পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
খবরটা বেরিয়েছিল গত ৫ জানুয়ারির দৈনিক ইনকিলাব-এর প্রথম পৃষ্ঠায়। শিরোনাম ছিল: ‘ধানের শীষের সেই মনসুর ছাত্র লীগের সম্মেলনে’। প্রতিবেদনে বলা হয়: ধানের শীষের সেই সুলতান মুহাম্মদ মনসুর বাংলাদেশ ছাত্র লীগের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করলেন। গতকাল (শনিবার) বিকালে রাজধানীর সোহরওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। ড. কামাল হোসেনের অনুকম্পায় জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের এই নেতা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক পান। মৌলভী বাজার-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে বিজয়ী হয়ে বিএনপি ও ঐক্য ফ্রন্টের ড. কামাল হোসেনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসেই সংসদে যোগদান করেন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়: গতকাল (শনিবার) সুলতান মনসুরকে ছাত্র লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিন্ডলীর সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। নেতা মনসুরকে এতটা গুরুত্ব দেয়ার কারণ এই সুলতান মুহাম্মদ মনসুর অতীতে ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ছাত্র লীগের সভাপতি ছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন। এক এগারোর সময় বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে দল থেকে বাদ পড়েন। অনেক চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগে ফিরতে না পেরে আওয়ামী লীগ-বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এদল-ওদলের বৈঠকে বক্তব্য দেন। তিনি বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা ও শেখ হাসিনার কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করেন। এ জন্য ড. কামাল হোসেন দলবিহীন সুলতান মনসুরকে ঐক্য ফ্রন্টে নেন।
সুলতান মনসুর সম্পর্কে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়: ‘বিগত নির্বাচনের সময় দল না থাকায় প্রতীক পাওয়া নিয়ে বিড়ম্বনা এড়াতে ধানের শীষ প্রতীকের জন্য বিএনপি নেতাদের বাসায় দৌড়ঝাঁপ করেন। অবশেষে তাকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ৩শ’ বিএনপি প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার আগেই মির্জা ফখরুল দলবিহীন সুলতান মনসুরের হাতে ধানের শীষ প্রতীক আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন। অতঃপর তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রচারণায় নামেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েন। টানাহেঁচরা করে তাকে প্রহারও করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়: বিএনপির স্থানীয় নেতারা তাকে পিটুনি থেকে রক্ষা করেন। নির্বাচনের পর বিএনপি ও ঐক্য ফ্রন্টের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদে যোগদানের ঘোষণা দেন। ঐক্য ফ্রন্টের সঙ্গে বেঈমানীর কারণে তিনি দেশবিদেশের মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। তাঁকে নিয়ে অনেক রস গল্প প্রচার হয়।
সুলতান মুহাম্মদ মনসুর আহমেদকে নিয়ে এই দীর্ঘ আলোচনার ফলে এটা সুপ্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি যে কোনো উপায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কোনো দলের সাথে সম্পর্কিত থাকতে চান। অতীতে তিনি দীর্ঘ দিন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। সেখানে সুবিধা না পেয়েই তিনি নানা সময় এদল-ওদলে ঘোরাঘুরি করেন। তিনি যে আবার ছাত্র লীগের সম্মেলনে যোগ দিয়ে নিজেকে ছাত্র লীগের সমর্থনে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করে বক্তৃতা দেন, এর জন্য শুধু তাঁকে দোষ দেয়াও ঠিক হবে না। এজন্য আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভূমিকাও যে অনেকটা আংশিকভাবে দায়ী এ বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। কারণ সুলতান মুহাম্মদ মনসুর মূলতঃ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত দলের সঙ্গে থাকতে চান।
দেশে অবাধ গণতন্ত্র থাকলে তাঁর পক্ষে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের সাথে থাকার জন্য এতটা অস্থির হয়ে উঠতে হতো না। দেশে অবাধ গণতন্ত্র না থাকাতেই তাকে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে এতটা উন্মত্ত হয়ে উঠতে হচ্ছে।
দেশের নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, জেনারেল এরশাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে একদা দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে নির্দলীয় অস্থায়ী তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে যাবতীয় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে একমত হয়েছিলো, সেটাই ছিল বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে গণতন্ত্রের জন্য সবচাইতে সহায়ক। কারণ এই ব্যবস্থাধীনে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের অধীনে প্রথম নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলেও পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। শুধু তাই নয়। দেশে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে দেশের দুই প্রধান দল পালাক্রমে নির্বাচিত হতে পারায় এই পদ্ধতির বাস্তবতা সুপ্রমাণিত হয়।
পরবর্তীকালে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারি নেতাদের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধা মেটাতে এই সুন্দর ব্যবস্থাটি সংশোধন করে নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রবর্তিত করায় দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা শুধু অস্বীকারই করা হয় না, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সম্ভাবনারও অপমৃত্যু ঘটে। এরপর সেই যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তার আর পরিবর্তন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না।
এই কঠোর বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেই ক্ষমতাসীনদের সাথে থাকার লক্ষ্যে বহু ঘাটের পানি খাওয়া, তথা বহু দলে ঘোরাঘুরি করা সুলতান মুহাম্মদ মনসুর পুনরায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার লক্ষ্যে ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের পক্ষে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করে বক্তৃতা দিয়েছেন। সুতরাং এটাকে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের আদর্শ ও নীতির প্রতি আন্তরিক সমর্থন হিসাবে বিবেচনা না করে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিত কর্মপন্থা হিসাবে বিবেচনা করাই হবে অধিকতর বাস্তব সম্মত।
আমরা যারা তমদ্দুন মজলিসের সূচিত ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত ছিলাম, তারা ছাত্র লীগ ও আওয়ামী লীগের সম্পর্কে বিশেষভাবে আগ্রহী, তার কারণ তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে যে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়, তার প্রতি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারিতে জন্ম হওয়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ জন্ম থেকেই সমর্থন দেয়।
এ কারণে ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিনগুলোতে তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগ দীর্ঘকাল পর্যন্ত এক সাথে কাজ করে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো স্থানে (যেমন জামালপুর ও বাগেরহাটে) উভয় সংগঠন একই ভবনে অবস্থিত ছিল। তাছাড়া তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সঙ্গে ছিলেন এমন কিছু লোক (যেমন ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলাম) যারা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন।
রাজনৈতিক ইতিহাস গবেষকদের জানা থাকার কথা, ১৯৪৭ সালের মে মাসে সিলেট আসাম তথা ভারতের সাথে থাকবে, না বাংলাদেশ তথা পাকিস্তানের সাথে যোগ দেবে, এই প্রশ্নে যে দুই দিন ব্যাপী গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও যেতে না পারার কারণে ঐ গণভোটে যোগদানকারী এবং তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করেছিলেন; গণভোটে কাজ করার সুযোগে সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ অধ্যাপক আবুল কাসেম প্রমুখ তমদ্দুন মজলিস নামের যে আদর্শবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন তাদের চিন্তাধারার সঙ্গে মিল আছে এমন কোনো ব্যক্তির সন্ধান পেলে তার সন্ধান যেন নিয়ে আসেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম গণভোটে গিয়ে এ লক্ষ্যে বিশিষ্ট কথাশিল্পী শাহেদ আলীর সন্ধান পান এবং তাকে অধ্যাপক আবুল কাসেমের কথা বলেন। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের শাহেদ আলী ঢাকায় এসে ১৯ নং আজিমপুর রোডস্থ অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসায় ওঠেন। শুধু তাই নয়, তমদ্দুন মজলিসের ম্যানিফেস্টো-রূপী পুস্তক ‘একমাত্র পথ’ যৌথভাবে রচনায় অংশগ্রহণ করে তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রূপে সাংস্কৃতিক মহলে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেন।
বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে আমার কথা বলতে পারি যে, শাহেদ আলীকে এভাবে তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম নেতা রূপে না দেখলে আমার পক্ষে হয়ত তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে জড়িত হতে আরও বিলম্ব হতো। এর কারণ, কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক মোহাম্মদী, মাসিক সওগাত প্রভৃতি সাহিত্য পত্রিকায় শাহেদ আলীর গল্প পাঠ করে আমি আগে থেকেই শাহেদ আলীর ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। যাঁর গল্পের আমি ভক্ত, তাঁকে আমি কোনো দিন দেখতে পাবো এ ভরসা আমার ছিল না।
কিন্তু যা একদিন কল্পনায়ও ছিল না, তা বাস্তবে পরিণত হওয়ায় আমি শাহেদ আলীর ভক্ত হিসাবে তাঁর দেখাদেখি কবে যে কীভাবে একদিন তমদ্দুন মজলিসের একনিষ্ঠ সমর্থক ও কর্মী হয়ে গেলাম তা আমি নিজেও টের পাইনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।