Inqilab Logo

সোমবার, ২৭ মে ২০২৪, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

দাবানল নিয়ন্ত্রণে ৩ হাজার সেনা মোতায়েন

গণবিক্ষোভের মুখে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

অস্ট্রেলিয়ার বিস্তীর্ণ অংশ দাবানলে জ্বলছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত শুক্রবার থেকে পুরোদমে সেনা নামাল সরকার। এদিন মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮জনে। আর ৫০ কোটি পশু-পাখির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করেছে অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়েছে কোয়েলা, প্লাটিপাসের মতো প্রাণী। এমতাবস্থায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এবার তিন হাজার সেনা মোতায়েন করতে যাচ্ছে দেশটির সরকার যা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে এই প্রথম ঘটতে যাচ্ছে।

গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এ ঘোষণা দিয়েছেন। এদিকে, দাবানল বিধ্বস্ত নিউ সাউথ ওয়েলসের অবস্থা দেখতে গিয়ে স্থানীয়দের রোষের মুখে পড়তে হয় মরিসনকে। তিনি উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে ১৩ থেকে ১৬ জানুয়ারি ভারত সফর বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছেন।
তবে দাবানল ঠেকাতে সরকারের ভ‚মিকা নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন অস্ট্রেলিয়ার মানুষ। বৃহস্পতিবার নিউ সাউথ ওয়েলসের কোবারগোতে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে বিক্ষোভের মুখে পড়েন প্রধানমন্ত্রী মরিসন। এক দমকলকর্মীর সঙ্গে মরিসন হাত মেলাতে গেলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে সেই ভিডিও। আর এক জন মরিসনকে দেখে বলেন, ‘আপনি মূর্খ। এখান থেকে একটিও ভোট পাবেন না।’ বিক্ষোভের সুর শোনা গিয়েছে মরিসনের দল লেবার পার্টির অন্দরেও। শুক্রবার নিউ সাউথ ওয়েলসের পরিবহনমন্ত্রী অ্যান্ড্রু কন্সট্যান্স বলেছেন, ‘সত্যি বলতে এখানে স্থানীয়দের কাছে উপযুক্ত অভ্যর্থনাই পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’

নিউ সাউথ ওয়েলসের কোবার্গোয় গিয়েছিলেন মরিসন। সেখানে তার গাড়ি লক্ষ্য করে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেন সমবেত মানুষজন। অভিযোগ তোলেন, আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ব্যবহারই করেনি প্রশাসন। কোবার্গোর এক স্থানীয়ের কথায়, ‘প্রতিবার এখানে হয় বন্যা, নয়তো দাবানল, কিন্তু অনুদান কিছুই জোটে না। আমরা যদি সিডনি হতাম, এতক্ষণে অনুদানের বন্যা বয়ে যেত।’

এই ক্ষোভের মূল কারণ লাগামহীন দাবানল। গত এক সপ্তাহ ধরে ভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে নিউ সাউথ ওয়েলস। সেখানে ৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, পাশের রাজ্য ভিক্টোরিয়ারও একই অবস্থা। এই পরিস্থিতিতে এমন ক্ষোভ যে স্বাভাবিক, মানছেন মরিসন। অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রীর কথায়, ‘লোকের এই ক্ষোভে আমি মোটেই বিস্মিত নই। এই পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক, আর তাই আজ আপনাদের মাঝে এসেছি। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে আপনাদের দুঃখ দূর করতে। জানি, আরও কিছু ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। সেটা বুঝেই আপনাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার সব রকম চেষ্টা আমরা করছি।’

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, দুর্যোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করে সব গ্রাস করে নিচ্ছে। আগুন মোকাবেলায় দেশজুড়ে তিন হাজার সেনা মোতায়েন করা হবে। এছাড়া চারটি পানি-ছিটানো বিমানের ব্যবহার আরও জোড়দার করা হয়েছে। এজন্য ২০ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেনল্ডস বলেছেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনা মোতায়েনের ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে এ প্রথম ঘটেছে।
গত শুক্রবার ভিক্টোরিয়ার মাল্লাকুটা সৈকতে আটকে পড়া প্রায় ৪ হাজার বাসিন্দা ও পর্যটককে সরাতে দু’টি জাহাজ পাঠায় অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনী। ৯৬৩ জনকে নিয়ে ভিক্টোরিয়ার ওয়েস্টার্ন পোর্টের দিকে রওনা হয়েছে জাহাজ দু’টি। সেনা জানিয়েছে, শিশু, মহিলা ও অসুস্থদের আগে জাহাজে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া হবে। তবে পরিবারগুলিকে যাতে একসঙ্গে রাখা যায় সেই চেষ্টাও করবে তারা। ইস্ট জিপসল্যান্ডে এখনও ২৮ জনের খোঁজ না-মেলায় চিন্তায় প্রশাসন। আবহাওয়া দফতরের আশঙ্কা, শুক্রবারের রাতের মধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলস এবং ভিক্টোরিয়ার দাবানল মিশে গিয়ে ভয়াবহ রূপ নেবে।

এদিকে, মার্কিন মহাকাশ সংস্থার নাসার উপগ্রহে চিত্রে এবার ধরা পড়ল অস্ট্রেলিয়ার বিধ্বংসী দাবানলের ছবি। গত বছর নভেম্বর মাস থেকে জ্বলছে নিউ সাউথ ওয়েলস এবং ভিক্টোরিয়ার বনাঞ্চল। ক্রমেই তা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এর মাঝেই জানা গেল এই ভয়াবহ দাবানলের জেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বন্যপ্রাণীদেরও। ঝলসে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি পশু-পাখির।
সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিধ্বংসী দাবানলের জেরে পুড়ে গিয়েছে প্রায় কয়েক লাখ একর জমি। ভস্মীভ‚ত হয়েছে প্রায় দু’শোরও বেশি বাড়ি। কয়েকশো কোটি টাকার ক্ষতি। গত বুধবারই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কমপক্ষে ১৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। পরিস্থিতির জেরে নিউ সাউথ ওয়েলসে সপ্তাহব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করেছে প্রশাসন।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদদের গত বৃহস্পতিবার দেয়া তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর থেকে এযাবৎকাল প্রায় ৫০ কোটি স্তন্যপায়ী, পাখি ও সরীসৃপের মৃত্যু হয়েছে দাবানলে ঝলসে। যার সংখ্যা আগামী দিনে আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা।
সেই তথ্য থেকেই জানা গিয়েছে, দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে প্রায় হাজার হাজার কোয়ালা। প্রায় বিলুপ্তির তালিকায় থাকা এই প্রজাতির বেশিরভাগেরই বাস ছিল অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চল। যা বর্তমানে দাবানলে ছারখার হয়ে গিয়েছে। মূলত, নিউ সাউথ ওয়েলসের মধ্য-দক্ষিণ উপক‚লবর্তী অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় আট হাজার কোয়ালার মৃত্যু হয়েছে। যা এই অঞ্চলের কোয়ালা-সংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ।

পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের পরিবেশবিদ মার্ক গ্রাহামের কথায়, দাবানলের জেরে সৃষ্টি হওয়া তীব্র গরম এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়া আগুনে ঝলসে মারা গিয়েছে অসংখ্য প্রাণী। বিশাল এলাকা এখনও জ্বলছে। যাতে ভবিষ্যতে মৃত বন্যপ্রাণীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।

গত নভেম্বর থেকে জ্বলছে অস্ট্রেলিয়ার বিস্তৃর্ণ জঙ্গল, সবথেকে খারাপ অবস্থা নিউ সাউথ ওয়েলসের, ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে নিউজিল্যান্ড থেকেও, নাসার উপগ্রহ চিত্রেও ধরা পড়ল দাবানলের ভয়াবহতা। বনভ‚মি ও ঘর-বাড়ি সহ সবই গ্রাস করে নিচ্ছে এই আগুন। সিডনির কাছেও চলে এসেছে আগুনের লেলিহান শিখা। ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বর্ষবরণের রাতেই দাবানলের কারণে ঘরছাড়া হয়েছেন হাজার হাজার অস্ট্রেলিয়বাসী। উপক‚লীয় এলাকায় উদ্বাস্তুদের মতই দিন কাটাচ্ছেন তারা।

এই নিয়ে তৃতীয়বার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে হল প্রশাসনকে। গত ছয় সপ্তাহ ধরে অস্ট্রেলিয়ার দাবানলকে কাছ থেকে দেখেছেন সিজনির ফটোজার্নালিস্ট ম্যাট অ্যাবোট। নতুন বছরের শুরুতেই দাবালনের এই ভয়াবহতা আগে দেখা যায়নি বলে জানাচ্ছেন তিনি।
নাসার ২৬টি উপগ্রহ প্রায় ৯০০টি ছবি পাঠিয়েছে। গতবছর ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছিল অস্ট্রেলিয়া। তারপর এই দাবানল। ইতিমধ্যে নিউ সাউথ ওয়েলসের ১০ হাজার স্করায় মাইল এলাকা জ্বলছে বলে নাসার উপগ্রহচিত্রে ধরা পড়েছে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে সেই ধোঁয়া ছড়াচ্ছে নিউজিল্যান্ডের দিকেও।
অন্যদিকে, শুক্রবার আরও ২২ জন দক্ষ দমকলকর্মীকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্র্ডেন। আগেই ১৫০ উদ্ধারকর্মী পাঠিয়েছিলেন আর্র্ডেন। বিপদের দিনে অস্ট্রেলিয়ার পাশে সব রকম ভাবে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। সূত্র: বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অস্ট্রেলিয়া


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ