পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন শেষ হয়েছে। নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও ভুয়া ভোটের প্রতিবাদে বিএনপি রবিবার হরতাল ডেকেছিল। সেই হরতালও শেষ হয়েছে। আজ আমি নির্বাচন কেমন হয়েছে, হরতাল কেমন হয়েছে এবং এর পর জাতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ কী, সেটা নিয়ে দুটো কথা বলবো।
নির্বাচন কেমন হয়েছে সে সম্পর্কে আপনারা ইতোমধ্যেই পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন রিপোর্ট পড়েছেন। যারা ভোট দিতে গিয়েছিলেন তারাও চাক্ষুস দেখেছেন, কীভাবে ভোট কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আর হরতাল? কী বলবো এ সম্পর্কে? আপনারা টেলিভিশনে হরতাল চিত্র দেখেছেন। তারপরেও নিজেদের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলা প্রয়োজন। আমি যা বলবো, অত্যন্ত নিরাসক্ত, নির্মোহ এবং নিরপেক্ষভাবে বলবো।
কলাবাগানের একটি কেন্দ্রে আমি এবং আমার সহধর্মিনী ভোট দিতে গিয়েছিলাম। ভোট কেন্দ্রের মেইন গেটের অন্তত একশ হাত দূরে থেকেই টেবিল নিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বসে ছিলেন। টেবিলের চারধারে গোল করে অনেক লোক। তাদের সকলের গায়ে নৌকার ব্যাজ। এভাবেই মেইন গেট পর্যন্ত অন্তত চারটি টেবিল এবং গোল করে থাকা আওয়ামী কর্মীদের দেখা গেল। এমনিতেই কোনো ভোটার নাই। তারপরেও যে দু’ একজন করে মাঝে মাঝে আসছেন তাদের নৌকার ছবি সম্বলিত ছোট ছোট কাগজ হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমি যখন যাই তখন বেলা ১১টা ২০ মিনিট। সত্যি কথা বলছি, আমি সেখানে একজন বিএনপি কর্মীও দেখিনি। এখন তারা কি আসেনি, নাকি আগেই তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটি জানতে পারিনি। তবে আমার মনে হয়, তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। কারণ তাড়িয়ে দেওয়া হলে কিছুটা দূর হলেও ছোট হোক বড় হোক, কিছুটা জটলা থাকতো। কিন্তু সেরকম কিছুই দেখলাম না।
যাই হোক, গেট দিয়ে যখন ঢুকছি তখন দেখলাম ১০/১২ জন পুলিশ। আমার পরিচয়পত্র দেখার পর আমার সেল ফোন তাদের কাছে রেখে দিতে বললেন। এমন সময় ৪/৫ জন যুবক গেটের ভেতর ঢুকলো। পুলিশ তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা বললো, আমাদেরকে ভেতরে যেতে দিন। পুলিশ যখন পরিচয়ের জন্য চাপ দিল তখন যুবকদের একজন এক পুলিশকে কুনুই দিয়ে গুতো মেরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। পুলিশ তাদের বাধা দিল। এই নিয়ে যখন বাকবিতন্ডা চলছিল তখন একজন বয়স্ক লোক, স্যুট টাই পরা, ঢুকলেন। পুলিশ তাকে সালাম দিল। তিনি বললেন, এই যুবকদেরকে ছেড়ে দাও।
আমার কেন্দ্রটি ছিল ২য় তলায়। কেন্দ্রের সামনে গিয়ে দেখি একজন ভোটারও নাই। আমি বারান্দায় কয়েক মিনিট ঘোরাফেরা করলাম। কিন্তু কোনো ভোটার এলো না। আমি একাই ভোট কেন্দ্রে ঢুকলাম। ইভিএম মেশিনটি ছোট্ট একটি পাতলা কাপড় দিয়ে ঘেরা। সামনে গিয়ে গলা বাড়ালে সব দেখতে পাওয়া যায়। আমি যখন ইভিএম মেশিনের সাদা বোতামে চাপ দেবো তখন দেখি পেছন থেকে দু’জন দেখছে। জিজ্ঞেস করায় ওরা বললো, আমি কোথায় ভোট দেই সেটি তারা দেখবে। আমি তাদেরকে সরে যেতে বললে তারা বললো, আপনাকে নৌকায় ভোট দিতে হবে। আমি চিৎকার করলে প্রিজাইডিং অফিসার এবং পুলিশ আসে। আমার নালিশ শুনে তারা ঐ দুই জন লোককে বের করে নিয়ে যায়। আমি দেখলাম, বারান্দার জানালা দিয়ে আরো ৫/৬ জন লোক উঁকিঝুঁকি মারছে। আমার মিসেস যেখানে ভোট দেন সেখানেও কোনো ভোটার ছিল না। ভোট দিয়ে বেরিয়ে মেইন গেটের সামনে আমরা দু’জন পরিস্থিতি দেখার জন্য অপেক্ষা করি। অন্তত ৩০ মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি। এই ৩০ মিনিটে আমরা ছাড়া আর একজন ভোটারও প্রবেশ করে নাই।
এই হলো ভোটার উপস্থিতির অবস্থা। ফেসবুকে অসংখ্য বন্ধু আমাকে জানিয়েছেন যে, তাদের কেন্দ্রগুলোতেও কোনো ভোটার নাই। তারা আমাকে বলেছেন, আমি তাদের কথা লিখতে পারি। তবে তাদের নাম ধাম দেওয়া যাবে না। কারণ, তাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। মগবাজার থেকে একজন লিখেছেন, ‘আমি ভোট দিয়েছি। কিন্তু কোনো ভোটার ছিল না। আমার কেন্দ্র ছিল বেইলি রোডে সিদ্ধেশ্বরী এরৎষং ঈড়ষষবমব. বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে।’
দুই
দুই সিটি নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৪৬৮টি। দু’টি নির্বাচনী এলাকার জনসংখ্যা ৯৮ লক্ষ ২৬ হাজার ৭৩৯ জন। দুইটি এলাকায় ভোটার সংখ্যা ছিল ৫৪ লক্ষ ৬৩ হাজার ৪২৩ জন। ভোট পড়েছে উত্তরে ৭ লক্ষ ১১ হাজার এবং দক্ষিণে ৬ লক্ষ ৬০ হাজার। মোট ১৩ লক্ষ ৭১ হাজার। অর্থাৎ প্রদত্ত ভোট মোট ভোটের ২৫ শতাংশ। এই ধরনের নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। ৫০ শতাংশের কম হলে সেটি ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। তারপরেও বাস্তব হলো এই যে, আসল উপস্থিতি ২৫ শতাংশও নয়। নির্বাচন কমিশনের ৭ লক্ষ উপস্থিতি বানোয়াট। কারণ আমি কিছুক্ষণ আগেই বলেছি প্রায় সমস্ত ভোট কেন্দ্রই ছিল ফাঁকা। আমি ব্যক্তিগতভাবে কলাবাগান ছাড়াও গ্রিন রোডের ণডঈঅ কেন্দ্র, উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের কেন্দ্র, আজিমপুরের কেন্দ্র, গুলশান-২ নম্বরের কেন্দ্র, বনানীর প্রাক্তন মেয়র আনিসুল হকের বাড়ির পাশের কেন্দ্রসহ অন্তত ২২টি কেন্দ্রের খবর সরাসরি জানি। সব জায়গাতেই একই অবস্থা। সব জায়গাতেই সকালেই বরং কয়েক জন ভোটার এসেছেন। নির্বাচন কমিশনের একজন বড় কর্তা বললেন যে, বেলা বাড়লে ভোটার বাড়বে। কিন্তু বেলা যতই বাড়তে থাকে ভোটার আসা ততই কমে যায়। কারণ, এর মধ্যে টেলিফোনে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের মাঝে খবর হয়ে যায় যে প্রতিটি কেন্দ্রে এবং প্রতিটি বুথে অবাঞ্ছিত লোকেরা ঢুকে পড়েছে এবং তারা নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছে।
এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকাদার বলেন, আমি সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ২টা পর্যন্ত মোট ১২টি কেন্দ্র পরিদর্শন করি। এই ১২টি কেন্দ্রে আমি সরকারি দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ছাড়া আর কোনো মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট দেখতে পাইনি। সকাল ৮টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রগুলোতে প্রায় ১০ শতাংশ ভোট পড়েছে। মাহবুব তালুকদার আরও বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের যে দৃশ্য দেখা গেছে, তাতে আমি মর্মাহত। আচরণবিধি ভঙ্গের বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে আচরণবিধি থাকা না থাকার কোনো পার্থক্য থাকে না।
একই ব্যাপারে দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্ট: ভোটার যন্ত্রে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর ব্যালট উন্মুক্ত হলো। কাপড় দিয়ে ঘেরা গোপন কক্ষে ভোট সম্পন্ন করতে গেলেন। এ সময় কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন, তা উঁকি দিয়ে প্রত্যক্ষ করছেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তিরা। ২. ভোটার গোপন কক্ষে গিয়ে দেখলেন, সেখানে থাকা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি তাঁর ভোট দিয়ে দিচ্ছেন। ৩. ভোটার গোপন কক্ষে প্রবেশ করার পর কোন মার্কায় ভোট দিতে হবে, তা বলে দিচ্ছেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। বেশির ভাগ ভোটকক্ষের দৃশ্য ছিল এমনই।
শনিবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে’ ভোট গ্রহণ হয়েছে। ভোটকক্ষ, কেন্দ্রের ভেতরে এবং কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় নৌকার ব্যাজধারীদের একতরফা নিয়ন্ত্রণ ছিল। ফলে গোপন ভোট আর গোপন থাকেনি। বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপিসহ অন্য দলের মেয়র বা কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি। প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট আসেননি। কোথাও কোথাও এজেন্টকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। ভোটার উপস্থিতি খুবই কম থাকায় কোথাও লম্বা সারি দেখা যায়নি।
তিন
আপনারা যারা রবিবার সারাদিন টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেছেন তারা দেখেছেন, হরতাল কেমন হয়েছে। সন্ধ্যার পর আপনি টেলিভিশন এবং পত্রপত্রিকায় একটি বিবৃতি দিলেন যে আগামীকাল সকাল সন্ধ্যা হরতাল হবে। একটি বিবৃতি দিলেই কি হরতাল হয়ে যায়? বিএনপি তথা বিরোধী দলের নেতাদের মনে রাখতে হবে যে, ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা এখন ২ কোটিরও বেশি। এদের কাছে আপনার হরতালের বার্তা পৌঁছাতে হবে এবং তারা যেনো পারত পক্ষে ঘরের বাইরে বের না হন এবং নিজেদের গাড়ি-ঘোড়া বের না করেন সেজন্য তাদেরকে বোঝাতে হবে।
আমি এবার কয়েকজন কাজের বুয়ার নিকট থেকে জানতে পেরেছি যে, তারাও ভোট দিতে যায়নি এবং তাদের রিক্সাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, মুটে-মজুর স্বামীরাও ভোট দিতে যায়নি। তাদের বক্তব্য হলো, ভোট দিয়ে কী লাভ? ভোট দিলেও আওয়ামী লীগ জিতবে, না দিলেও আওয়ামী লীগ জিতবে।
চার
বিএনপি নেতাদের বলছি, আপনারা হরতালের ডাক দিয়ে ঘরে বসে থাকবেন, না হলে নয়াপল্টন অফিসের সামনে চেয়ার বা বেঞ্চ পেতে বসে থাকবেন। টেলিভিশন আসবে, আপনাদের উপবিষ্ট অবস্থার ছবি তুলবে আর আপনারা সেই ছবি টেলিভিশনের পর্দায় দেখে পুলকিত হবেন। কেউ রাস্তায় বের হবেন না, কেউ পিকেটিং করবেন না। হরতালের স্বপক্ষে কেউ পোস্টার মারবেন না, চিকা মারবেন না, লিফলেট বিলি করবেন না। এই করে কি হরতাল হয়?
আওয়ামী লীগের সমালোচনা করি। কিন্তু দলটি যখন বিরোধী দলে ছিল এবং যখন হরতাল ডাকতো তখন দেখেছি, নেতারা বিবৃতি দিয়েছে, কর্মীরা পোস্টার মেরেছে, চিকা মেরেছে, লিফলেট বিলি করেছে এবং পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় খন্ড খন্ড মিছিল করেছে। ক্ষেত্র বিশেষে মশাল মিছিলও করেছে। এছাড়া হরতালের আগের রাতে পাড়ায় পাড়ায় স্লোগান দিয়েছে, ‘আগামী কাল হরতাল হরতাল, গাড়ির চাকা ঘুরবে না, দোকান পাট খুলবে না।’ শুধু এগুলো করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। হরতালের দিন সূর্য ওঠার আগে থেকেই তারা মহানগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে কর্মীদের স্কোয়াড বসিয়েছে। যদি কোনো বাস, বেবি ট্যাক্সী বা রিক্সা সামনে পড়েছে তাহলে সেগুলো আটকিয়েছে, চাকা পাংচার করেছে অর্থাৎ পাম্প ছেড়ে দিয়েছে।
প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে জাসদের সর্বকালের নেপথ্য নেতা সিরাজুল আলম খানের পুস্তক থেকে জানা যায়, তারা হরতাল সফল করার জন্য রেল লাইনের স্লিপার খুলেছেন, বিভিন্ন স্থানে বোমা মেরেছেন। এসব করে তারা সর্বাত্মক হরতাল সফল করেছেন। আমরা অবশ্য বোমা মারা, রেল লাইনের স্লিপার খোলা ইত্যাদি নাশকতার বিরুদ্ধে। তবে রাস্তায় রাস্তায় শান্তিপূর্ণ পিকেটিং করে হরতাল সফল করা যায়। বিএনপি তো বলে যে তাদের লাখ লাখ কর্মী। তাদের একজনকেও রবিবারের হরতালে রাস্তায় দেখলাম না কেন? একজনকেও রাস্তায় পিকেটিং করতে দেখলাম না কেন? ২ কোটি লোকের মহানগরীর কোথাও তাদের খন্ড মিছিল করতে দেখলাম না কেন? এর ফলে যা ঘটবার তাই ঘটেছে। হরতালের নামে কী হয়েছে? আমরা কিছু বলবো না। শুধু বলবো, বুঝহ সুজন, যে জানো সন্ধান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।