পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশে এখন কী ধরনের রাজনীতি চলছে, এমন প্রশ্ন যদি করা হয়, তবে অধিকাংশই বলবেন, এখন রাজনীতি বলতে কিছু নেই। রাজনৈতিক অঙ্গন শীতল এবং নিস্তেজ। তবে এর অর্থ এই নয়, রাজনীতি উত্তপ্ত বা সংঘাতপূর্ণ থাকবে। সুস্থ্য রাজনীতির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, সাধারণ মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণ নিয়ে কাজ করা। বিরোধী দলের রাজনীতির উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলা এবং সরকারের ভুল-ত্রু টি এবং দেশ ও জনস্বার্থবিরোধী কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা। অন্যদিকে সরকারি দলের মূল দায়িত্বই হচ্ছে, সাধারণ মানুষের সংকট সমস্যার সমাধনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়া। এক্ষেত্রে ভুল-ত্রæটি হওয়া অস্বাভাবিক নয় তবে ভুল-ত্রু টি বিরোধী দল ধরিয়ে দিলে তা আমলে নিয়ে সংশোধন করা। আমাদের দেশে রাজনীতির এই ধারা নেই বললেই চলে। এখানের রাজনীতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক। সরকারি দল ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এবং বিরোধী দল ক্ষমতায় যেতে সবসময় ব্যস্ত থাকে। এখন রাজনীতি কার্যত ঘরের ভেতর ঢুকে গেছে। সরকারি দলের রাজনীতির দিকে যদি তাকানো যায়, তবে দেখা যাবে তাদের রাজনীতি এখন আত্মকেন্দ্রিক। নেতারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের রাজনীতিতে লিপ্ত। মারামারি কাটাকাটি নিজেদের মধ্যেই হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরের বিভিন্ন নির্বাচনের দিকে যদি তাকানো যায়, তবে দেখা যাবে, এসব নির্বাচনে মূল প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। দল থেকে যাকে নমিনেশন দেয়া হয়েছে, তার বিপরীতে দলেরই আরেকজন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে। এ নিয়ে দলের মধ্যেও কোনো আপত্তি পরিলক্ষিত হয়নি। এসব নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলেও তাদের প্রার্থীরা পাত্তা পায়নি। ফলে রাজনীতি হয়ে পড়েছে এককেন্দ্রিক। অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বলে যে দলটি রয়েছে, তার রাজনীতির এখন কোনো ধরণই নেই। দলটি না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থায় রয়েছে। বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্তে্বও দলটির অবস্থা শোচনীয়। তাদের রাজনীতিও দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। নেতারা না পারছে সাধারণ মানুষের হয়ে রাজনীতি করতে, না পারছে তাদের লক্ষ্য হাসিল করতে। আবার সংসদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে যে দলটি রয়েছে, তার কোনো অস্তিত্ব আছে বলেও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল, তাতে তার কোনো অস্তিত্বই টের পাওয়া যায়নি। এ নির্বাচনে দলটি সংসদের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে দ্বিতীয় হওয়া দূরে থাক, তৃতীয় অবস্থানেও আসতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধী দলের পর তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে এমন একটি ইসলামী দল, যার তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ড কিংবা নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা উল্লেখযোগ্য ছিল না। রাজনীতির এই চিত্র থেকেই প্রতীয়মাণ হয়, দেশে রাজনীতি বলে কিছু নেই। ফলে সাধারণ মানুষও রাজনীতির প্রতি অনীহ ও অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে। বলা যায়, দেশ রাজনীতিহীন অবস্থায় এগিয়ে চলেছে। এদিকে দেশের সার্বিক অর্থনীতি এক চরম দুরবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অর্থনীতি থাকলে রাজনীতি থাকে। অর্থনীতিই যদি নুয়ে পড়ে তবে রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যেতে বাধ্য।
দুই.
সাধারণত সুস্থ্য রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তরুণ, শিক্ষত ও মেধাবীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এখন দেখা যাচ্ছে, দেশে সুস্থ্যধারার ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতির অনুপস্থিতির কারণে এ শ্রেণীর তরুণরা চরম অনীহা প্রকাশ করছে। রাজনীতির প্রতি তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। অনেকের মধ্যে এমন মনোভাব কাজ করছে, যেন দেশ ত্যাগ করতে পারলেই বাঁচে। দেশ ত্যাগের এই ইচ্ছা বা প্রবণতা শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণদের মধ্যে প্রবলভাবে রয়েছে। বছর কয়েক আগে দৈনিক ইনকিলাবে দেশ, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে শিক্ষিত তরুণ সমাজের বর্তমান চিন্তা-ভাবনা কি, এ নিয়ে তিনটি জরিপ প্রকাশ করে। ‘অনিশ্চয়তায় দেশবিমুখ এক-তৃতীয়াংশ তরুণ’, ‘রাজনীতিবিমুখ তরুণ সমাজ’ এবং ‘দেশ ও অর্থনীতি নিয়ে হাতাশা’ শিরোনামে প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে তরুণদের মতামত উল্লেখ করে বলা হয়, দেশে অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, অতিমাত্রায় অপরাধ প্রবণতা, অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অভাব, নিরাপত্তার ঘাটতিসহ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনা থেকে তরুণদের মধ্যে দেশ ছাড়ার চিন্তা প্রবল হয়ে উঠেছে। জরিপে উল্লেখ করা হয়, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, উৎপাদনমুখী ব্যবস্থার অভাব এবং মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করায় প্রায় ৩১ শতাংশ তরুণ দেশবিমুখ হচ্ছেন। অথচ এসব তরুণের ৭৩.৫০ শতাংশই মনে করে তাদের শিক্ষা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে দেশ ও সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বলা বাহুল্য, রাজনীতি তার রীতি-নীতি, আদর্শ অনুযায়ী সঠিক পথে পরিচালিত হবে-এটাই স্বাভাবিক। এর সুফল ভোগ করবে দেশের জনগণ। শিক্ষিত তরুণ সমাজ রাজনীতি করবে কি করবে না, রাজনীতির মাধ্যমে নাকি নিজস্ব কর্ম ও উদ্যোগের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেবে, এটা তাদের একান্ত নিজস্ব বোধ-বিবেচনার বিষয়। রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃবৃন্দের কর্মকান্ড যদি তাদেরকে বীতশ্রদ্ধ, হতোদ্যম ও বিমুখ করে তোলে, তবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কিছু হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্থ ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতির চর্চা থাকলে হয়তো তাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করতে হতো না। এ কথা বহুবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও সম্ভাবনার বীজ বিপুল সংখ্যক তরুণ সমাজের কর্মোদ্যম, দক্ষতা ও কাজে লাগানোর মধ্যে নিহিত। দেশের মূল চালিকাশক্তি এই বিপুল জনগোষ্ঠী। বিশ্বের অনেক দেশেই উন্নতির অদম্য আকাক্সক্ষা ধারণ করা এমন জনশক্তি নেই। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ এখন তৃতীয় বিশ্বের মেধাবী তরুণদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের দেশের সম্পদে পরিণত করছে। এমনকি রাজনীতিতেও তাদের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। তাদেরকেই আবার আমাদের দেশে তাদের প্রতিনিধি করে পাঠাচ্ছে। ভাবতে ভাল লাগে যখন দেখা যায়, বাংলাদেশেরই সন্তান উন্নত দেশের দূত বা মন্ত্রী হয়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে বাংলাদেশে আসেন। খারাপ লাগে ও আফসোস হয় এই ভেবে, যখন তারা বাংলাদেশের জন্য নয়, তাদের প্রতিনিধিত্বকারী দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য এবং বাংলাদেশের রাজনীতি কি হবে, কেমন হওয়া উচিত এই পরামর্শ দিতে আসেন। অথচ আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতিতে তাদেরই অবদান রাখার কথা। যে তরুণরা আজ রাজনীতির প্রতি বিমুখ ও বিরক্ত হয়ে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে বা যাওয়ার চিন্তা করছে, দেখা যাবে কয়েক বছর পর হয়তো এই তাদেরই কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিনিধি হয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকট নিরসনে পরামর্শ দিতে আসবে। তখন তাদের দেখে ভাল লাগা ও গর্ব করার মিশ্র অনুভূতি প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা ছাড়া কিছু করার থাকবে না। আমরা যতই নিজের দেশের সন্তান বলে গর্ববোধ করি না কেন, তারা সেই দেশের স্বার্থের বাইরে একচুলও যাবে না। ট্র্যাজেডি হচ্ছে এই, দেশের নেতিবাচক রাজনীতির শিকার হয়ে মেধাবী তরুণদের অনেকেই উন্নত জীবনের সন্ধানে দেশ ছাড়ছেন। যারা ছাড়তে চান না বা পারেন না, তাদেরকে প্রতিনিয়ত হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য তরুণ সমাজ স্পষ্টভাবেই দায়ী করছে দেশের প্রচলিত রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের। ইনকিলাবের জরিপে দেখানো হয়েছিল, শতকরা ৬০.৫ ভাগ তরুণ মনে করে, দেশের বর্তমান অবস্থা ও সব ব্যর্থতার জন্য রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরাই দায়ী। তারা মনে করে, রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়াতেই সন্ত্রাস, হত্যা, চাঁদাবাজি ইত্যাদি হয়ে থাকে। রাজনীতিবিদদের মধ্যেই দুর্নীতিবাজের সংখ্যা বেশি। অপরাধ করার পর সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে রাজনীতিবিদরাই কাজ করেন। ৪৩ শতাংশ মনে করেন, বর্তমান রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্থ, সঙ্কটময় ও অস্থিতিশীল। এটি আর দেশপ্রেমিক কোন ব্যক্তির কাছে নেই। রাজনীতি চলে গেছে ব্যবসায়ী, স্বার্থেন্বেষী ও বিত্তবানদের হাতে। রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি কোনো আন্তরিকতা, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নেই। অর্থাৎ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দল স্বার্থবাদীতার রাজনীতি এবং তাদের অনেক নেতা-কর্মী ‘জোর যার মুল্লুক তার’ যুগের সুচনা করেন। দেশের বর্তমান রাজনীতি ও রাজনীতিকদের আচরণ ও কথাবার্তার ধরণ কি, তা শুধু জরিপের ফলাফল থেকেই নয়, বিভিন্ন টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকার খবর থেকেও জনসাধারণ দেখছে ও বুঝছে। জনসাধারণের এই দেখা ও বোঝার বিষয়টি বর্তমান রাজনীতিবিদরা আমলে যে নিচ্ছেন না, তা তাদের আচরণ থেকেই বোঝা যায়। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে, তবে রাজনীতির এই নেতিবাচক ধারার পরিবর্তন কোন দিনই হবে না। শিক্ষিত তরুণ সমাজকে রাজনীতিতে যুক্ত করা এবং তাদেরকে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পলায়নপর মনোবৃত্তি থেকেও ফেরানো যাবে না।
তিন.
জরিপে একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এই যে, শিক্ষিত তরুণরা মনে করে দেশের রাজনীতিবিদরা স্বার্থপর। তারা কেবল ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে কাজ করেন। দেশ ও জনগণের স্বার্থে কেউ রাজনীতি করেন না। তারা প্রতিহিংসার রাজনীতি করেন। তাদের এ ধারণা যে অমূলক তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। দেশে যে সুষ্ঠু রাজনীতি নেই তা বর্তমান রাজনৈতিক চিত্রই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। রাজনীতি এখন একচেটিয়া ক্ষমতাসীনদের দখলে। রাজনীতিকে তারা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির এই করুণ দশার কারণে এটি এখন মাফিয়াতন্ত্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের এমপি ও নেতাদের অনেকেই নিজ এলাকায় এমপি লীগ ও ভাই লীগ গড়ে তুলেছে। একেক স্থানে একেকজন নেতা অপরাধের নেপথ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছেন। খুনি, দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসীরা অপরাধ করে তাদের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে বহাল তবিয়তে থাকে। রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট এসব পেশাদার অপরাধীর কাছে প্রশাসনও অসহায় হয়ে পড়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে যত ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস হয়, তার নেপথ্যে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের কোন না কোন স্বার্থ এবং সংশ্লিষ্টতা থাকে। এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। প্রতিকারহীন, আধিপত্যবাদ ও এককেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে মানুষের হতাশ ও অসহায় হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। ফলে রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দিন দিন বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হচ্ছে। এর জন্য দায়ী রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরা। অথচ শিক্ষিত তরুণ সমাজ থেকে শুরু করে একজন অতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, একজন রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি হবেন আদর্শবান এবং কখনই নিজ স্বার্থে কাজ করবেন না। তার কাজই হচ্ছে, দেশ ও জনগণের কল্যাণে আত্মনিবেদিত হওয়া। তিনি হবেন, জনসাধারণের কাছে সম্মানিত ও নির্ভরশীল ব্যক্তি। বর্তমানে যে রাজনৈতিক ধারা চলছে তাতে সাধারণ মানুষের এ চাওয়া দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। রাজনৈতিক এই অচলায়তন থেকে বের হয়ে আসার জন্য, তাদের সামনে কোন স্বপ্নদ্রষ্টা নেই। অনুপ্রাণিত ও অনুরণিত হওয়ার মতো রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ নেই। শত ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নির্যাতন সয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন মেন্ডেলার মতো যে বলবে, ‘আই স্ট্যান্ড হিয়ার বিফোর ইউ নট অ্যাজ এ প্রফেট বাট অ্যাজ এ হাম্বল সার্ভেন্ট অফ ইউ, দ্য পিপল।’ এমন রাজনীতিক এখন আমাদের দেশে কল্পনাও করা যায় না। নেতার জন্য সাধারণ মানুষের সংগ্রাম করা দূরে থাক, উল্টো নেতাদের দ্বারা নিগৃহীত ও প্রাণ সংহারের আতংকে তাদের দিন কাটাতে হয়। আমাদের দেশের জাতীয় নেতাদের আদর্শ ও দর্শন নিয়ে যেসব দল গড়ে উঠেছে, সেগুলোর মধ্যেও এখন আর তাদের আদর্শ ও দর্শন ধারণ ও চর্চা করার প্রবণতা নেই। ‘আমি এবং আমরা’র মধ্যে রাজনীতিকে সীমাবদ্ধ করে যা খুশি তাই করার প্রবণতা বিদ্যমান।
চার.
ফিলিপিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসেফ এস্ট্রাদা ১৯৯৮ সালে যখন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন, তখন তিনি একটি কথা জনসাধারণের সামনে বারবার বলেছিলেন, আই উইল নট ফেইল ইউ। আই উইল ডাই ওয়ার্কিং টু ব্রিং ব্যাক দ্য গ্লোরি অ্যান্ড প্রাইড টু ফিলিপিনস। তার এই কথায় জনসাধারণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে তাকে নির্বাচিত করে। তবে ৩ বছরের মাথায় ২০০১ সালে সেই জনসাধারণই তার দুর্নীতি, স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ এবং নারী ঘটিত কেলেঙ্কারীর কারণে গণআন্দোলনের মাধ্যমে চলে যেতে বাধ্য করে। আদালতে ছয় বছর বিচার কার্যক্রম চলার পর তার ৩০ বছরের কারাদন্ড হয়। পরবর্তীতে ফিলিপিনের প্রেসিডেন্ট এস্ট্রাদারই এক সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট গেন্ডারিয়া আরোয়া তাকে ক্ষমা করে মুক্তি দেন। পরবর্তীতে তিনি রাজধানী ম্যানিলার গৌরব ও গর্ব ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। এস্ট্রাদা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং ম্যানিলাবাসীর সেবা নিশ্চিত করার জন্য নিজেই রাস্তায় নেমে পড়েন। প্রতিদিন ভোরে রাস্তায় বের হয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যানজট নিরসনে সুশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চলাচলের জন্য ট্র্যাফিক পুলিশকে সহায়তা করেন। এক সময় যে এস্ট্রাদা দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন, এই অহং ঝেড়ে ফেলে নিজেকে শুধরে জনতার কাতারে নিজেকে শামিল করেন। ম্যান্ডেলাকে আদর্শ মেনে জনসেবার লক্ষ্য স্থির করেন। ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে এজন্য যে, রাজনীতিতে ভুল-ভ্রান্তি হতেই পারে। রাজনীতিকরা ভুল করতে পারেন। তবে সেই ভুল শুধরে এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে যে পুনরায় জনগণের সেবায় নিয়োজিত হওয়া যায়, তা এস্ট্রাদা দেখিয়েছিলেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই এমন যে, ভুল স্বীকার দূরের কথা, রাজনীতিকরা যেন সকল ভুলের ঊর্ধ্বে। তারা যা খুশি তা করতে পারেন। এর ফলে রাজনীতি জনসেবার পরিবর্তে আত্মসেবায় পরিণত হয়েছে। নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের রাজনীতির প্রতি মেধাবী তরুণদের আগ্রহ থাকবে কেন? শুধু তরুণ মেধাবী শ্রেণী নয়, অতি সাধারণ মানুষও এ ধরনের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারা ভাল করেই জানে, দেশের রাজনীতি জনস্বার্থের পরিবর্তে নিজস্বার্থের মধ্য দিয়ে চলছে। রাজনীতিবিদরা এখন আর তাদের হয়ে রাজনীতি চর্চা করছেন না। তারা জনসাধারণের ভাল-মন্দ বা মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বরং তাদের ভাল-মন্দ ও মতামত জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দিয়ে রাজনীতি করছেন। গণতন্ত্র নয়, দলতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্রকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। বলাবাহুল্য, যে রাজনীতিতে জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে না, সে রাজনীতি দেশকে এগিয়ে নিতে পারে না। রাজনীতিতে ‘শেষ বলে কথা নেই’ এ ধরনের ধোঁকাবাজি, নীতিহীন ও স্বার্থবাদীতার কথা যারা বলেন, মূলত তারাই সুস্থ্য রাজনীতি ধ্বংস করে দিচ্ছেন। তরুণ মেধাবী শ্রেণী তাদের এই কূটকথা বোঝে বলেই, রাজনীতিবিমুখ এবং অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে। এটা কোনভাবেই দেশের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। এ পরিস্থিতির অবসান হওয়া জরুরী। শিক্ষিত তরুণদের মানসিকতা ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদলগুলোর উপলব্ধি করা এখন সময়ের দাবী। তাদের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির রাজনীতি পরিবর্তন করতে হবে। দেশের ভবিষ্যত যাদের উপর নির্ভরশীল এবং যারা সত্যিকার অর্থে দেশকে এগিয়ে নেয়ার সক্ষমতা রাখে, সেই শিক্ষিত ও যোগ্য তরুণশ্রেণীকে দেশের সম্পদ ভেবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে স্বার্থবাদের রাজনীতি চলছে, তা দেশে ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।