Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

সড়কে বাড়ছেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, ভ্রাম্যমাণ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০৪ এএম

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রতিদিন দেশের কোথায় না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটছে। গতকাল সোমবার ৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটে দিনের শুরুতে ফরিদপুরে।

সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার যাওয়ার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল চিকিৎসক পরিবারসহ ৬ জনের। নিহত ডা. শরিফুলের ভায়রা ভাই মো. হান্নান জানান, সোমবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে গ্রামের বাড়ি থেকে ডা. শরিফুল পরিবারের ৫ সদস্য ও বন্ধু পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর ফারুককে নিয়ে মাইক্রোবাসে করে কক্সবাজারের উদ্যেশে রওনা হন। পথিমধ্যে সকাল পৌনে ৮টার দিকে ফরিদপুর সদর উপজেলার মল্লিকপুরে মাইক্রোবাসটি পৌঁছালে ঢাকা থেকে খুলনাগামী মামুন পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটির সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এসময় ঘটনাস্থলেই ছয়জনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ছোলনা গ্রামের ডা. শরিফুল, তার মেয়ে তাবাসসুম, শালিকা তাকিয়া, ভাতিজি তানজিলা, মাইক্রোবাসচালক নাহিদ ও ডা. শরিফুলের বন্ধু ঢাকা হেডকোয়ার্টারে কর্মরত পুলিশের সাবইন্সপেক্টর মো. ফারুক। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ডা. শরিফুলের স্ত্রী রিম্মি। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুজ্জামান জানান, মামুন পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে বোয়ালমারী উপজেলা থেকে ঢাকায় যাওয়া একটি মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মাইক্রোবাসের ছয়জন নিহত হন। বাসের চালক পালিয়ে গেলেও বাসটিকে জব্দ করা হয়েছে।

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা নিরাপদ সড়ক চাই বাংলাদেশের (নিসচা) হিসাবে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দুইই আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে বলে তদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ এ সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৮৮ জন বেশি নিহত হয়েছেন। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট মনে করে, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ঢাকা শহরটা খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। পথচারীরা ফুটপাত ব্যবহার করতে পারছেন না। তারা রাস্তায় নেমে হাঁটছেন। রাস্তায় অতিরিক্ত গাড়ির চাপও রয়েছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

এছাড়াও সারাদেশের সড়ক ও মহাসড়কে অদক্ষ চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, খামখেয়ালিপনা, জনসচেতনতার অভাব এবং দায়ী চালকের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির বিধান না থাকায় অহরহ ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই যন্ত্রদানবের হত্যার শিকার হয়ে দেশের বহু জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিজীবী, নিস্পাপ শিশু থেকে বৃদ্ধ, স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী প্রাণ হারাচ্ছেন। চিরদিনের মত পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অনেককেই। এদিকে বিষেশজ্ঞ মহল বলছেন, দুর্ঘটনার জন্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং পুলিশ অনেকাংশে দায়ী। রাজধানীর একমাত্র জাতীয় অর্থপেডিক (পঙ্গু) হাসপাতালে প্রতিনিয়ত রোগীদের বেশিরভাগই সড়ক দুর্ঘটনায় শিকার ব্যক্তিরা ভর্তি হচ্ছেন।

সড়ক নিরাপত্তার জন্য সরকার একের পর এক নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়কে বিশৃঙ্খলা চলছেই। এ কারণে প্রতিদিনই প্রাণ ঝরছে সড়ক-মহাসড়কে। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-বিক্ষোভ ও কোন কাজ হচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনায় সড়কে পড়ছে লাশ। খালি হচ্ছে মায়ের কোল।

গতকাল সোমবার দিনের অপর দুর্ঘটনাটি ঘটে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। শহরে ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী বাবা ও মেয়ে নিহত হয়েছেন। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার শহরের রাজরামপুরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার হরিপুর নতুনপাড়ার মৃত মুসলিম উদ্দিনের ছেলে গোলাম রাব্বানী (৫৫) ও তার মেয়ে সাদেকিনা রোশনী (৫)। গোলাম রাব্বানী ওষুধ ব্যবসায়ী। তার মেয়ে রোশনী রাজারামপুর কিন্ডার গার্ডেন প্রথম শ্রেনির ছাত্রী।

ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম জানান, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গোলাম রাব্বানী মেয়ে সাদেকিনা রোশনীকে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে আসছিলেন। এসময় রাজশাহীগামী একটি ট্রাক গোলাম রাব্বানীর মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান বাবা ও মেয়ে।

এদিকে সোমবার নীলফামারীর সৈয়দপুর-পার্বতীপুর সড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় মিন্টু হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। সকাল সাতটার দিকে এই দুর্ঘটনা হয়। নিহত ওই ব্যবসায়ী সৈয়দপুর উপজেলার হাজীপাড়ার মৃত মমতাজ উদ্দিনের ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই ব্যবসায়ী ভ্যানযোগে ফুলকটি নিয়ে পার্বতীপুর বাজারে যাওয়ার সময় সাইনবোর্ড এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের ধাক্কা লাগে। এতে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। গুরুতর আহত ভ্যান চালক জামিরুল ইসলামকে সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।

এদিকে, নীলফামারীর সৈয়দপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় এক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। গতকাল সোমবার সকালে সৈয়দপুর-পার্বতীপুর সড়কে বেলাইচন্ডী ইউনিয়নের কেশুরভাঙ্গা এলাকায় ওই দুর্ঘটনাটি ঘটে। নিহত ব্যবসায়ীর নাম মিন্টু (৪০)। তিনি সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের খোর্দ্দ বোতলাগাড়ী হাজীপাড়ার মমতাজ উদ্দিনের ছেলে। এছাড়া গত রোববার ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় কাভার্ড ভ্যান চাপায় মোটরসাইকেলের দুই আরোহী নিহত হয়েছেন। নিহতদের একজন চৌকিঘাটা গ্রামের মলয়েশিয়া প্রবাসী জামাল মোল্লার পুত্র সৌরভ (১৭)।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এআরআই)-এর মতে, দুর্ঘটনার অধিকাংশই ছিল বেপরোয়া গতি। যার জন্য ৯০ শতাংশই চালক-হেলপাররা দায়ী। বুয়েটের এআরআই-এর পরিচালক ডক্টর মিজানুর রহমান বলেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর কিছুদিন সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামলেও এখন আবারও সেই পুরোনো অবস্থা। নিয়মের তোয়াক্কা করছে না কেউ। জেব্রা ক্রসিং থাকলে সেখানে যেন গাড়ির গতি আরও বেড়ে যায়। যাত্রী ওঠানো-নামানোর চিত্র তো আরও ভয়াবহ। এছাড়া দুই বাসের প্রতিযোগিতা দেখলে আতঙ্ক ছড়ায় যাত্রীদের মাঝেই। এসবের জন্য পরিবহনের মালিকরাই দায়ী। তারাই চালকদের বাধ্য করে এসব পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে।
এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, চালকদের প্রশিক্ষণ, যানবাহনের ফিটনেস আধুনিকায়ন, রুট ফ্রাঞ্চাইজি সিস্টেমে বাস চলাচল নিশ্চিত করা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ, সড়কে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা বন্ধ করা, শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে সরকারের অঙ্গীকার আজও দৃশ্যমান নয়।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, দুর্ঘটনা তাকেই বলে যা কখন, কিভাবে, কোথায় ঘটবে তা মানুষ জানে না। কিন্তু যেটি আমাদের সৃষ্টি করা বা সহজে দূর করা যায় কিংবা সুনির্দিষ্ট কারণে ঘটে সেটিকে আর দুর্ঘটনা বলা যায় না, সেটি নিঃসন্দেহে হত্যাযজ্ঞ। এর জন্য সরকার কোনভাবেই দায় এড়াতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, যখনই কোনো চালককে আটক করা হয়, দেখা যায় তার রুট পারমিট অথবা লাইসেন্স কোনো কিছু একটা নেই। অথবা লাইসেন্স থাকলেও হালকা যানের লাইসেন্স নিয়ে ভারী যান চালাচ্ছেন। এসব ব্যাপারে যারা গাফিলতি করছেন তাদের গাফিলতি দেখার দায়িত্ব কি সরকারের নয়? আমাদের দেশে চালককে দায়ী করতে গিয়ে প্রকৃত দোষীরা বাইরে থাকছেন? এটা তাদের জন্য একটা পুরষ্কারও বটে। কিন্তু চালককে যতই শাস্তি দেওয়া হোক না কেন, যেহেতু তারা কারণ না তাই যারা এটার জন্য মূল দায়ী তাদের যদি শাস্তি দেওয়া যায় তাহলে এই প্রতিযোগিতার বা পচা সিস্টেমটার পরিবর্তন আসবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে যান্ত্রিক যানের সংখ্যা মাত্র দু’টি। অথচ সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গাড়ি ব্যবহার করেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। প্রতি ১ হাজার মার্কিন নাগরিকের মধ্যে গাড়ির সংখ্যা ৭৬৫টি। অথচ ওই দেশে বছরে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে মৃত্যুর হার মাত্র দু’জন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃত্যু


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ