Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

নারী-পুরুষ সম্পর্কের অবনতি

লোকমান ফরাজী | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

কুর্মিটোলায় মজনুমিয়া কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর যৗননিগ্রহের ঘটনা আবারও প্রমাণ করল বর্তমান বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও নিরাপদ নয়! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রুমানা মনজুরকে তাঁর স্বামী হাসান সাঈদ সুমন কেন শারীরিকভাবে আঘাত করতে করতে অন্ধ করে ফেললেন, তা নিয়ে কোনো মনস্তাত্তি¡ক আলোচনা কি হয়েছিল? হাসান সাঈদ সুমনকে গ্রেফতার করে পুলিশ, এবং পুলিশ হেফাজতেই বাথরুমে মারা যান বলে জানা যায়। এই নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি? কেন বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এভাবে স্বামী কর্তৃক নিগ্রহের শিকার হলেন? এভাবে অসংখ্য উদাহরণ হাজির করা যায় এবং বুঝা যায়, আমাদের দেশে মানুষের পশুত্বশক্তির বহিঃপ্রকাশ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। 


২০০১ হতে ২০১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্মিত, সেন্সরবোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত চলচ্চিত্রগুলো শারীরিক-যৌননিগ্রহের দৃশ্য দ্বারা সাজানোÑ বলা যায় শারীরিক-যৌননিগ্রহের উপস্থাপনাই ছিল এই সিনেমাগুলো নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য। তখন সেন্সর বোর্ডের যারা সিনেমার অনুমতি দিতেন, তারা কি বিচার-বিবেচনাবোধ-বর্জিত? চলচ্চিত্রে কেন দিনের পর দিন শারীরিক-যৌননিগ্রহের এমন দৃশ্য উপস্থাপন করলেন আমাদের পরিচালকগণ, এ নিয়ে থিয়েটার-নাটক-সিনেমা অঙ্গনের কোনো বুদ্ধিজীবীর মতামত সংবাদপত্রে কিংবা তাঁদের লিখিত কোনো গ্রন্থে দেখতে পাই না।

শারীরিক-যৌননিগ্রহের বিরুদ্ধে টকশোতে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা নানা আওয়াজ তুললেও, দেখা যাচ্ছে শারীরিক-যৌননিগ্রহ বন্ধ হওয়া দূরের কথা, দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। দেশের এমন কোনো স্থান আছে যেখানে কোনো শিশু কিংবা নারী-পুরুষ নিরাপদ? পুরুষরাও এখন শারীরিক-যৌননিগ্রহের শিকার হচ্ছে!

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কথিত ছাত্রনেতাদের মেয়ে শিক্ষার্থীদের কেলেঙ্কারির কথা এবং ২০০১ ও ২০১৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের শারীরিক-যৌননিগ্রহের ঘটনায় এটি প্রমাণিত যে এই চলমান রাজনীতিই শারীরিক-যৌননিগ্রহের জন্য প্রধানত দায়ী। ২০১১ থেকে ২০১৯-এর জানুয়ারি পর্যন্ত পত্রিকার পাতায় প্রায় প্রতিদিনই দুই বা ততোধিক শারীরিক-যৌননিগ্রহের সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে বিবিসি রেডিও’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মেয়েশিশুরা ভাই, চাচা, ফুফা, খালু এমনকি বাবা দ্বারাও শারীরিক-যৌননিগ্রহের শিকার হচ্ছে।

প্রকৃতিতে পুরুষের চেয়ে দৈহিক কর্মক্ষমতায় নারী কিছুটা দুর্বল। পুরুষ যতটুকু কায়িম পরিশ্রম করতে পারে, নারী সে রকম পারে না। তাছাড়া সন্তান ধারন কালে নারীরা একরকম সীমাবদ্ধতার মধ্যেই জীবন কাটায়। এটা প্রকৃতিগত। এখানে মানুষের কোনো হাত নেই। পৃথিবীর যে দিকে দৃষ্টি দিই অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষ সম্পর্কটি অত্যন্ত চমৎকার, নান্দনিক এবং সভ্যতার বিকাশে এর ভূমিকা ইতিবাচক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে নানা দিক থেকে মানুষের জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বাড়ার কথা, মানুষ মানসিক দিক থেকে সভ্য হওয়ার সাথে সাথে নারী-পুরুষের সম্পর্কও উন্নত হওয়ার কথা। কিন্তু মানুষের মধ্যে আজও নারী-পুরুষ সম্পর্কে এক বৈরীভাব। নারী আজও পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বর্তমানে পুরুষও পণ্যে রূপ নিয়েছে! নারী ও পুরুষের এই পণ্য রূপের অবস্থানই প্রমাণ করে মানুষ সভ্যতার নি¤œ পর্যায়ে এখনো পড়ে আছে।

সমাজে মানুষের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলার উন্নত আয়োজন বাদ দিয়ে চলছে সন্দেহ, হিংসা-দ্বেষ, নির্যাতন, হত্যা, ডিভোর্স। যারা শিক্ষাদীক্ষা অর্জন করে সমাজের উচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করে, তাদের ক্ষেত্রে অবস্থা ভিন্ন। দাম্পত্য জীবনে বনিবনা না হলে তারা দ্রæত আইনের সহায়তা নিয়ে ডিভোর্সের মাধ্যমে সেপারেট অবস্থানে চলে যান এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের নিরাপত্তার প্রয়াসে অর্থসম্পত্তি জমা করেন। সংসার নামক স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের বন্ধনের পরিবর্তে ভিন্নভাবে ভিন্নরকম সংসার সাজান। ডিভোর্সের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানরা।

গাজীপুরে শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটির জামাল উদ্দিন আত্মহত্যা করেছিলেন ২০১৯-এর আগস্ট মাসে। যারা তাঁকে বনে নিয়ে বলাৎকার (শারীরিক-যৌননিগ্রহ) করেছিল, তাদের কি শাস্তি হয়েছিল? বাংলাদেশে শারীরিক-যৌননিগ্রহের প্রসঙ্গ আসলেই শুধুমাত্র নারীদের বিষয়ে আলোচনা হয়, পুরুষ ও ছেলেশিশুরা যে বলাৎকারের শিকার হচ্ছে সেটি আলোচনায় আনা হয় না। কারণ, এটা পুরুষশাসিত সমাজ Ñ তাই পুরুষদের অপমানের কথা সম্ভবত পত্রিকায় ছাপা হয় না।

বাংলাদেশে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে কি যেখানে নারীনিগ্রহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরাও আজ শারীরিক-যৌননিগ্রহের শিকার। মাদ্রাসায় ছেলেশিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে কি পুরুষনিগ্রহ নেই? বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তথ্যানুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে নারী ও পুরুষ উভয়েই শারীরিক-যৌননিগ্রহের শিকার। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীনিগ্রহকে সামনে এনে পুরুষনিগ্রহকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

যাঁরা বলেন, শারীরিক-যৌননিগ্রহের বিচার না হওয়ার কারণেই শারীরিক-যৌননিগ্রহ বন্ধ হচ্ছে না। বিচারহীনতা তো শারীরিক-যৌননিগ্রহের একটিমাত্র কারণ। শারীরিক-যৌননিগ্রহের প্রধান কারণ রাজনৈতিক, তারপর সামাজিক এবং তারপর বিচারহীনতার প্রশ্ন। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় শারীরিক-যৌননিগ্রাহকরা বেড়ে উঠছে, আজকের বাস্তবতায় একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই একে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সেই সঙ্গে শারীরিক-যৌননিগ্রহের বিরুদ্ধে যে আইন আছে সে আইনের যথাযথ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শারীরিক-যৌননিগ্রহ বন্ধের জন্য সংবাদ ও গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র আজ অবক্ষয়ক্লিষ্ট। এটি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও সংস্কৃতির অনুপস্থিতির কারণ। যতই চারদিকে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভাট নির্মাণ, জিডিপি বৃদ্ধি ইত্যাদি উন্নয়নের কথা বলা হোক, মানুষকে প্রশিক্ষিত করার কোনো বিকল্প নেই। এই প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেবে কে, কারা। রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে গড়ে তোলা। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, সেগুলো কি জনগণের পক্ষে কাজ করে কোনো? তা যদি নাই করে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: সাংবাদিক

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নারী-পুরুষ

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন