Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পলিথিনের অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন রুখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

পলিথিনের ক্ষতি যে বহুমুখী, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। পরিবেশের জন্য স্থায়ী ক্ষতিকর কোনো বর্জ্য যদি থেকে থাকে, তবে তা পলিথিন। এটি এমনই এক পদার্থ যা পচনশীল বা মিলিয়ে যাওয়ার নয়। বলা হয়, ১০০ বছরেও পলিথিন পচে না, মাটিতে মেশে না। এর থেকে নিঃসরিত বিষাক্ত কেমিক্যাল পরিবেশ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোতে যে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে পলিথিন। পুরো ড্রেনেজ ব্যবস্থা এই বস্তুটি ধ্বংস করে দিচ্ছে। পরিবেশ দূষণ এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এই পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলে লোক দেখানো অভিযান শুরু হয়। তারপর আবার যেই সেই অবস্থা। কোনোভাবেই এর উৎপাদন, বিপনন এবং ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। এর ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে ২০০৩ সালে বেশ জোরেসোরে অভিযান শুরু হলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। তখন পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হয়। সরকারি পর্যায়ে পাটের ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই সচেতনতামূলক এই কার্যক্রম থেমে যায়। পলিথিন পুনরায় ফিরে আসে। অদ্যাবধি তা সদর্পে বাজার দখল করে আছে।
আমরা যে রাজধানীর পরিবেশ দূষণের কথা বলি, এর মধ্যে যে সবচেয়ে বড় দূষণের উৎস পলিথিন। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে পলিথিন ব্যবহার করছি। কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে অভিজাত শপিং মলে কেনাকাটা করতে গেলে এই পলিথিনের ব্যাগেই পণ্য নিয়ে আসছি। বাসায় ফিরেই এসব ব্যাগ ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলছি এবং তা সড়ক-মহাসড়কে ছড়িয়ে পড়ে ড্রেনে গিয়ে পড়ছে। রাজধানীর যে ২০ শতাংশ ড্রেনেজ ব্যবস্থা রয়েছে, তা বিকল করে দিচ্ছে পলিথিন। বৃষ্টিতে রাস্তা-ঘাট ডুবে যাওয়ার সময় দেখা যায়, পানিতে কেবল পলিথিন ভাসছে এবং ড্রেনের পানি প্রবাহের মুখে পলিথিন আটকে আছে। ক্ষতিকারক এই বস্তুটি যে শুধু রাজধানীর ড্রেনেজ সিস্টেম বিকল করে দিচ্ছে তা নয়, আশপাশের নদ-নদীর নাব্যও নষ্ট করে দিচ্ছে। বুড়িগঙ্গার নাব্য ফেরানো এবং দূষণমুক্ত করার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তা ভেস্তে গেছে মূলত এই পলিথিনের জন্য। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ড্রেজিং করতে গিয়ে দেখে এর তলদেশে ৬ ফুট পলিথিনের স্তর জমা হয়ে রয়েছে। এই পলিথিন তুলে আনা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। ফলে বুড়িগঙ্গার নাব্য ফেরানো ও দূষণমুক্ত করার কাজটি থেমে যায়। পলিথিন যে শুধু বুড়িগঙ্গাকে অচল করে দিয়েছে তা নয়, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামসহ অন্যান্য শহর এবং তার পাশের নদ-নদীকেও অচল করে দিচ্ছে। রাজধানীতে দিনে কত পরিমাণ পলিথিন উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে দোকানে এবং মানুষের হাতে হাতে পলিথিনের ব্যাগ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এর পরিমাণ সীমাছাড়া। এ ব্যাপারে কারো মধ্যেই কোনো ধরনের সচেতনতা নেই কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন করারও কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। অথচ গবেষকরা বলছেন, পলিথিনে বহন করা খাদ্যপণ্য স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রেস্টুরেন্ট থেকে পলিথিনে করে যে খাবার সরবরাহ করা হয়, তাতে পলিথিন থেকে নিঃসরিত বিষাক্ত কেমিক্যাল খাবারের সাথে মিশ্রিত হয়। এর ফলে মানবদেহে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগ দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে গবেষকরা দেখিয়েছেন, রাজধানীতে ১৩ প্রজাতির মশা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। এসবের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে ড্রেন ও জমে থাকা দূষিত পানি। পানি সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে পলিথিন এবং এ জাতীয় অন্যান্য প্যাকেট বাধা হয়ে আছে। দুঃখের বিষয়, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এই পলিথিনই এখন বেশুমার ব্যবহৃত হচ্ছে। এ নিয়ে কারো মধ্যে কোনো বিচলন নেই। আরও পরিতাপের বিষয়, পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও তা বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। ফলে পলিথিনের উৎপাদন যেমন বন্ধ হচ্ছে না, তেমনি এর ব্যবহারও চলছে অবাধে।
রাজধানী বসবাসের উপযোগিতা অনেক আগেই হারিয়েছে। যানজট, দখল-দূষণ এবং অপরিকল্পিত সম্প্রসারণের কারণে এটি অসভ্য, অবাসযোগ্য এবং হতাশার নগরী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এ থেকে উত্তরণে নগর কর্তৃপক্ষ তো বটেই, সরকারের পক্ষ থেকেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। বিশ্লেষকরা এখন এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন, জেনেশুনে এবং বুঝে রাজধানীকে একটি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত করার এক গভীর ষড়যন্ত্র যেন চলছে। তা নাহলে, এসব সমস্যা সমাধানে ন্যূনতম কোনো উদ্যোগ থাকবে না কেন? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কেন নির্বিকার হয়ে থাকবে? এই যে পলিথিনের রাজত্ব চলছে এবং তা রাজধানীর পুরো ড্রেনেজ সিস্টেম অচল করে দিচ্ছে, তা বন্ধে কেন কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না? কর্তৃপক্ষ চাইলে পলিথিনের ব্যবহার স্বল্পতম সময়ে বন্ধ করে দিতে পারে। এর উৎপাদনের উপকরণের আমদানি নিষিদ্ধ করে দিলেই তা মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ কাজটি করা হচ্ছে না কেন? যে পলিথিন পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে রয়েছে, তা বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কেন এই উদাসীনতা? আমরা মনে করি, পলিথিনের কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা বন্ধে এখনই কর্তৃপক্ষকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে এর উৎপাদন, বিপণন এবং ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এর পরিবর্তে পাট, কাপড় বা অন্যান্য পচনশীল উপকরণে তৈরি ব্যাগ ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারসহ পরিবেশবিদদের বিভিন্ন প্রচারণামূলক কার্যক্রম নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পলিথিন

১৪ আগস্ট, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন