দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
কুরআনুল করীম আল্লাহ্ তাআলার ওহী, আল্লাহ্ তাআলার নৈকট্য লাভের মাধ্যম, সকল আসমানী কিতাব সমূহের সারাংশ, সকল জ্ঞানের ঝর্ণাধারা, হিদায়তের সমষ্টি, রহমত এবং বরকতের ভান্ডার, এমন নূর যা দ্বারা পথভ্রষ্টতার
সকল অন্ধকার দূর হয়ে যায়, সংশোধন এবং প্রশিক্ষণের এমন এক ব্যবস্থা যা মানুষের জাহির এবং বাতিনকে পবিত্র করে তাকে অতুলনীয় বানিয়ে দেয়, এমন বিশ্বস্ত সাথী যে কবরেও সঙ্গ অবলম্বন করে, অন্তিম মুহুর্তে ও কবরে এবং হাশরে বিশ্বস্ততার হক আদায় করবে। এতে রোগাক্রন্ত মনের শিফা রয়েছে, যে একে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরলো সে হিদায়ত প্রাপ্ত হয়ে গেলো, যে এর উপর আমল করলো সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা পেয়ে গেলো। ইরশাদ হচ্ছে: আর আমি আপনার উপর এই কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বিবরণ, হিদায়াত, দয়া ও সুসংবাদ মুসলমানদের জন্য। মহান আল্লাহ তায়া’লা আরো ইরশাদ করেন: এটা (কুরআন) মানব জাতির জন্য স্পষ্ট বর্ণনা ও পথ-প্রদর্শন এবং পরহেযগারদের জন্য উপদেশ।
মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উপরোক্ত আয়াতের আলোকে বলেন: কুরআন শরীফের সাধারণ ফয়যান তো সাধারণ লোকের জন্য অর্থাৎ সকল কিছু বর্ণনা স্পষ্ট, কিন্তু বিশেষ ফয়য বিশেষ লোকের জন্য অর্থাৎ হিদায়ত দেয়া এবং সঠিক পথে লাগিয়ে দেয়া। (তিনি আরো বলেন:) কুরআনে করীমের বর্ণনা বা হিদায়ত হওয়া আমাদের জন্য, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য নয়, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম কে পূর্ব থেকেই সবকিছু শেখা পড়া এবং বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিলো এবং তিনি (হুযুর) আগে থেকেই হিদায়তের উপর ছিলেন।
হযরত মাওলা আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: অতি শীঘ্রই একটি ফিতনা সৃষ্টি হবে। আমি আরয করলাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ! এর থেকে বাঁচার উপায় কি হবে? হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আল্লাহ্ তাআলার কিতাব, যাতে তোমাদের পূববর্তী ও পরবর্তীদের সংবাদ রয়েছে এবং তোমাদের পরস্পরের সিদ্ধান্ত রয়েছে, কুরআন হচ্ছে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী এবং এটি কোন উপহাস নয়। যে অত্যাচারী একে ছেড়ে দেবে আল্লাহ্ তাআলা তাকে ধূলিস্যাৎ করে দেবেন এবং যে তা ব্যতীত অন্য কোথাও হিদায়ত খুঁজবে আল্লাহ্ তাআলা তাকে পথভ্রষ্ট করে দেবেন, তা আল্লাহ্ তাআলার শক্ত রশি এবং প্রজ্ঞাময় আলোচনা, তা হলো সঠিক পথ, কুরআন হলো এমন কিতাব, যার বরকতে কামনা বাসনা বিকৃত হয় না, অন্য ভাষা মিশ্রিত হয়ে একে সন্দেহপূর্ণ বানাতে পারে না, যার প্রতি ওলামারা উদাসীন হয় না, যা অধিকহারে পূনরাবৃত্তি করাতে পুরোনো হয় না, যার বিস্ময় শেষ হয় না, কুরআনই হলো এমন কিতাব, তাই যখন তা জ্বিনেরা শুনলো তখন এরূপ না বলে থাকতে পারলো না যে, আমরা আশ্চার্য কুরআন শুনলাম যা কল্যাণের প্রতি অগ্রণী ভূমিকা রাখে, তখন এর উপর ঈমান আনয়ন করলো, যে কুরআনের বক্তা সে সত্যবাদী, যে এর উপর আমল করেছে সে সাওয়াব পাবে, যে এর অনুযায়ী বিচার করবে সে ন্যায়পরায়ন হবে এবং যে এর দিকে ডাকবে তবে সে অবশ্যই সঠিক পথের দিকে আহবান করলো।
কোরআনুল করীম তেলাওয়াতের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ওই ব্যক্তি, যে নিজে কোরআন শিখে এবং অন্যকে শিখায়। হজরত আয়শা ছিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি কোরআনের জ্ঞানী হবে, কিয়ামতের দিন সে সম্মানিত ফেরেস্তাদের সঙ্গে থাকবে। আর যে কোরআন শিখার চেষ্টা করবে, শিখতে শিখতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে অর্থাৎ শিখার জন্য সে চেষ্টা করে, তার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোরআনের একটি অক্ষর পড়বে বিনিময়ে তাকে একটি সওয়াব দেওয়া হবে। আর প্রতিটি সওয়াব ১০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে।
কিয়ামতের ভয়াবহ দিন যখন আপনজন ও ধনস¤পদ কোনো কাজে আসবে না, তখন কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। হজরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা কোরআন তেলাওয়াত কর। কারণ কিয়ামতের দিন কোরআন তার তেলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে। অন্য হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন কোরআন তার তেলাওয়াতকারী ও আদেশ-নিষেধ মান্যকারীকে বলবে, আমাকে চিনতে পারছো? আমি সেই কোরআন যে তোমাকে রোজার আদেশ দিয়ে দিনে পিপাসার্ত আর রাতে নামাযে রত রেখেছিল। প্রত্যেক ব্যবসায়ীই তার ব্যবসার মাধ্যমে লাভবান হতে চায়। আজ তুমি সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছ। তারপর ওই বান্দার ডান হাতে বাদশাহি, বাম হাতে জান্নাতে বসবাসের পরোয়ানা দেওয়া হবে। মাথায় নূরের তাজ পরানো হবে এবং বলা হবে, কোরআন পড়তে থাকো আর উচ্চ মাকামে উঠতে থাকো।
যখন এই ঐশী বাণীর জ্যোতি সমাজে পড়ে তখন অন্ধকার আলোতে পরিনত হয়ে যায়, চারিদিকে হিদায়তের নূর ছড়িয়ে পড়ে, গুনাহে লিপ্ত লোকেরা যখন হিদায়তে ভরা আয়াত শুনে তখন কুরআনের নূরে তার অন্তর আলোকিত হয়ে যায়, তাদের অন্তরে খোদাভীতি সৃষ্টি হয় এবং সে শুধুমাত্র নিজেই গুনাহ থেকে তাওবা করে নামায ও সন্নাতের পথে পরিচালিত হয় না বরং মুসলমানদের নেতা এবং পথহারা লোকদেরও পথনির্দেশক হয়ে যায়। যার তিলাওয়াত শ্রবণ করে মানুষের মন কেঁপে উঠে, শরীরের লোম খাঁড়া হয়ে যায়, মানুষের আখিরাতের চিন্তা নসীব হয়ে যায় এবং বড় বড় গুনাহগারদের সত্যিকার তাওবার তৌফিক অর্জিত হয়। হযরত সায়্যিদুনা সালিহ মুররি বলেন: একদা সেতারা (এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র) বাদিকা এক মহিলা কুরআন তিলাওয়াতকারীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলো, তখন তিনি (তিলাওয়াতকারী) ২১ পারার সূরা আনকাবুতের ৫৪ নং আয়াত ( অর্থাৎ-এবং নিশ্চয় জাহান্নাম পরিবেষ্টন করে আছে কাফিরদেরকে;) তিলাওয়াত করছিলেন, এই আয়াতে করীমা শুনতেই মহিলাটি সেতারা ফেলে দিয়ে একটি উচ্চস্বরে চিৎকার দিলো এবং বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো, যখন হুঁশ ফিরলো তখন সেতারা ভেঙ্গে ইবাদত ও রিয়াযতে এমনভাবে লিপ্ত হয়ে গেলো যে, আবিদা ও যাহিদা রূপে প্রসিদ্ধ হয়ে গেলো। একদিন আমি তাকে বললাম যে, নিজের সাথে একটু নম্রতা প্রদর্শন করুন! একথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে বললো: আহ! আমি যদি জানতে পারতাম যে, জাহান্নামীরা তাদের কবর থেকে কিভাবে বের হবে! পুলসিরাত কিভাবে অতিক্রম করবে? কিয়ামতের ভয়াবহতা থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে? ফুটন্ত গরম পানির ঢোক কিভাবে পান করবে? আল্লাহ্ তাআলার গযবকে কিভাবে সহ্য করবে? এতটুকু বলার পর আবারো বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলো, যখন হুঁশ ফিরলো তখন আল্লাহ্ তাআলার দরবারে এভাবে আরয করলো: হে আমার প্রতিপালক! আমি যৌবনে তোমার অবাধ্যতা করেছি এবং দূর্বল (বৃদ্ধ) অবস্থায় তোমার আনুগত্য করছি, তুমি কি আমার ইবাদত কবুল করবে? অতঃপর সে এক হৃদয়বিদারক শব্দ করলো এবং বললো: আহ! কিয়ামতের দিন কতইনা লোকের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাবে, অতঃপর সে একটি চিৎকার দিলো এবং এমন হৃদয় বিদারক ভঙ্গিতে কাঁদলো যে, উপস্থিত সকলেই বেহুঁশ হয়ে গেলো।
হযরত সায়্যিদুনা ফুযাইল বিন আয়ায একজন ভয়ঙ্কর ডাকাত ছিলেন যে, পুরো পুরো কাফেলাকে একাই লুট করে নিতেন। একবার একটি কাফেলা তার এলাকার পাশ দিয়ে অতিμম করছিলো, তাদের সেখানেই রাত হয়ে গিয়েছিলো। তিনি লুটতরাজ করার জন্য যখন কাফেলার নিকটে পৌঁছলেন তখন কতিপয় কাফেলার সদস্যদের এরূপ বলতে শুনলেন: তোমরা ঐ লোকালয়ের দিকে যেও না বরং অন্য কোন পথে গমন করো, এখানে ফুযাইল
নামক এক ভয়ঙ্কর ডাকাত থাকে। যখন তিনি কাফেলার সদস্যদের এই কথা শুনলেন তখন তার মাঝে কম্পন শুরু হয়ে গেলো এবং উচ্চ স্বরে বললেন: হে লোকেরা! আমি ফুযাইল বিন আয়ায তোমাদের সামনেই বিদ্যমান, যাও! নির্ভয়ে চলে যাও, তোমরা আমার থেকে নিরাপদ। আল্লাহ্র শপথ! আজকের পর আমি আর কখনো আল্লাহ্ তাআলার অবাধ্যতা করবো না। এতটুকু বলেই তিনি সেখন থেকে চলে গেলেন এবং নিজের পূর্ববর্তী সকল গুনাহ থেকে তাওবা করে সত্য পথের মুসাফিরদের সাথে অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেলেন। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি সেই রাতে কাফেলার সদস্যদের দাওয়াত দিলেন এবং বললেন: তোমরা ফুযাইল বিন আয়ায থেকে নিজেকে নিরাপদ ভাবো, অতঃপর তিনি তাদের পশুদের জন্য খাবার আনতে চলে গেলেন, যখন ফিরে এলেন তখন কাউকে কুরআনে পাকের সূরা হাদীদের ১৬ নং আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনলেন:(অর্থাৎ ঈমানদারদের জন্য কি এখনো ঐ সময় আসেনি যে, তাদের অন্তর ঝুঁকে পড়বে আল্লাহ্র স্মরণে।) কুরআনে করীমের এই আয়াত প্রভাবময় তীর হয়ে তাঁর বুকে বিদ্ধ হয়ে গেলো। তিনি কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন এবং নিজের কাপড়ে মাটি ঢালতে ঢালতে বললেন: হ্যাঁ! কেন নয়! আল্লাহ্র শপথ! এখন সময় এসে গেছে, এখন সময় এসে গেছে, তিনি এভাবে কাঁদতে লাগলেন অতঃপর নিজের পূর্ববর্তী সকল গুনাহ থেকে তাওবা করে নিলেন। (উয়ুনুল হিকায়াত, ২/১৭)
একবার ভাবুন যে, যেই কালামে পাক শ্রবণ করার কারণে এই বরকত অর্জিত হয় যে, বড় বড় অপরাধী সঠিক পথে ফিরে আসে এবং আল্লাহ্ তাআলার অনুগত হয়ে যায়। আর যেই সৌভাগ্যবান মুসলমান এই পাক কালামের তিলাওয়াতের পাশাপাশি এর বিধানাবলীর উপর আমল করে তবে তার কিরূপ বরকত নসীব হবে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল করীমের নির্দেশনাবলী নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করার তওফিক দান করুন, আমীন! বিজাহিন নবিয়্যিল আমীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
লিখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা;এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।