Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাগৃকের অর্ধশত প্লট গায়েব!

রাশিদুলের বিদায়ে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের (জাগৃক) ৪৭৪টি প্লট অবৈধ দখলমুক্ত করার পর গায়েব হয়ে গেছে অন্তত অর্ধশত প্লট। ‘গায়েব’ হয়ে যাওয়া এসব প্লট অন্যত্র বিক্রি করে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। রাজধানীর দুয়ারীপাড়ায় প্রকল্পে এ ঘটনা ঘটে প্রতিষ্ঠানটির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান রাশিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে। তবে এই মর্মে দাখিলকৃত অভিযোগটিও দুনঅীতি দমন কমিশনে (দুদক) ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে- মর্মে অভিযোগ উঠেছে। বৃহৎ এই দুর্নীতির অনুসন্ধান দুদকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সহযোগিতায় ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে-মর্মেও রয়েছে অভিযোগ। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাশিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, একটি চক্র সুবিধা করতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে ক্রমাগত বেনামি অভিযোগ দায়ের করে আসছে। এটি সেই চক্রেরই একটি অপপ্রচার।

এদিকে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পর এক এক করে রাশিদুল ইসলামের বিষয়ে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। তার অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার ঝাঁপি মেলে ধরছেন এতদিন মুখ বন্ধ করে সহ্য করা ভুক্তভোগী এবং কর্মকর্তারা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন কমিশনারের ছত্রছায়ায় তিনি কিভাবে নিজের বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতির তদন্ত ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন- বেরিয়ে এসেছে সেই তথ্যও।

জাগৃক সূত্র জানায়, চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই রাশিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে আসতে থাকে একের পর এক অভিযোগ। এসব নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকলে একপর্যায়ে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ভবনে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। তবে এতেও কাজ হয়নি। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত ওই পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। গত ৪ ফেব্রæয়ারি জনপ্রশাসনের এক আদেশে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে রাশিদুল ইসলামকে। তবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এখনো তাকে ছাড়পত্র দেয়নি বলে জানা গেছে।

জাগৃকের চেয়ারম্যান থাকাকালীন এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। এমনকি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ শত শত কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ এনে প্রতিবেদন দেয়। দুদকও তদন্ত শুরু করে। এর মধ্যেই তিনি দুদকের একজন কমিশনারের আশীর্বাদে দুর্নীতি মামলাটি ধামাচাপা দেন। তার বিরুদ্ধে একের পর এক তদন্তের উদ্যোগ নিলেও রহস্যজনক কারণে তা মাঝপথে আটকে যায়। বিদায়ের পর রাশিদুলের আখেরি লুটপাটের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জুলাই মাসের প্রথমার্ধে অতিরিক্ত সচিব রাশিদুল ইসলাম জাগৃক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নিজস্ব লোকজনকে নিয়ে সিন্ডিকেট করে প্রতিষ্ঠানটিকে হরিলুটের আখড়ায় পরিণত করেন। একই সঙ্গে আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি অর্থ ব্যয় করেন। এর আগে তিনি একই প্রতিষ্ঠানে সদস্য (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলো ছিল তার নখদর্পণে। এ কারণে শীর্ষ পদে আসীন হবার পর তার মধ্যে ‘ড্যামকেয়ার’ ভাব চলে আসে। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই দুর্নীতির থাবা বিস্তার শুরু করেন।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তদন্ত প্রতিবেদনে তার লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রথম প্রকাশ পায়। গত বছরের ২৬ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্টদের দেয়া হয়। প্রতিবেদনে রাজধানীর মিরপুরে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের অর্পিত সম্পত্তি জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর ছাড়াও মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বেশ কয়েকটি পুনর্বাসন প্লট হস্তান্তরের অনুমতি প্রদানে জালিয়াতির সবিস্তার তথ্য রয়েছে।
এছাড়াও রাশিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে বদলি বাণিজ্য, অনিয়মসহ আরো অনেক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে প্রশ্রয়দাতা হিসেবে প্রভাবশালী কয়েকজনের নামোল্লেখ করে রাশিদুলের সঙ্গে তাদের বিশেষ সম্পর্কের ইঙ্গিত রয়েছে। প্রতিবেদনে রাশিদুলের স্বেচ্ছাচারিতার আরো তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামানের অবসর গ্রহণের ৩ মাস আগে দাপ্তরিক প্রয়োজনে বিদেশ সফরকালীন বিপুল অর্থ খরচ করে রাশিদুল ইসলাম জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে তার পদায়ন নিশ্চিত করেন।

এছাড়া ফাইল হতে ক্লায়েন্টদের মোবাইল/কন্টাক্ট নম্বর সংগ্রহ করে বিভিন্ন ত্রæটির অজুহাতে (তার নির্ধারিত) লোক দিয়ে যোগাযোগ করে ঘুষ দাবি এবং গ্রহণ করেন। প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করা হয়। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তোলপাড় হলে রাশিদুল সেটি ধামাচাপা দিতে হাইভোল্টেজ তদ্বির চালান। একই সঙ্গে নিজের দুর্নীতি আড়াল করতে গৃহায়ন ভবনে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। পাশাপাশি কৌশল পাল্টে দুর্নীতির মাত্রাও বাড়িয়ে দেন।

তার আখেরি লুটপাটের কিছু তথ্য এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সম্প্রতি মিরপুরের দুয়ারীপাড়ার অবৈধ উচ্ছেদের নামে কোটি টাকা আত্মসাৎ, লালমাটিয়ায় কমিউনিটি সেন্টারের বাণিজ্যিক ফ্লোরে পজিশন বেনামে হাতিয়ে নেয়া, রাজশাহীর তেরখাদিয়া প্রকল্পে নকশা বদল করে ঠিকাদারকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে বাঁচিয়ে দেয়া, চাহিদা মাফিক অর্থ না পেলে ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করা, নিজ পছন্দের কর্মকর্তাকে বসিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থ নেয়া, মোহাম্মদপুর ‘এফ’ ব্লক এবং মিরপুরের জয়নগর প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকার দরপত্র ৫ পার্সেন্ট ঊর্ধ্ব দরে দরদাতা একমাত্র প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ বিস্তর অভিযোগ। এমনকি বিদায়ের দুই দিন আগে তার অফিসে অনুপস্থিত নিয়েও চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে। জানা গেছে, গত ২ ও ৩ ফেব্রুয়ারি অফিসের কাউকে কিছু না বলেই তিনি বরিশাল সফরে যান। ঝালকাঠির নলছিটি প্রকল্পে ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশনের টাকা আদায় করতেই তার এ গোপন সফর বলে চাউর রয়েছে।

তথ্যমতে, ত্রুটিপূর্ণ দরপত্রে প্রায় ৫ কোটি টাকার নলছিটির সাইড অ্যান্ড সার্ভিস (প্লট প্রকল্প) কাজের কার্যাদেশ পছন্দের ঠিকাদারকে দেয়া হয়েছে। দরপত্রের নথি সঠিকভাবে যাচাই করলেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ মিলবে। অন্যদিকে মিরপুরের দুয়ারীপাড়ায় অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে ৪৭৪টি প্লট উদ্ধার নিয়েও মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানা গেছে, উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ও যানবাহনের জন্য খরচ বাবদ গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্রাক্কলন ছিল ৩৫ লাখ টাকা। অথচ চেয়ারম্যান রাশিদুল ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ খাতে কোটি টাকার ওপর ব্যয় দেখিয়েছেন। ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে তিনি মোটা অংকের টাকা আত্মসাত করেছেন। পাশাপাশি দুয়ারীপাড়ায় বরাদ্দ গ্রহীতা সমিতির কাছ থেকেও মোটা অংকের কমিশন হাতিয়ে নিয়েছেন। সবচে’ বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, ৪৭৪টি প্লট অবৈধ দখলে থাকলেও উদ্ধারের পর অন্তত অর্ধশত প্লট গায়েব হয়ে গেছে। গায়েব হওয়া এসব প্লট গোপনে অন্যত্র বিক্রি কিংবা আর্থিক সুবিধা পেয়ে পূর্বের বরাদ্দ গ্রহীতা কাউকে বাড়তি জমি দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।

এদিকে মিরপুর স্যাটেলাইট টাউন প্রকল্পে ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়ে চেয়ারম্যান রাশিদুল ইসলামের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে দুদক। গত ২৬ জানুয়ারি দুদক উপ-পরিচালক মোহা: নূরুল হুদা এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠান। জানা গেছে, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় এ প্রকল্পের ঠিকাদার ‘ট্রপিক্যাল হোমস লিমিটেড’। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ‘পারফরম্যান্স’ জামানত হিসেবে ৩৫ কোটি টাকাও জাগৃক বরাবর জমা দেয়। কিন্তু কমিশন না পাওয়ায় চেয়ারম্যান রাশিদুল ইসলাম প্রকল্পের স্থান বুঝিয়ে দিতে টালবাহানা করছেন দুই বছর ধরে।

এর আগে ঘুষ গ্রহণ ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের একাধিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক পৃথক অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়। তবে কোনো অদৃশ্য ইশারায় দুদকের সেই অনুসন্ধানও থমকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন ভুক্তভোগীরা। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, কোনো ইশরায় অনুসন্ধান থমকে যাওয়া কিংবা ধামাচাপা দেয়ার সুযোগ কমিশনে নেই। দুর্নীতির অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠতা থাকলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যিনিই হোন অনুসন্ধান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্লট

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ