাত্র ডাকঘর সঞ্চয়পত্র স্কিমের সুদের হার কমানো হয়েছে। ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো নিয়েও ঐ সঞ্চয় স্কিমের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছিল। এখনও সেই অসন্তোষ কাটেনি। তবে জনগণ অপেক্ষা করছে। ৩ বছর মেয়াদী ডাকঘর স্থায়ী আমানতের সুদের হার ১১.২৮ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫.২৮ শতাংশ সুদ হ্রাসের ফলে এই ধরনের স্থায়ী আমানত ভেঙে ফেলার হিড়িক পড়েছে। হিড়িক এত প্রবল যে, স্থায়ী আমানত ভাঙলে সরকার নগদ অর্থ দিতে পারছে না। দিচ্ছে চেক। সেই চেক পেতেও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে দুইদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রেও অর্থমন্ত্রী জনগণের নাড়ির স্পন্দন শুনতে পেরেছেন বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন যে, ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা হবে এবং সেটি হ্রাস করা হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।