শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মো. আলতাফ হোসেন হৃদয় খান
সংস্কৃত শব্দ ‘পুস্তিকা’ শব্দ থেকে পুঁথি শব্দটির উৎপত্তি। এর নাসিক্য উচ্চারণ পুঁথি। হাতে লেখা বইকে আগে ‘পুস্তিকা’ বলা হতো। যেহেতু আগের দিনে ছাপাখানা ছিল না, তাই তখন হাতে পুঁথি লেখা হতো। প্রাচীন বা মধ্যযুগের প্রায় সব সাহিত্য হাতে লিখতে হয়েছিল এবং এদের একাধিক সংস্করণও তৈরি হয়েছিল হাতে লিখে। তাই প্রাচীন ও মধ্যযুগের সব সাহিত্যকেই পুঁথিসাহিত্য বলা হয়।
বাংলার সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বকীয়তা রয়েছে তার বড় একটি প্রমাণ নাগরীলিপি ও সাহিত্য। কয়েকশ’ বছর আগে ভাষাটি সিলেট অঞ্চলে প্রলিত ছিল। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও টিকে আছে তার কিছু ইতিহাস, দলিল বা পুঁথি। কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা এবং আসামের কিছু অঞ্চলে এর ব্যবহার ছিল। সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে এ বর্ণমালাটি বিলুপ্ত হতে চলেছে। চর্চা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই বলা চলে নাগরীলিপির উৎপত্তি ও বিস্তার নিয়ে নানা মতপার্থক্য থাকলেও এটির সংরক্ষণ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করবে। বিলুপ্তপ্রায় দুর্লভ এ লিপিসংবলিত কিছু পুঁথি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যা হারিয়ে যাওয়া সাহিত্যের বিশাল একদিককে আবারও পাঠক আগ্রহী করে তুলতে পারে।
নাগরীলিপি ও সাহিত্য সিরিজ প্রথম কিস্তিতে ১০ খ-ে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থস্থ হয়েছে মুন্সী সাদেক আলীর হাসর মিসিল, কেতাব ভালতুন নবী ও মুহাব্বত নামা, মুন্সী আবদুল করিমের সোনাভানের পুঁথি, মুহম্মদ খলিলের চন্দর মুমি, ছৈয়দুর রহমানের দেশচরিত্র, মুন্সী ইরফান আলীর ছয়ফুল বেদাত এবং কড়ি নামা (অজ্ঞাত), হরিণনাম (অজ্ঞাত) পুঁথি। এক সময় গ্রামীণ বিনোদন বলতে ছিল পুঁথি পাঠ। মহল্লার বয়স্ক মানুষের দরাজ কণ্ঠে পঠিত হতো পুঁথি। পাঠ শুনতে জড় হতো কিশোর, বৃদ্ধা সবাই। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পালা করে অনুষ্ঠিত হতো পুঁথি পাঠের আসর। পুঁথি পাঠের সেই সুর এখন আর শোনা যায় না। রাতের নীরবতা ভাঙে হালের ব্যান্ড গানে। পুঁথি লেখা হতো তালপাতায় কিংবা তুলট কাগজে। সেসব পুঁথি এখন দেখারও সুযোগ নেই। নতুন প্রজন্মের অনেকেরই পুঁথি পাঠ শোনার সুযোগ হয়নি।
নগর সংস্কৃতিতে পুঁথি পাঠ শোনার সুযোগ একেবারেই বন্ধ। অন্যদিকে কোনো কোনো গ্রামে যৎসামান্য পুঁথি পাঠ শোনা গেলেও তা চট্টগ্রামে বিলুপ্তপ্রায়। প্রাচীন সব পুঁথি এখন হয় জাদুঘরে নতুবা ব্যক্তিগত সংগ্রহে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির দুষ্প্রাপ্য শাখায় রয়েছে পুঁথির দুর্লভ সংগ্রহ। সেখানে রয়েছে তুলট কাগজ, তালপাতা ও বাঁশখ-ের উপর বাংলা, সংস্কৃতি পালি, আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় লেখা ৫৬৫টি পান্ডুলিপি। শুধু কি পুঁথি! বাংলাদেশের অন্যতম এই গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপিতে। গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ এই গ্রন্থাগারকে মহিমান্বিত করে রেখেছে। গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য শাখায় এমন দুর্লভ পান্ডুলিপি রয়েছে যা দেশের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে গড়ে উঠা গ্রন্থাগারটি ক্রমেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানে পরিণত হয়েছে। ৫৫ হাজার ৭শ বর্গফুট আয়তনের গ্রন্থাগার ভবনে রয়েছে কলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, সমাজবিজ্ঞান, আইন অনুষদের পৃথক পাঠকক্ষ এবং সংলগ্ন বইয়ের তাক। এছাড়া পত্রপত্রিকা, দুষ্প্রাপ্য বই এবং রেফারেন্স শাখার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা পাঠকক্ষ এবং সংলগ্ন তাক।
গন্থাগারে দেশি-বিদেশি বই ও জার্নাল রয়েছে প্রায় ২ লাখ। গবেষকদের গবেষণা কর্মের উপাত্ত হিসেবে চিহ্নিত প্রাচীন পান্ডুলিপি, দুর্লভ বই, দলিল, সাময়িকীসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত নানা প্রকাশনা। আড়াইশ থেকে একশ বছরের মধ্যে অনুলিখিত পান্ডুলিপি রয়েছে এই গ্রন্থাগারে। যার সংগৃহীত পুঁথি, পুস্তক ও পান্ডুলিপি নিয়েই প্রথম যাত্রা দুষ্প্রাপ্য শাখার তিনি হলেন পুঁথি সাংগ্রাহক আব্দুস সাত্তার চৌধুরী। সংগ্রহশালাটি সমৃদ্ধ হয়েছে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ক্ষেমেশ চন্দ্র রক্ষিত, নজরুল ইসলাম, ড. রশীদ আল ফারুকী ও ড. আব্দুল গফুর প্রদত্ত সংগ্রহ থেকে। এখানে রয়েছে সফর আলী রচিত ‘গোলে হরমুজ খান’, গযাস রচিত ‘বিজয় হামজা’; আব্দুল নবী রচিত ‘বিজয় হামজা’; জিন্নাত আলী রচিত ‘মনি উল বেদায়াত’; সৈয়দ গাজী রচিত ‘হর গৌরভ পুঁথি’; হামিদল্লাহ খাঁ রচিত ‘ধর্ম বিবাদ; পরাগল খাঁর ‘মহাভারত’; দুর্লভ কোরআন, হাদিস, ফেকাহ শাস্ত্র। দুষ্প্রাপ্য শাখায় পুরনো ছাপা পুঁথি আছে প্রায় দুইশ’। ইতিহাস, সাহিত্য, সমাজ বিজ্ঞান, ধর্মবিষয়ক প্রায় ৩ হাজার পুরনো পুস্তক রয়েছে। রয়েছে সাড়ে তিন হাজার পুরনো সাময়িকী। এরমধ্যে অঞ্জলি, অনুসন্ধান, আর্যাবর্ত, ভারতী, আল ইসলাম, ইসলাম প্রচারক, আলো, এডুকেশন, গেজেট সাপ্তাহিক বার্তাবহ, ছায়াবীথি, পূর্ণিমা, ঢাকা রিভিউ, প্রকৃতি, প্রতিভা, ভা-ার, প্রবাসী, বঙ্গীয় সাহিত্য বিশারদ পত্রিকা, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাধনা, পাঞ্চজন্য, পুরবী, সীমান্ত অগ্রগতি, পূর্ব পাকিস্তান ইত্যাদি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুর্লভ সংগ্রহে বাঙালির বহু অনাবিষ্কৃত উপাদান লুকায়িত রয়েছে। নতুন প্রজন্মের গবেষকদের পুঁথিবিষয়ক গবেষণায় উৎসাহিত করলে অনেক অজানা বিষয় উদ্ধার হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।