পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আদতে হিন্দু কোনো ধর্মের নাম নয়। প্রাচীনকালে ভারতের সনাতন ধর্মালবলম্বিদের যারা সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসি, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে সিন্ধি বা হিন্দি বলা হতো, সেই সিন্ধী থেকে হিন্দু শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। এ কারনেই ঔপনিবেশোত্তর ভারতের সংবিধানে ভারতীয় সনাতন ধর্মাবলম্বিদের পাশাপাশি শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদেরও হিন্দু বলে নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের আগে শত শত বছর ধরে ভারতের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মুসলমানরা হিন্দু ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আধুনিক ভারতের কবি-সাহিত্যিক, সিদ্ধপুরুষ ও মহাত্মা গান্ধীর মত রাজনৈতিক নেতা নতুন ভারতে হিন্দু-মুসলমান মেলবন্ধন ও সাম্যের কথা বলেছেন। তাদের সেই মহৎ অভিপ্রায়ের সাথে ভারতের কোটি কোটি মুসলমানের ভাবাবেগ জড়িত ছিল বলেই ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় ইউনিয়ন হয়ে উঠে কোনো একক রাষ্ট্রে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠির আবাসভ’মি। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ বা আঞ্চলিক অবস্থানের মানদন্ডে বৈষম্য করার সুযোগ রহিত করা হয়েছে। সুলতানি আমল থেকে শেষ মুঘল স¤্রাট পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বছরের ইতিহাসেও ভারতের নাগরিকদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো রকম বৈষম্য বা বিভাজনের নজির নেই। ভারতের উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে জাতিগত বৈষম্য এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মূলত ইংরেজ আমলের শেষদিকের সৃষ্টি। তাদের এই ডিভাইড এÐ রুল পলিসি ভারতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, দাঙ্গা এবং পারস্পরিক অনাস্থা বাড়িয়ে তোলার কারণেই ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। তবে মহাত্মা গান্ধী, জওহেরলাল নেহেরু, মাওলানা আজাদ, সীমান্তগান্ধী নামে পরিচিত আব্দুল গাফফার খানের মত সর্বভারতীয় নেতারা অহিংসা ও ধর্মনিরপেক্ষতার শ্লোগান না তুললে কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের মত মুসলমান জনসংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোর ভারতভুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তাদের কারণেই ভারতের কোটি কোটি মুসলমান শত শত বছরের উত্তরাধিকারের আবাসভ’মি ও সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের ঐতিহ্য পরিত্যাগ করে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে পাড়ি জমায়নি। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিতে মুসলমানরা অসামান্য ভ’মিকা পালন করেছে। ভারতের স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী শহীদদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে কম নয়। একইভাবে ঐপনিবেশিক আমলে মহাযুদ্ধের সময় ভারতের পক্ষে আত্মদানকারী মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে বেশি। ইন্ডিয়া গেটে খোদাই করা ৯৫৩০০ নামের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা ৬১ হাজারের বেশি বলে জানা যায়। সেই ভারতে এখন হিন্দুত্বাদী বিজেপি মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করার ষড়যন্ত্র করছে। বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ও স্বায়ত্ত¡¡শাসন রহিত করার পর গত আগস্ট মাস থেকে ভ’-স্বর্গ কাশ্মীরকে বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন একটি অন্ধপুরিতে পরিনত করা হয়েছে। সাড়ে তিন মাসের মাথায় ভারতীয় লোকসভা ও রাজস্যভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে সে দেশের মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের চুড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, ভারতের কোটি কোটি মুসলমানকে নাগরিকত্ব থেকে খারিজ করে দিয়ে তাদের রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিনত করা। আসামে ভাষাভিত্তিক নাগরিকত্বপুঞ্জি করতে গিয়ে সেথানকার ১৯ লাখ বাংলা ভাষাভাষীকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার পর দেখা গেল ১৯ লাখের মধ্যে ১৪ লাখই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। উপমহাদেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ রাজ্যেই এমন বাস্তবতা ধরা পড়বে। অধিকাংশ হিন্দুর মধ্যে একতৃতীয়ংশ মুসলমানও নাগরিকত্ব আইনের মারপ্যাঁচে নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের লক্ষ্যই হচ্ছে অবশিষ্ট দুই তৃতীয়াংশ হিন্দুকে নাগরিকত্বের সংকট থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করা।
আসামের এনআরসি ছিল একটি টেস্ট কেস। কথিত এনআরসি’র কারণে সেখানে যে সামাজিক-রাজনৈতিক জঠিলতা ও অস্থিতিশীলতা তৈরী হয়েছে, কোনো বিবেকবান, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতার পক্ষে দেশে এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরীর আশঙ্কা ডেকে আনা সম্ভব নয়। অতীতে আর কখনো ভারতে এ ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এমনকি নাইন-ইলেভেন হামলার পর ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও মুসলমান নাগরিকদের এমন নির্বতনমূলক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়নি। তবে মিয়ানমারের রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার যে নজির সৃষ্টি করেছে ভারতের বিজেপি সরকার যেন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সে পদাঙ্ক অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। লোকসভায় নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপন করে বিজেপি নেতা ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কল্পিত অভিযোগ তুলে নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের যৌক্তিকতা তুৃলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের অভিযোগ তোলার সপক্ষে তথ্য তুলে দিতে বাংলাদেশের একশ্রেণীর সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত অ্যাক্টিভিস্ট নিরন্তর কাজ করছেন। গত জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের নিয়ে হোয়াইট হাউজে অনুষ্ঠিত একটি আন্তজার্তিক সম্মেলনে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ- খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু নাগরিক নিখোঁজ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। সব সময়ই রাজনৈতিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে বলে তিনি ট্রাম্পের কাছে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও সাহায্যের আবেদন করেন। বিদেশের মাটিতে গিয়ে এ ধরণের ডাহা মিথ্যা অভিযোগ দেশের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে গণ্য করেছেন দেশের রাজনৈতিক মহল। এমনকি হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারাও প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে মিথ্যাচার বলে দাবী করেছেন। এমনকি প্রিয়া সাহাকে তারা আমেরিকায় পাঠাননি এবং প্রিয়া সাহা কিভাবে আমেরিকা গেল তার তথ্যও জানেন না বলে তারা দাবী করেছেন। তবে প্রিয়া সাহার মিথ্যা বক্তব্যের বিরুদ্ধে যখন বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায় ও সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল, তখন ভারতের বিজেপির পক্ষ থেকে প্রিয়া স্হাার প্রতি সমর্থন এবং পাশে থাকার প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত হতে দেখা যায়। হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান নেতারা প্রিয়া সাহার অসংলগ্ন বক্তব্যের দায় নেননি, তারা তাকে সেখানে পাঠাননি, কিভাবে সেখানে গেছেন সেটাও তারা জানেন না। তবে প্রিয়া সাহার বক্তব্যে তোলপাড় অবস্থায় ভারতের বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষ থেকে প্রিয়া সাহার প্রতি সমথর্ন প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলতে এবং বাংলাদেশকে চাপে রেখে ফায়দা হাসিল করতে ভারতের অমিত শাহ, রাজনাথ সিংদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতেই কোনো প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহল প্রিয়া সাহাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিল কি না সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। আসামের এনআরসি, লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রস্তাব দিতে গিয়ে অমিত শাহ্র বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্যের প্রেক্ষাপট প্রিয়া সাহা ও তার সহযোগিরাই করে দিয়েছে। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীরা যখন তখন রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলায় গ্রেফতার হলেও প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা বা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কথা জানা যায়নি। প্রিয়া সাহা বা ভারতীয় মন্ত্রীদের বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্যের পর চেতনার ধ্বজাধারিদের নিরবতায় দেশবাসী ভিন্ন বার্তা পাচ্ছে।
লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে আলোচনার সময় প্রতিবাদ হিসেবে অল ইন্ডিয়া-মজলিশ-এ-ইত্তেহাদুল-মুসলিমিন(এমআইএম) নেতা আসাদ উদ্দিন ওয়াইসি বিলের কাগজ ছিড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিজেপি নেতা অমিত শাহকে জার্মানীর হিটলার এবং ইসরাইলের বেন গুরিয়নের সাথে তুলনা করে নতুন আইনকে মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করার ষড়যন্ত্র বলে দাবী করেন। এই বিল ভারতকে আরেকবার ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। বিজেপি সরকারের কাশ্মীর নীতি নিয়ে ভারতের মূল ধারার রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কার্যত নিরব সমর্থন জানালেও তাদের সেই নিরবতার কারণেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক, সংবিধান বিরোধি এমন একটি আইন পাস করার দু:সাহস পেল বিজেপি। আসামের এনআরসি এবং কাশ্মিরের ৩৭০ ধারা ও স্বায়ত্বশাসন বিলোপের সময় ভারতীয় নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর নিরবতাকে সমর্থন মনে করেই তারা সারা ভারতে এনআরসি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা নিয়েছে বিজেপি। সেই পরিকল্পনায় হিন্দুসহ অন্য ধর্মাবলম্বিদের বাঁচিয়ে শুধু মুসলমানদের টার্গেট করতেই একটি সাম্প্রদায়িক বৈষম্য নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তবে এবার হয়তো শেষ রক্ষা হচ্ছে না। এরই মধ্যে ভারতের মুসলমানরা ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গসহ ৬টি রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীরা একাট্টা হয়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। হিন্দুত্ববাদী আরএসএস বিজেপি ও বিশ্বহিন্দু পরিষদের সংঘবদ্ধ শক্তি ভারতের সাধারণ হিন্দুদের মগজ ধোলাই করে মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির নির্মাণের চেতনায় উজ্জীবিত করার সাম্প্রদায়িক উস্কানী উদারপন্থী রাজনৈতিক শক্তি ও নাগরিক সমাজ কিভাবে মোকাবেলা করবে তাই এখন দেখার বিষয়। অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে টিকিয়ে রাখতে হলে বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা বাস্তবায়ন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। গত ৯ ডিসেম্বর লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক কমিশন(ইউএসসিআইআরএফ) বিলটিকে মুসলিম বিদ্বেষী, ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িত করেছে। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক নিবর্তনমূলক বিল উত্থাপনের জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি অমিত শাহ সহ ঊর্ধ্বতন বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশও করেছে ইউএসসিআইআরএফ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ এই বিলের আইনগত অসঙ্গতি, সাম্প্রদায়িক বৈষম্য সম্পর্কে ভারতকে সতর্ক করেছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক বার্তা দিয়েছে ওয়াশিংটন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা জেনোসাইড ওয়াচ। জোনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা ড. গ্রেগরি স্ট্যানটন অধিকৃত কাশ্মীর ও আসামে মুসলমানদের উপর ভারত গণহত্যা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বহীন করতে চুড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৮২ সালে ইউনিয়ন সিটিজেনশিপ অ্যাক্টে মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতিসত্তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তি রহিত করার মধ্য দিয়ে আজকের রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রেক্ষাপট তৈরী করা হয়েছিল। রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও এথনিক ক্লিনজিংয়ের বিরুদ্ধে বিশ্বসম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ালেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইয়াঙ্গুনে গিয়ে মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। আসামের এনআরসি এবং কাশ্মীরে বিজেপির পদক্ষেপগুলো দেখে তারা ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনে ইসরাইল মডেল এবং রাখাইনে রোহিঙ্গা মডেল অনসুরণ করতে চলেছে। বর্তমানে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের অবস্থা ফিলিস্তিনের অধিকৃত এলাকা থেকেও অনেক খারাপ। টেলিফোন, ইন্টারনেটসহ মূলধারার সব গণমাধ্যমের সম্প্রচার বন্ধ রাখার মাধ্যমে পুরো এলাকাটি বাকি দুনিয়া থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার কিশোর তরুনের ফোর্স ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সসহ সেখানে টার্গেট কিলিং সহ পরিকল্পিত গণহত্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে শান্তি বজায় রাখার দাবী করা হলেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ সব ধরনের নাগরিক অধিকার রহিত করার কারণে এ ধরনের আশঙ্কাই বিশ্বের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিষয়ক সংস্থা জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন কংগ্রেস সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে দেয়া বক্তৃতায় মোদি সরকার গণহত্যা চালানোর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে বলে দাবী করেন।
জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্ট্যানটন যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তা যদি সত্য হয়, পুরো উপমহাদেশের তা এক চরম দু:সংবাদ। মিয়ানমারের ইউনিয়ন সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গা নাগরিকদের উপর যে এথনিক ক্লিনজিং ও গণহত্যার ধারাবাহিক তৎপরতা শুরু হয়েছিল এনআরসি তালিকা চুড়ান্ত হওয়ার পর আসামে সেই একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এনআরসি নিয়ে ব্যাপক গণবিক্ষোভ, আভ্যন্তরীণ-আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং আদালতে যাওয়ার সুযোগ চলমান অবস্থায় সেখানে এখনই ধরপাকড় শুরু হয়ে গেছে। এমনও কিছু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, শত বছর ধরে আসামে বাস করার পরও মুসলমান হওয়ার কারণে অনেকে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন এবং তাদেরকে ধরে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। নাগরিকপঞ্জি থেকে অনেক গণমান্য হিন্দু ব্যক্তিত্ব ও পরিবারের পাশাপাশি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদের পরিবারের বেশকিছু সদস্যের নামও বাদ পড়েছে। নতুন সিএবি আইনে হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা হলেও বাদ পড়া মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন হিসেবে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কারগিল যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে প্রায় ৩০ বছর চাকরি করার পর অবসরে যাওয়া সাবেক সেনা সদস্য সানা উল্লাহকে গ্রেফতার করে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়ার খবর সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এনআরসিতে বাদ পড়া লাখ লাখ হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সিএবি আইনে হিন্দুদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করায় এখন তার চুপ হয়ে যাবে এবং সিএবি বিলের বাস্তবায়নে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা বিজেপি সরকারকে পোহাতে হবে না। সম্ভবত এমন ধারনাই করেছিল বিজেপি সরকার। তবে গত কয়েকদিনে ভারতে রাজনৈতিক বাস্তবতা পাল্টে যেতে দেখা যাচ্ছে। সংশোধিত নাগরিক্ত আইন মুসলমানরা মেনে নিচ্ছে না। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আগে থেকেই এ ধরনের আইনের বিরোধিতা করে আসছেন। তার পাশাপাশি গত কয়েকদিনে ৬টি রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীরা সিএবি আইনের বিরুদ্ধে একাত্মতা প্রকাশ করে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সিএবি আইনের প্রতিবাদে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই,হায়দারাবাদ, লখনৌ ও পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ আরো অনেক শহরে মঙ্গলবার ৬ষ্ঠ দিনের মত লাখ লাখ মানুষের প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। কলকাতায় মমতা ব্যানার্জির ডাকে লাখ লাখ প্রতিবাদী মানুষের ঢল নেমেছিল সোমবার। এ প্রতিবাদী মানুষের ঢেউ বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকে নস্যাৎ করে দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মুসলিম বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্যমূলক বিল পাস করার পর মানুষ যখন প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসতে শুরু করেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাদেরকে শান্ত থাকতে বলছেন! সিএবি আইনে সরাসরি বাংলাদেশকে আক্রান্ত করা হলেও বাংলাদেশ সরকার এখনো বিষ্ময়করভাবে নিরব। যেখানে কলকাতা, দিল্লী, হায়দারাবাদ, লখনৌ প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে, তখন বাংলাদেশের নিরবতার কোনো তুলনা হয়না। সিএবি বিল লোকসভায় উপস্থাপন করতে গিয়ে অমিত শাহ বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী অমিত শাহর বক্তব্য সত্য নয় বলে মন্তব্য করলেও সিএবি আইন ও অমিত শাহ’র বক্তব্যের বিরুদ্ধে ও প্রতিবাদে যতটা জোরালো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসার কথা তা এখনো আসেনি। আগস্টে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা হরণ করার পর বাংলাদেশ বলেছিল, এটা ভারতের আভ্যন্তরীন ব্যাপার। আবার পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধাবস্থা শুরু হলে একমাত্র বাংলাদেশই ভারতকে আগাম সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল। বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার ও দাবী তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলেও গত ১০ বছরে বাংলাদেশের কাছে ভারতের প্রত্যাশিত সবকিছুই উজাড় করে দিয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় আসীন হওয়ার ও দাবী করা হচ্ছে দুই দেশের তরফ থেকেই। তবে সীমান্তে বাংলাদেশীদের উপর বিএসএফ’র গুলিবর্ষণ একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। এখন যোগ হয়েছে এনআরসিতে বাদ পড়াদের পুশ ইন। গণহত্যার মুখে পড়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ শরণার্থী আশ্রয়দানে বিশ্বে এক নম্বরে স্থান পাচ্ছে। এখন এনআরসি, সিএবি’র কারণে বাদ পড়া লাখ লাখ ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলমানকে বাংলাদেশে পুশ ইন করার আয়োজন চলছে। নতুন সিএবি প্রশ্নে ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ সভা সমাবেশের রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা ভুলতে বসেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তজার্তিক আদালতে মামলা লড়ছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। বাংলাদেশ সেখানে অনেকটা নিরব দর্শকের ভ’মিকায়। এ অবস্থায় অনেকেরই জার্মানীর নাৎসিদের বিরুদ্ধে মার্টিন নিম্যুলারের লেখা সেই কবিতার কথা মনে হতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথমে তারা যখন কমিউনিস্টদের ধরতে আসে, আমি তখন কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না,
অত:পর তারা সোশ্যালিস্ট..
তারপর তারা ইউনিয়নিস্ট.. ইহুদি দের ধরতে আসে, আমি তখনো কথা বলিনি,
কারণ আমি ইউনিয়নিস্ট অথবা ইহুদি ছিলাম না।
তারা যখন আমাকে ধরতে আসে তখন আমার পক্ষে কথা বলার মত কেউ ছিল না।’
রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে, কাশ্মীরিদের অধিকারের প্রশ্নে এবং ভারতীয় মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশের নিস্ক্রিয়-নিরব থাকার কোনো সুযোগ নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।