Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বায়ুদূষণে অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি

| প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০৩ এএম

রাজধানীসহ দেশের বায়ুদূষণের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরেই এই দূষণ চলছে। এর প্রতিকারের কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি এবং হচ্ছে না। পরিস্থিতি এখন এতটাই গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে, রাজধানীর বায়ুদূষণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জরিপের তালিকায় শীর্ষ স্থান অক্ষুন্ন রেখে চলেছে। বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বে কখনো এক, কখনো দুই নম্বর শীর্ষ নগরী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। বর্তমানে এক নম্বর স্থানটি দখল করে আছে। বায়ুদূষণের প্রধানতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে নির্মাণ কাজের নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং রাজধানীর চারপাশের ইটভাটার ধোঁয়া। এসব কারণ চিহ্নিত হয়ে থাকলেও এর প্রতিকারের কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। রাজধানীসহ দেশের এই দূষণে স্বাস্থ্যগত যে ক্ষতি, তা কোন কিছু দিয়েই পরিমাপ করা যায় না। তবে স্বাস্থ্যগত এই ক্ষতির পাশাপাশি প্রথমবারের মতো আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উঠে এসেছে। গত বুধবার সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার এবং গ্রিণপিসের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া শাখার করা এক গবেষণামূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, যা দেশের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। আর্থিক ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে, চিকিৎসা খরচ, কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করে। প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের কারণে শিশুর অকালমৃত্যুর একটি হিসাবও দেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে এ কারণে দেশে ৯৬ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

রাজধানী যে ধুলোর রাজ্যে পরিণত হয়েছে, তা একবাক্যে সবাই স্বীকার করবেন। এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে ধুলার মিহি আস্তরণ মানুষের চোখে পড়ে না। রাস্তার আশপাশের গাছগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এগুলোর সবুজপাতা ধুলার আস্তরণে ঢেকে মাটির পাতায় পরিণত হয়েছে। কতটা ভয়াবহ ধুলাদূষণ হলে এমনটি হতে পারে। তবে শুধু যে ধুলাদূষণই রাজধানীসহ দেশের শহরগুলো দূষিত হচ্ছে, তা নয়, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইটভাটা, শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত বায়ু পুরো পরিবেশকে দূষিত করে চলেছে। সাধারণত বায়ুতে যে পরিমাণ ক্ষতিকর সূ²কণা সহনীয় মাত্রায় থাকার কথা তা রাজধানীর বাতাসে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ধুলার পাশাপাশি কার্বন ডাই অক্সাইড, মনোঅক্সাইডের মতো বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এর সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। তারা হাঁপানি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ থেকে শুরু করে অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিই নয়, বায়ুদূষণের কারণে সুস্থ্য মানুষও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যারা একটু সচেতন তারা মাস্ক ব্যবহার করে চলাচল করছেন। বলা বাহুল্য, বায়ুদূষণ এমন যে তা ধনী-দরিদ্র বাছবিচার করে না। সকলেই এর শিকার হয়। এই দূষণ সর্বক্ষণই বিরাজমান। এর কোনো বিরতি নেই। রাজধানী যে শুধু বায়ুদূষণে ভারাক্রান্ত তা নয়, শব্দদূষণও অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। উন্নয়ন প্রকল্প, বাসাবাড়ি নির্মাণ, যানবাহনের উচ্চশব্দ এমনকি বিয়ে-সাদীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে গানবাজনা প্রতিনিয়ত শব্দদূষণ করে চলেছে। শব্দদূষণের মাত্রা এখন সীমাছাড়া হয়ে পড়েছে। এসব দূষণের সাথে ময়লা-আবর্জনা ও দূষিত বর্জ্যরে দুর্গন্ধ যুক্ত হয়ে রাজধানীর পুরো পরিবেশ শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। এসব দূষণে নগরবাসী যেমন ক্রমাগত অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে, তেমনি আর্থিক ক্ষতিরও শিকার হচ্ছে। এই ক্ষতি এখন জিডিপিতে প্রভাব ফেলছে। এতদিন শোনা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায় জিডিপির ক্ষতি হয় ২ ভাগ, এখন এ ক্ষতি ছাড়িয়ে বায়ুদূষণ শীর্ষে উঠে এসেছে। এই দুই ক্ষতি জিডিপির প্রায় ৭ ভাগ খেয়ে ফেলছে। এ অবস্থা যদি হয়, তাহলে আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধির উলম্ফন নিয়ে যে গর্ব করছি এবং অর্থনীতির দ্রুত উন্নতি দাবি করছি, তা যে সঠিক বলে গণ্য হচ্ছে না, বোধকরি তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। দূষণের শিকার হয়ে যদি মানুষই মরে যায় এবং অসুস্থ্য হয়ে পড়ে, তাহলে এই অর্থনীতি ও উন্নয়ন কার কাজে আসবে? এ বিষয়গুলো নগর কর্তৃপক্ষসহ সরকার বিবেচনা করছে বলে মনে হয় না। বিবেচনায় নিলে নিশ্চয়ই দূষণ কমানো বা মাত্রা সহনীয় রাখার উদ্যোগ নিত।

দেশে দখল-দূষণ এমন এক অপসংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ থেকে পরিত্রাণের যেন কোনো উপায় নেই। নদী দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে বাঁধা, বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ফিটনেসবিহীন যানবাহন জব্দ করার ক্ষেত্রে বাঁধা, ইটভাটা উচ্ছেদে বাধা থেকে শুরু করে সব ধরনের দখল-দূষণে কেবল বাধা আর বাধা। এই বাধা দূর করার হিম্মত যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের নেই। ফলে এই অপসংস্কৃতি থেকে কোনোভাবেই বের হওয়া যাচ্ছে না। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে নগর কর্তৃপক্ষ যেন বৃষ্টি মৌসুমের আশায় বসে থাকে। তাদের মনোভাবই হচ্ছে, বৃষ্টি হলে ধুলোবালি ও বাতাসের বিষাক্ত কেমিক্যাল এমনিতেই ধুয়েমুছে যাবে, কাজেই সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয়। অথচ বায়ুদূষণের যতগুলো কারণ রয়েছে, তার প্রত্যেকটিই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এই অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বৃষ্টির আশায় নগর কর্তৃপক্ষের বসে থাকা বিস্ময়কর। বেশ কয়েক বছর আগে দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রাজধানীকে গ্রীণ সিটি করার ঘোষণা দেয়া হয়। এ নিয়ে কিছুদিন গাছগাছালি লাগানোর কার্যক্রমও চলে। তবে কিছুদিন না যেতেই তা বন্ধ হয়ে যায়। উল্টো উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের নামে গাছগাছালি কেটে সাফ করে ফেলা হয়। যেসব সড়ক বৃক্ষাচ্ছাদিত ছিল, সেগুলো এখন ধুলিময় হয়ে উঠেছে। রাজধানীকে সব ধরনের দূষণমুক্ত করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও কার্যক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। এভাবে কতদিন চলবে, তা আমরা জানি না। আমরা মনে করি, রাজধানীসহ দেশের দূষণযুক্ত অঞ্চল দূষণমুক্ত করার জন্য সরকারকে দ্রুত কার্যকরা পদক্ষেপ নিতে হবে। দূষণের উৎসগুলো নির্মূল করতে হবে। মানুষের শারীরিক ও দেশের অর্থনীতির ক্ষতি রুখতে এর বিকল্প নেই।



 

Show all comments
  • jack ali ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:৪৬ পিএম says : 0
    Our Government don't care about us... They live like a King an Queen-- Air Pollution don't touch them.....
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বায়ুদূষণ

২৫ জানুয়ারি, ২০২৩
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন