Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নির্মম বাস্তবতা

মূল: আহমেদ আল হারুন

অনুবাদ: ইশতিয়াক মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৩২ এএম

সেই রাতটি ছিল শীতল এবং অমাবশ্যার অন্ধকারে ঢাকা। বিদ্যুৎ সংযোগও ছিল বিচ্ছিন্ন। মাঝে মাঝে শিশুদের কান্না ও চারদিক থেকে ভেসে আসা গুলির শব্দ ছাড়া আর সব ছিল নিস্তব্ধ। দীর্ঘ দিন ধরেই আমাদের ছোট্ট সেই শহরে মৃত্যুর বিভীষিকা বিরাজ করছিল। মনে হতো অনন্তকাল ধরে চলবে এই অবস্থা। মাঝখানে কয়েকটি মোমবাতি জ্বালিয়ে তার চারপাশ ঘিরে বৃত্ত রচনা করে আমরা সবাই বসেছিলাম। আমাদের দৃষ্টি ছিল সেগুলোর ক্ষীণ শিখার উপর নিবদ্ধ। এই আলোই ছিল আমাদের একমাত্র সম্বল, যা আমাদেরকে সুরক্ষিত রাখার মতো এক ধরণের অনুভূতি দিত। এতটুকুর জন্যই আমরা বুভুক্ষের বসে থাকতাম।

এর মাঝেই কেউ কেউ ঘুমিয়ে যেত। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, আর কোনদিনই হয়তো ভাঙবে না এটা জেনেও কোন মানুষের পক্ষে কিভাবে ঘুমানো সম্ভব। আমি আমার বহণযোগ্য ছোট রেডিওটি চালু করলাম, এক সময় এটিরও সুদিন ছিল। আমি টিউনিংয়ের নবটি আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে সংকেত পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আশা করছিলাম মহান আল্লাহু প্রেরিত কোন শুভ সংকেত পাবো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে আমি হাল ছেড়ে দিলাম। আমার পুরানো রেডিওটির সামর্থ্য আর খুব কমই অবশিষ্ট ছিল। তবে এর ভয়াবহ খ্যাচ ক্যাচ শব্দও আমাকে স্বস্তি দিত যে, অন্তত ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যায় আমাকে এখনই পড়তে হচ্ছে না। যদিও, সত্যি কথা বলতে, আমার মনে হত এই অন্ধকার এবং ভয়ঙ্কর রাত কাটাতে এটি আমার কোন কাজেই আসবে না।

হঠাৎ, কাছেই প্রচন্ড কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আতঙ্কের একটি অনুভ‚তি আমাকে চেপে ধরল। মাথার উপর দিয়ে কম্বল টেনে আমি তার ভেতরে শুয়ে পড়লাম। আমি চোখ বন্ধ করে রেখে এই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যেও আমার মনে হচ্ছিল যে, কফিনে শুয়ে থাকা কোন মমির মতো দেখাচ্ছে আমাকে। যদি এমন চিন্তা মাথায় নিয়ে আমি ঘুমিয়ে যাই, আমার ভয় হচ্ছিল, তাহলে আমি সত্যি সত্যি হয়তো তেমন একটিতেই পরিণত হয়ে যাব। আমি বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বাতাসে ধাক্কা খেয়ে সর সর শব্দে বালি সরে যাচ্ছিল। তারপরে, প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়ে গেল। তার সঙ্গে নামল মুষলধারে বৃষ্টি। বাবার জন্য আমার ভয়ঙ্কর দুঃচিন্তা আমাকে কাহিল করে ফেলছিল। অনেকক্ষণ হল তিনি ভেড়ার পাল নিয়ে মাঠে চড়াতে গিয়েছেন।

এভাবে জানিনা কত সময় কেটে গিয়েছিল। হঠাৎ করে, আমি ভেড়ার পালের সমস্বরে ব্য ব্য ডাক শুনতে পেলাম। আমি দরজা খুলতে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তারপরেই আমি অনুভব করলাম, আমি আসলে একরকম ঘোড়ের মধ্যে চলে গিয়েছি। সেখান থেকে নিষ্ঠুর বাস্তবতায় ফিরে আসতে চাইলেও আমার বেঁচে থাকার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আমাকে বাঁধা দিচ্ছিল। নিজের উপরে আমার কোন নিয়ন্ত্রণই ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ সময় ধরে অনেক চেষ্টার পর অবশেষে আমি নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলাম। চোখ খুলতে পারা মাত্রই আমি লাইটার জ্বালিয়ে নিলাম, যাতে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে দ্রুত আমি দরজার কাছে যেতে পারি। ছুটে যেয়ে দরজা খুলে দেখলাম, ওপাশে আমার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি পুরো ভিজে গিয়েছিলেন এবং প্রচন্ড ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছিলেন। আমি তাকে ধরে ভেতরে নিয়ে আসলাম এবং কিছু খাবার তার সামনে এনে দিলাম। এর মধ্যেই আমার লাইটারের স্ফুলিঙ্গ জ্বালানোর চাকাটি প্রচন্ড গরম হয়ে উঠেছিল। পুড়ে যাওয়া থেকে আঙ্গুল বাঁচাতে আমি লাইটার হাত বদল করে অন্য হাতে নিলাম। কিছুক্ষণ পরে, আমি বাবাকে দোতালায় উঠার পরামর্শ দিলাম। তাহলে আমরা আশে পাশে আরো ভালভাবে নজর রাখতে পারব এবং সামনে কোন বিপদ আসলে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারব। কিন্তু তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে অসম্মতি প্রকাশ করলেন এবং তার পরিবর্তে ইশারায় আমাকে বাড়ির বাইরে চলে যেতে বললেন। ইচ্ছা না থাকলেও আমি তার নির্দেশ পালন করলাম।
আমি আবার দরজা খুললাম এবং অবাক হয়ে দেখলাম, সব ভেড়া চলে গেছে। যুদ্ধের ফলে ঘটে যাওয়া অপ্রয়োজনীয় ধ্বংসলীলা সেগুলোকে আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছিল এবং মৃত্যুর ভয়ে তারা ছুটে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। একটি বাচ্চা ভেড়া কাঁটাতারের মধ্যে আটকা পড়েছিল এবং সেটির বুক থেকে রক্ত ঝড়ছিল। তারপরে আমি ঘরে ফিরে এসে দেখলাম তিনি মাটিতে পড়ে আছেন। কাছে যেয়ে বুঝতে পারলাম তার শরীরে গুলি লেগে মারান্তক ক্ষত তৈরি হয়েছিল। ‘অন্তত এখন তিনি বেহেশতে পৌঁছেছেন।’ আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘তাকে আর কখনও ছুটে পালাতে হবে না।’

আমি বাড়ির পাশের তালগাছের নিচে বসে অঝোরে কাঁদতে থাকলাম। আমার চারপাশ জুড়েই ছিল অসংখ্য লাশ। আমি মনে করার চেষ্টা করলাম, প্রথম গুলিটি কে চালিয়েছিল। কিন্তু তখন কেবল একটি মাত্র ছবিই আমার চোখে ফুটে উঠেছিল, জলন্ত এক সূর্য।

** দখলদার ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার পটভূমিতে ফিলিস্তিনি লেখক আহমেদ আল হারুনের লেখা একটি ছোট গল্প।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্মম

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
২৩ এপ্রিল, ২০১৯
২১ জানুয়ারি, ২০১৯
২৫ জুলাই, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন