চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
আল্লামা ইকবাল তাঁর এক কবিতায় লিখেছেন, ‘ওহ যামানা মে মুআযযায থী হামেলে কুরআন হো কর/ আওর তুম খার হুয়ী তারেকে কুরআন হো কর’Ñ অর্থাৎ ইসলামের প্রথম যুগের মানুষ সম্মানিত ছিলেন কুরআনের বাহক হয়ে, আর তোমরা অপদস্থ হচ্ছো কুরআন ছেড়ে দিয়ে। কবি ইকবাল যথার্থই বলেছেন। পুরো মুসলিম উম্মাহ আজ ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং অন্তর্জাতিকভাবে যেখানেই অধপতন ও আগ্রাসনের শিকার, গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এর মূলে হলো পবিত্র কুরআন থেকে আমাদের দূরে সরে যাওয়া। সময় যত গড়াচ্ছে কুরআন থেকে আমাদের দূরত্ব ততোই বাড়ছে। কুরআন না আছে আমাদের সকালের তেলাওয়াতে, না আছে সারাদিনের ব্যস্ততায়। না আছে আমাদের পারিবারিক শাসনে, না আছে সুস্থ সুন্দর সমাজ গঠনে। কুরআন নেই আমাদের চেতনায়, নেই আমাদের দিনরাতের ভাবনায়। কুরআনের ভেতরে আমরা খুঁজি না আগামী দিনের প্রেরণা, কুরআন নিয়ে নেই আমাদের কোনো তাড়না। কুরআন নেই আমাদের জীবন সমস্যা সমাধানে, নেই উম্মাহর রাষ্ট্রীয় সংবিধানে। মহাগ্রন্থ নেই আমাদের বিচারে, নেই কুরআনের বাহকদের প্রচারে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রসহ সর্বক্ষেত্রে আমরা সর্বগ্রাসী অধপতনের শিকার হয়েছি।
বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ যেসব ক্ষেত্রে অধপতনের শিকার তার মধ্যে অন্যতম হলোÑ নৈতিক অধপতন, বিজাতীয় সংস্কৃতি লালন, ধর্মহীন শিক্ষাগ্রহণ, নাস্তিকতা পালন, স্বৈরশাসকদের তোষণ, দুর্বল ও প্রতিবেশির প্রতি অবহেলা, নিজের স্বকীয়তা ভুলে যাওয়া, নববী আদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়া, সত্যের পথে মানুষকে না ডাকা, অন্যায় থেকে বিরত না রাখা, অন্যের অধিকারের ব্যাপারে বেপরোয়া মানসিকতা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, বেপর্দা, ইসলামী খেলাফতের প্রতি অনীহা, উপনৈবেশিক শক্তির চাটুকারিতা, নিজ মাতৃভূমি অন্যের হাতে তুলে দেয়া, নিজ ভূমিতে অন্যকে দখল করে থাকতে দেয়া, প্রতিরোধশক্তি হারিয়ে ফেলা, ইসলামের প্রতিরোধ ও প্রতিশোধব্যবস্থা অপাত্রে ব্যবহার করা ইত্যাদি। গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, এ সমস্যাগুলোর প্রতিশেধক পবিত্র কুরআনে বলে দেয়া হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে কুরআনের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। কিন্তু আমরা তো কুরআন থেকে দূরে, বহু দূরে!
যে পবিত্র কুরআন আমাদের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার সংবিধান সেই কুরআন আজ সংকুচিত হতে হতে নামাযের তেলাওয়াত, তাবিজ-কবজ এবং ইসালে সাওয়াবের খতমের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। কোনো সমস্যায় আক্রান্ত হলে আমরা মসজিদ-মাদরাসায় গিয়ে কুরআনের একটি কপি হাদিয়া দিয়ে আসি, অথচ একবারও ভাবি না, এই কুরআন খুললেই আমি আমার সমস্যার সামাধান পেয়ে যেতাম! কারণ মহান আল্লাহ তাআলা তো মানবজাতির যাবতীয় সমস্যা ও প্রয়োজন খুলে খুলে বর্ণনা করার জন্যই কুরআন নাজিল করেছেন। কুরআনে জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান রয়েছে। আগে-পরের যতকিছু আছে তার সবই আছে কুরআনে।Ñ(দ্রষ্টব্য : সূরা নাহল : ৮৯; সূরা আনআম : ৫৯; সূরা নামল : ৭৫; তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/৭১৪)
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাযি.)-কে একলোক বলেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। উত্তরে তিনি বলেন, ‘তুমি আল্লাহর কিতাবকে রাহবার হিসেবে গ্রহণ কর। কুরআনকে তোমার বিচারক বানাও। কারণ এটাই সেই বস্তু যা তোমাদের রাসূল তোমাদের জন্য রেখে গেছেন। কুরআন তোমার জন্য সুপারিশকারী। কুরআন তোমার জন্য অনুসরণীয়। কুরআন এমন এক সাক্ষী যার সাক্ষ্য নিয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকবে না। এতে তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের আলোচনা আছে। তোমাদের জীবনের যাবতীয় বিষয়ের সমাধান আছে। এখন যা হচ্ছে এবং সামনে যা হবে তার সবই কুরআনে আছে।’Ñ(সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী ১/৩৯২)
অধপতন থেকে উত্তরণের উপায়
মুসলিম উম্মাহ পবিত্র কুরআন থেকে দূরে সরে যাওয়ার মাধ্যমেই অধপতনের শিকার হয়েছে, সুতরাং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কুরআনের কাছে ফিরে আসার মাধ্যমেই হবে। যে জাতিকে আল্লাহ তাআলা কুরআন দিয়ে সম্মানিত করেছেন সে জাতি যদি কুরআন থেকে দূরে সরে অন্য কোথাও নিজেদের সম্মান খোঁজে তবে আল্লাহ তাদেরকে পদে পদে লাঞ্ছিত করবেন, এটাই স্বাভাবিক। যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কুরআনের মাধ্যমে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এনেছেন তারা যদি কুরআন ছেড়ে আবার অন্ধকারে ফিরে যায় অথবা ভিন্নপথে আলো খোঁজে তবে তাদের কপালে অধপতনের কলঙ্কতিলক সুনিশ্চিত। পবিত্র কুরআনকে আমাদের চরিত্রের মধ্যে গেঁথে নিতে পারলেই এ সমস্যা থেকে আমাদের উত্তরণ সম্ভব। আম্মাজান হযরত আয়েশা (রাযি.)-কে কেউ একজন জিজ্ঞাসা করেন, আল্লাহর রসূলের চরিত্র কেমন ছিল? উত্তরে আয়েশা (রাযি.) বলেন, কুরআনই আল্লাহর রাসূলের চরিত্র ছিল।Ñ(সহীহ মুসলিম : ৭৪৬)
বলা বাহুল্য, কুরআনকে চরিত্র বানানোর অর্থ হাদীস ছেড়ে দেয়া নয়। কুরআন অনুসরণ করতে গেলে হাদীসকেও অবশ্যই মানতে হবে। কারণ কুরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহকে অনুসরণ করার নির্দেশের সাথে সাথে আল্লাহর রাসূলকে অনুসরণের কথাও বলা হয়েছে। এজন্যই প্রিয় নবীজি এ উম্মতকে অধপতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষনে পবিত্র কুরআনকে আকড়ে ধরার পাশাপাশি সুন্নাতে রাসূলকেও আকড়ে ধরতে বলেছেন। হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ (রাযি.) বলেন, আল্লাহর রাসূল বিদায় হজের ভাষণে ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে দুইটি বস্তু রেখে যাচ্ছি, তোমরা যতদিন এ দুইটি বস্তু আকড়ে রাখবে ততদিন তোমরা পথ হারাবে নাÑ আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাত (হাদীস)।’Ñ(সহীহ মুসলিম : ১২১৮; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৬৫৬৪; সুনানে আবুদাউদ : ১৯০৫; সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩০৭৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১৪৭০৫)
যতদিন মুসলমানের হাতে থাকবে কুরআন, পথ হারাবে না মুসলমান। যতদিন মুসলমানের জীবনে থাকবে রাসূলের পয়গাম, ততদিন সমুন্নত থাকবে মুসলিম উম্মাহর জয়গান। এটাই এ উম্মতের অধপতনের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। তাইতো ইমাম মালেক রহ. বলেছেন, ‘এ উম্মতের পরবর্তীরা সেভাবেই সংশোধন হবে যেভাবে সংশোধন হয়েছে তাদের পূর্ববর্তীরা।’ যে জাতি সর্বশ্রেষ্ট জাতির সম্মানে ভূষিত হয়েছে কুরআনের কারণে, সে জাতির শ্রেষ্ঠত্ব ফিরে আসবে কুরআন দিয়েই। অন্য কোনো মতবাদ ও দর্শন কিংবা ভিন্ন কোনো পথ ও সংবিধান এ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব ফিরে আনতে পারবে না এবং তা সম্ভবও নয়। এখানে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)Ñএর সেই ঐতিহাসিক উক্তিটি খুবই প্রাসঙ্গিক, বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয়ের প্রাক্কালে তিনি সাহাবী হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রায.)-কে বলেন, ‘নাহনু কওমুন আ’আযযানা-ল্লাহু বিল ইসলাম ফা মাহমাব তাগাইনাল ইজ্জাতা ফী গাইরিহী আযাল্লানা-ল্লাহু’ আর্থাৎÑ আমরা সেই জাতি যাদেরকে আল্লাহ ইসলাম দিয়ে সম্মানিত করেছেন, সুতরাং আমরা যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে সম্মান খুঁজি তবে আল্লাহ আমাদেরকে পদে পদে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবেন।’ আর এতে কোনো সন্দেহ নেই, ইসলাম আমাদের নিকট এসেছে কুরআনের মাধ্যমে। তাই কুরআনের কাছে ফিরে যাওয়ার মাধ্যেই আমাদের সম্মান এবং এ জাতির অধপতন থেকে বাঁচার উপায় নিহিত রয়েছে। তাই আসুন কুরআনের পথে। আসুন আমাদের হারানো সম্মান ও ইজ্জতের পথে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।