দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পূর্ব প্রকাশিতের পর
মাটি থেকে ফুয়ারা প্রবাহিত: আল্লাহতায়ালা যখন হজরত আদম (আ:) কে সৃষ্টি করার মনস্ত করলেন তখন মাটিকে বললেন, আমি তোমা থেকে এমন এক মাখলুক সৃষ্টি করবো, এদের মধ্যে যারা আমার অনুগত হবে তাদেরকে আমি জান্নাতে প্রবেশ করাবো আর যারা আমার অবাধ্য হবে আমি তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। তখন মাটি আরজ করলে- হে বারীতায়ালা! আমা থেকে সৃষ্ট মাখলুক জাহান্নামে যাবে? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ। একথা শুনে মাটি এত বেশি ক্রন্দন করেছে যে, তার ক্রন্দনে মাটিতে নদী-নালা তথা পানির ফুয়ারা সৃষ্টি হলো যা কেয়ামত পর্যন্ত প্রবাহিত হতে থাকবে। (সাবী আলাল জালালাইন, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪, সূত্র: আল্লামা জুলফিকার আলী, জামে কাসাসুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা-২৯)
মানবজাতির জীবনে দুঃখ-কষ্ট: হজরত আজরাইল (আ:) পৃথিবী থেকে মাটি নিয়ে আসলে আল্লাহতায়ালা আদেশ দিলেন যে, মাটিগুলো সাফা ও মারওয়া পর্বতদ্বয়ের নিকট রাখো। অতঃপর ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন যে, বিভিন্ন ধরনের পানি দিয়ে খামির করা হোক। এরপর চল্লিশ দিন যাবত বৃষ্টিপাত হতে লাগলো। উনচল্লিশ দিন পর্যন্ত দুঃখ-দুর্দশার পানি দ্বারা বৃষ্টিপাত হলো। আর মাত্র একদিন আনন্দের পানির বৃষ্টিপাত হলো। এ কারণেই মানবজীবনের অধিকাংশ সময় দুঃখ দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়। আর সুখ-স্বাচ্ছন্দ হয় মাত্র অল্প সময়। (আল্লামা ইবনে কাসীর, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা-৭৭)
বিভিন্ন জায়গার মাটি দিয়ে আদম (আ:) এর দেহ তৈরি: হজরত আবু মুসা আশয়ারী সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (সা:) এরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ:) কে সমগ্র পৃথিবীর মাটি থেকে সংগৃহীত মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। আদম (আ:)’র সন্তানগণ মাটির গুণাবলী অনুযায়ী সৃষ্ট। কেউ কঠোর প্রকৃতির, কেউ শান্ত প্রকৃতির, কেউ মধ্যমপন্থী স্বভাবের। আবার কেউ শুভ্র, কেউ লাল এবং কেউ কালো বর্ণের আবার কেউ এগুলোর মধ্যবর্তী বর্ণের সৃষ্ট। কেউ মন্দ, কেউ সৎ আবার কেউ উভয় দোষে-গুণে সৃষ্ট। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা:) এরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা আদি মানব আদম (আ:) কে দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গার মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। কাবা ঘরের মাটি দ্বারা মাথা, পাক ভারতের মাটি দ্বারা পেট ও পৃষ্ঠদেশ, দুনিয়ার পূর্বে সীমান্তের মাটি দ্বারা দু’হাত এবং পশ্চিম সীমান্তের মাটি দ্বারা দু’পা সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে যে, তার মাথা মক্কা শরীফের মাটি দ্বারা, ঘাড় বাইতুল মুকাদ্দাসের মাটি দ্বারা, পেট ও পিট আদনের মাটি দ্বারা, হস্তদ্বয় পাক ভারতের মাটি দ্বারা, পাদ্বয় দুনিয়ার পূর্ব সীমান্তের মাটি দ্বারা এবং অস্থি, চর্ম ও মাংস পশ্চিম সীমান্তের মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। এভাবে হজরত আদম (আ:)’র দেহ তৈরি করে তা বেহেশতের একপাশে চল্লিশ বছর পর্যন্ত সংরক্ষিত ছিলো। (মাওলানা তাহের সুরাটী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা-২১)
হজরত আদম (আ:) এর তাওবা: ইবনে মনযর (রহ.) এর বর্ণনায় দোয়াটি এভাবে বর্ণিত আছে- হে প্রভু! আপনার বিশেষ প্রিয় বান্দা মুহাম্মদ (সা:)’র যে সম্মান ও মর্যাদা আপনার নিকট রয়েছে এর ওসিলায় আমি ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আওয়াজ আসল, হে আদম! তুমি ওই মহান ব্যক্তিকে কিভাবে চিনলে? আদম (আ:) সব ঘটনা বর্ণনা করলে আল্লাহতায়ালা বললেন, হে আদম! ওই মাহবুব বান্দা সর্বশেষ নবী এবং তোমার সন্তান। যদি তিনি না হতেন তবে তোমাকেও সৃষ্টি করতাম না। আদম (আ:) এর তাওবা কবুলের দিনটি ছিলো মহররমের দশ তারিখ আশুরা ও জুমার দিন। তিনি তাওবার কালিমা পাওয়াতে খুশিতে উৎপল্ল হলেন। অজু করে বাইতুল্লাহ সম্মুখে দাঁড়িয়ে দু’রাকাত নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর ওই কালিমা দ্বারা দোয়া করলেন। তিনি জান্নাত থেকে অবতরণের সময় তাঁর শরীর মোবারকের রং কালো হয়ে গিয়েছিল। তাওবা কবুল হওয়ার পর আদেশ হলো চাঁদের ১৩,১৪ ও ১৪ তারিখে রোজা রাখার। অতএব তিনি এই তিন দিন রোজা রাখলে প্রতিদিন একতৃতীয়াংশ করে শুভ্র হতে লাগলেন। এভাবে পূর্বের ন্যায় তাঁর পুরো শরীর শুভ্র হয়ে গেল।
হজরত আদম (আ:) এর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ: তাফসীরে রুহুল মায়ানী গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, আল্লাহতায়ালা আদম (আ:) কে সকল বিষয়ের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন অর্থাৎ সৃষ্টিলগ্ন হতে যা হয়েছে এবং যা হবে সবকিছুর জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। ফেরেশতাদের ওপর হজরত আদম (আ:) এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ঔসব বস্তু সামগ্রিকে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করে বললেন, তোমরা আমাকে এগুলোর নাম বলো। ফেরেশতারা তাদের অক্ষমতা প্রকাশ করে বলল, আপনি পবিত্র, আপনি যা আমাদেরকে শিখিয়েছেন তা ব্যতীত আমরা কিছুই জানি না। নিশ্চয়ই আপনি প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, প্রজ্ঞাময়। অতঃপর আল্লাহতায়ালা ঐসব বস্তু সামগ্রীর দিকে ইঙ্গিত করে হজরত আদম (আ:) কে বললেন, হে আদম! তুমি এসব বস্তু সামগ্রীর নাম তাদেরকে বলে দাও। তখন হজরত আদম (আ:) ঔসব বস্তু সামগ্রী প্রত্যেকটির নাম, গুনাগুন, কার্যকারিতা সহ বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান দ্বারা। এভাবে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের ওপর হজরত আদম (আ:)’র শ্রেষ্ঠত্ব ও যোগ্যতা প্রমাণ করলেন।
ফেরেশতা কর্তৃক আদম (আ:) কে সেজদা: আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ:) এর শ্রেষ্ঠত্ব ও যোগ্যতা প্রমাণ করে ফেরেশতাদেরকে তাদের অহমিকা চুরমার করে দিয়ে হজরত আদম (আ:) কে সেজদার আদেশ দেন। আল্লাহতাআলার আদেশ পাওয়া মাত্র ফেরেশতারা সেজদায় পতিত হলো ইবলিশ ব্যতীত। সে অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষের বশীভূত হয়ে আদম (আ:) কে সেজদা না করে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে কাফির ও চির অভিশপ্ত হলো। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সেজদা করো তখন ইবলিশ ব্যতীত সকলে সেজদা করল; সে অমান্য করল ও অহংকার করল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হল। (সূরা বাকারা: আয়াত: ৩৪) (চলবে)
লেখক: আরবি প্রভাষক, চরণদ্বীপ রজভীয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম। এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।