শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সশস্ত্র বিপ্লবী, বাঘা যতীনের আতœদানে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক মহান সৈনিক এবং চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মহা নায়ক মাষ্টার দা’ সূর্য সেন ১৮৯৩ সালে ১৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার, রাউজান থানার অন্তর্গত নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পিতা এবং মাতা যথাক্রমে রাজমনি সেন ও শশী বালা।
সূর্য সেন চট্টগ্রাম, মুর্শিদাবাদের বহরমপুর জেলার বহরমপুর কলেজে পড়া শোনা করেন। পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি, এ পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হন। বহরমপুর কলেজে অধ্যয়ন কালে তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তীর মাধ্যমে তিনি গোপন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে পরিচিত হন এবং অবিভক্ত ভারতের মুক্তির জন্য বিপ্লবী সংগ্রামের যোগদানের প্রেরণা লাভ করেন।
শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে সূর্য সেন চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ান বাজার এলাকার “উমাতারা” উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন নিরহঙ্কার, অনাড়ম্বর, বিনয়ী, স্বল্পভাষী ও নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। দৃঢ় চরিত্রের জন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেন এবং সাধারণ ভাবে ‘মাষ্টার দা’ নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। ১৯১৯ সালের গোড়ার দিকে কানুনগো পাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের কন্যা পুষ্প কুন্তলার সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সূর্যসেন চট্টগ্রামের বিপ্লবী কর্মী অনুরূপ সেন, চারু বিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমূখের সঙ্গে গোপন বিপ্লবী দল গঠনের কাজ শুরু করেন। দুরদর্শিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবলে তিনি কিছুদিনের মধ্যেই দলের নেতা হিসাবে স্বীকৃত হন। দেশের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবী সূর্যসেন প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে তিনি ছেড়ে দিলেন শিক্ষকতা। ছেড়ে দিলেন সংসার, হলেন সর্ব ত্যাগী, মুক্তির সাধক। বিপ্লবী তরুণ সমাজের সর্বাধিনায়ক।
১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সূর্য সেন যুবক দের বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার কাজে আতœনিয়োগ করেন। কিছু দিন পর গান্ধিজী অহিংস আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে সূর্য সেন অস্ত্র ক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিপ্লবীদের অর্থ সংগ্রহের নির্দ্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর তারই নির্দেশে অনন্ত সিংহ দেবেন দে ও নির্মল সেন চট্টগ্রাম শহরের উপকন্ঠে পাহাড় তলীতে অবস্থিত “আসাম বেঙ্গল” রেলওয়ে কোম্পানীর কারখানার কর্মচারীদের বেতন ভাতার সতেরো হাজার টাকা ছিনতাই করেন।
এর কিছুদিন পর পুলিশ গোপন সুত্রে খবর পেয়ে সূর্য সেনের আস্তানায় হানা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে একখন্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ “নগর খানা পাহাড় খন্ড যুদ্ধ” নামে ইতিহাসে পরিচিত। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে শারীরিক সার্মথ্য হারিয়ে সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী বিষ পানে আতœহত্যার পথ বেছে নেন। কিন্তু বিষ ক্রীয়া তীব্র না হওয়ায় তারা উভয়েই সে যাত্রায় বেচে যান এবং গ্রেপ্তার হন। তবে বিচারে তাঁদের কোন অপরাধ প্রমানিত না হওয়ায় তাঁরা অচীরেই মুক্তি লাভ করেন। ১৯২৬ সালে সূর্য সেন টের্গাট হত্যা প্রচেষ্ঠার দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে কারা ভোগ করেন এবং ১৯২৮ সালে বোম্বাইয়ের “রতœগিরি জেল” থেকে মুক্তি পান। ১৯২৯ সালের গোড়ার দিকে সূর্যসেন চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন এবং ঐ বছরই তারই নেতৃত্বে চট্টগ্রামে চারটি বড় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তন্মন্ধে জেলা যুব সম্মেলনটি উদ্ভোধন করেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু।
১৯৩০ সালের শুরুতে সূর্য সেন চট্টগ্রামে একটি সুসংঘটিত বিপ্লব সংঘটিত করার কাজে আতœনিয়োগ করেন। এ বছর ১৮ এপ্রিল তাঁর নেতৃত্বে মোট ৬০ জন বিপ্লবী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পাহাড়তলীর ফৌজি আস্ত্রাগার দখল করেন এবং চট্টগ্রামকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। সেইসঙ্গে চট্টগ্রামে সামরিক বিপ্লবী সরকার ও গঠন করা হয়। সশস্ত্র বিদ্রোহের চারদিন পর অর্থ্যৎ ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের উপকন্ঠে জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের সঙ্গে সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর সম্মূখ য্দ্ধু সংঘটিত হয়। সূর্যসেন আর লোকনাথ বলের চাতুর্যপূর্ণ আক্রমনে ইংরেজ বাহিনী পর্যুদস্ত ও পরাভূত হয়। পরবর্তীতে ইংরেজদের সঙ্গে বিপ্লবীদের আরো কয়েকবার খন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তখন সূর্যসেন আতœগোপন করে বিপ্লবী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য সরকার সে’সময় দশহাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন।
১৯৩৩ সালের ২রা’ ফেব্রæয়ারী সূর্যসেন তার এক নিকট আতœীয়ের বিশ্বাস ঘাতকতায় চট্টগ্রামের পটিয়ার গৈরালা গ্রামের ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাস নাম্নী এক পৌঢ়া মহিলার বাড়িতে অবস্থান কালে গুর্খা সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন। বিপ্লবী নেতা সূর্যসেন ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারী চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসিতে আতœহুতি দেন।
জাতির ইতিহাসে শহীদ সূর্যসেন অমর অক্ষয়। অবিভক্ত বাংলার মুক্তির বিপ্লবের ইতিহাসে আজও তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী বীর। মাষ্টারদা সূর্যসেন কে ফাঁসি কাষ্টে ঝোলানোর আগে তাঁকে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়েছিল। আঘাতে আঘাতে মাষ্টার দা’র সব দাঁত সেদিন উপড়ে তুলে নেয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ওরা ফাঁসি দিয়েছিল মাষ্টার দা’কে নয়, তাঁর রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত অচৈতন্য দেহটাকে।
সাম্রাজ্য বাদী ব্রিটিশ সরকার তার মৃত দেহ ১৫ মন পাথর বেঁধে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়েছিল। সভ্য দেশের ফাঁসির আসামির লাশ আতœীয় স্বজনদের কাছে ফেরত দেয়া হয়। আমি সে সময়ের ব্রিটিশ গর্ভনমেন্টকে সভ্য জাতি হিসেবে না অন্য কিছু হিসেবে অভিহিত করবো? মাষ্টার দা’ সূর্যসেন যিনি সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করেছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।