পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শিশুশিক্ষা শুধু শিশুদের জীবনের জন্যে নয় বরং দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্ব আমরা দেইও; হয়ত বেশিই দেই অনেক সময়। কিন্তু তা যে, হিতে বিপরীত হতে পারে তা অনেক সময় আমরা অনুধাবন করতে পারি না।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু নয় বরং শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলের সংস্কৃতি ও অভ্যাস কিন্তু ভিন্ন। শহরাঞ্চলের কথাই বলি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট্ট একটা কুঠরির মধ্যে বেড়ে উঠছে আমাদের আদরের সন্তানেরা। বাবা-মায়েদের নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকা, পাশের ফ্লাটের অধিবাসীদের সাথে যোগাযোগ না থাকা, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যাওয়া-আসা না থাকা ইত্যাদি তাদের মনস্তাত্বিক ভিত্তি ভিন্নভাবে গড়ে তুলছে। প্রকৃতির শিক্ষা ব্যতিরেকে পাঠ্য বইয়ের শিক্ষা, একটি কিংবা দুইটি বিল্ডিংয়ের ছোট্ট ছোট্ট কক্ষ নির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদেরকে এই বিশাল বিশ্বটাকে জীবনের স্তরে স্তরে ছোট করে তুলছে। বিশাল আকাশের চাঁদ, তারা, নক্ষত্রও এখন ভার্চুয়াল জগতে দেখছে। অধিকাংশ বাসার ছাদে উঠা মানা ভাড়াটিয়াদের। সন্ধার পরে নিরিবিলি রাস্তা কিংবা মাঠে বের হওয়া জীবনের নিরাপত্তার ঝুঁকি মুক্ত করতে পারেনি আমাদের সমাজ কিংবা রাষ্ট্র। বিনোদনের কেন্দ্রগুলোর যে পরিবেশ তাতে ভাল মানসিকতার কোনো অভিভাবক চাইবেন না এত ছোট বয়সেই তাদের সন্তানদের সাথে এসবের পরিচয় করিয়ে দিতে।
এতকিছুর পরে আছে পড়াশুনার চাপ। চাপ না বলে উচ্চচাপ বললেই ভাল হবে। বয়সের তুলনায় ক্লাসের বইয়ের বোঝাটা এতটাই বেশি যে তা বহন করার জন্যে একজন সাহায্যকারী লাগে। অধিকাংশ নামি-দামী প্রাইভেট স্কুলে ক্লাসক্রম সাজানো হয়েছে প্রি-প্লে, প্লে, নার্সারি, কেজি ওয়ান, কেজি টু, (স্টান্ডার্ড) ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর, ফাইভ...। মানে ক্লাস ওয়ানে উঠার আগে আরো চার চারটে অতিরিক্ত ক্লাস। এখানে শেষ হলেই ভালো হতো। কিন্তু এই ক্লাস কার্যক্রমগুলো আরো আশ্চর্যের! প্রি-প্লেতে আছে হরেক রকম পরীক্ষা; সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রোমাসিক, ষান্মাষিক, বার্ষিক ইত্যাদি। কিছু পরীক্ষা চলে সপ্তাহ পর সপ্তাহের ধরে। যে সময় সন্তানেরা তাদের ওয়াস রুমের কাজগুলো নিজে নিজে করতে পারে না সে সময় তাদের কতগুলো পরীক্ষা দিতে হয়! এক্সাম অর্থ কী না জানলেও কতরকম পরীক্ষা দিতে হয় তাদের। তাও হয়ত কঠিন হতো না। কিন্তু এসব পরীক্ষা নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা তাদের জীবনকে আরো কঠিন করে ফেলে। অভিভাবকদের প্রতিযোগিতা হয় অভিভাবকদের সাথে আর সেসবের খেসারাত দিতে হয় ছোট্ট সোনামণিদের। লক্ষ্য হলো গোল্ডেন এ প্লাস কিংবা ১০০ এর মধ্যে ১০০। অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, একটা নম্বরও যদি কম পায় তাহলে অভিভাবকরা তেড়ে আসে শিক্ষকদের দিকে। জবাবদিহি করতে হয়। ফলে, প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, শিক্ষকরাও বুদ্ধিমান হয়ে গেছেন। কোন ক্লাসে কেউ আশি নম্বরের কম পায় না। আমার ছেলের প্রতিষ্ঠানে বলেছি, রেজাল্ট গুরুত্বপূর্ণ না বরং গুরুত্বপূর্ণ ও কতটা কী শিখছে। শিক্ষার প্রতি ওর আগ্রহটা হচ্ছে কতটুকু? নিজের প্রতি কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সে? অথবা বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক, গুরুজনদের সাথে তার আচরণ কতটা শালীন? তাইতো টিফিন দেয়ার সময় তাকে বলে দেই, তোমার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে খাবে। মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসাও করি, কয়জন মিলে খেয়েছিলে? উত্তর যাই হোক, কাজটা আমি করেই যাচ্ছি। অথচ অনেক অভিভাবককে দেখেছি এটা বলে দিতে ‘টিফিন কারো সাথে শেয়ার করো না’ কিংবা ‘অন্যের দেয়া কিছুই খাবে না’। ও দিকে টিভিতে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়, ‘একা একা খেতে চাও, দরজা বন্ধ করে খাও।’ এইরকম আত্মকেন্দ্রিক শিশুরা বড় হয়ে অন্যের জন্যে, দেশের জন্যে কী করবে তা কি আমরা বুঝতে পারি না।
বুঝে আসে না, একজন শিক্ষার্থীকে কেন প্রত্যেকটি বিষয়ে আশির উপর নম্বর পেতে হবে? কেন ক্লাসে প্রথম হতে হবে বা প্রথম দিকে থাকতে হবে? কেন ক্লাসের পড়াশুনার পাশাপাশি গান, গজল, নাচ, কবিতা আবৃত্তি, অংকন সবকিছুতেই বেস্ট হতে হবে? প্রত্যেকটি শিশুকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, এরকম প্রত্যাশা খুব বেশি অনুচিত না কারণ এসব পেশার দরকার আছে। কিন্তু এসব পেশার চিন্তা যদি অর্থ আয়ের কারণ হয়ে থাকে তাহলে প্রকারান্তে তাদেরকে অর্থলোভী কিংবা জীবনের লক্ষ্য হিসেবে অর্থকেই নির্ধারণ করে দিচ্ছি আমরা।
এখন অন্য দুইটি কথায় আসি। প্রথমতঃ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার যে ছেলে হবে, তাকে কেন ইতিহাস, ভুগোল, সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদি সকল বিষয়েই সর্বোচ্চ নম্বর পেতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাটাও বা এমন কেন? ১০/১২ টা বিষয়ের যে কোনো একটা বিষয়ে খারাপ করলেই কেন তাকে অকৃতকার্য হিসেবে সাব্যস্ত করতে হবে? জীবনে সব বিষয়ে একটা শিশুর ভাল কেন করতে হবে? ভাল লাগার কোন বিশেষত্ব কি থাকবে না? দ্বিতীয়তঃ অভিভাবক, শিক্ষকরা কেন এটা খেয়াল করেন না যে, তাদের ক্লাসের ফাস্টবয় বা প্রথম দিকে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের বর্তমান অবস্থা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জীবনে সফলতার জন্যে ক্লাসের প্রথম কিংবা প্রথম দিকে থাকাটার আন্তঃসম্পর্ক খুবই কম নয় কি?
এ সবকিছুই শিশু মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাদের ভাললাগাগুলো কিন্তু আর প্রকাশ করার সুযোগটুকুও পাচ্ছে না। না বাড়িতে; না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে, অন্যের অনিচ্ছাকে পুষে বড় করার মানসিকতা গড়ে তুলছে তারা। এসব থেকে উত্তরণের কতিপয় কার্যকরী পদক্ষেপ হতে পারেঃ
১. স্কুলে তারা পড়াশুনার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিলেও বাসাতে যেন সে নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে পারে তা নিশ্চিত করা।
২. ক্লাসের পজিশন কিংবা সর্বোচ্চ রেজাল্টের পিছনে যেন না ছুটে বরং তারা যেন শিক্ষাটাকে উপভোগ্য মনে করে তা নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রাথমিকের ক্লাসগুলোতে নম্বরের পরিবর্তে উত্তীর্ণ-অনুত্তীর্ণকে শুধু রাখা যেতে পারে। সেখানে উত্তির্ণ সকলেই সমগোত্রিয় হিসেবে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক নিয়ে বেড়ে উঠবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
৩. শিক্ষাটা ফলাফলমুখি আর ফলাফল জীবনের সফলতার মাপকাঠি না করে শিক্ষাকে মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার লক্ষ্যে করতে হবে।
৪. শিক্ষা ব্যবস্থাটা ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবী। সংক্ষেপে, এমন কি করা যায় না যে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পাশ করতে হবে বটে তবে উচ্চশিক্ষায় স্পেশালাইজড করার জন্যে সেইগুলোতে অবশ্যই নূন্যতম একটা নম্বর পেতে হবে। হতে পারে তা ৮০ নম্বরের উপরে। তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সবগুলোতেই ৮০ নম্বর পেতে হবে নয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে পারবে না, এটা সত্যিই অনুচিত।
জীবনটাকে প্রতিযোগিতায় নিক্ষেপ না করে নিজের জন্যে, অন্যের জন্যে উপভোগ্য ও কল্যাণকামী করে তুলতে হবে। সে দায়িত্ব আমাদের অভিভাকদের, সমাজের আর প্রতিষ্ঠানের। রাষ্ট্র সেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে বিধান করে। শিশুরা বেড়ে উঠুক ভবিষ্যতের কল্যাণের জন্যে; যা দুনিয়া ও আখেরাতেও সফলতার উপায় হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।