Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মধুসূদনের চতুর্দশপদী কবিতা

প্রকাশের সময় : ২৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. গুলশান আরা
বাংলা কবিতাকে যিনি মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিলেন তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সে কারণেই তাঁকে আধুনিক বাংলা কবিতার জনক বলা হয়। তিনটি প্রায় নতুন কাব্যপ্রকরণ মাইকেল বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেছিলেন- মহাকাব্য, মনোনাট্য এবং সনেট। মধুসূদনের সাহিত্য চর্চার আটশো বছর আগে বাংলা সাহিত্যে কাহিনী কাব্য থাকলেও তা সুপ্রথিত, ব্যক্তি ও কাল চিহ্নিত বহুমাত্রিক মহাকাব্য ছিল না। মধুসূদনই প্রথম সার্থক মহাকাব্য উপহার দেন বাংলা সাহিত্যমোদীদের। আরো উপহার দেন চতুর্দশপদী কবিতার ঘনসংহতি। অন্য দুটি প্রকরণ যেমন নিঃসঙ্ঘ দ্বীপ হয়ে সাহিত্য সাগরে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁর প্রবর্তিত সনেট কিন্তু তা হয়নি বরং প্রবাহমান নদীর মত বহমান। একশো তেঁতাল্লিশ বছর পরও সচল রয়েছে মধু প্রবর্তিত সনেটের পরিচর্চা।
মধুসূদন ব্যক্তি জীবনে শক্তির উল্লাস যতই অনুভব করুন না কেন, এর সাথে শক্তির সীমিত রূপও উপলদ্ধি করেছেন। প্রচ- শক্তি বলে, সমস্ত জীবনব্যাপী তিনি আত্মপ্রতিষ্ঠার যে প্রাণপণ প্রয়াস করেছেন আদৌ সার্থক হয়নি। এর বিরুদ্ধে শক্তির কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে।
মধুসূদন হয়তো ভেবেছিলেন তার পরিবারের সবাই ওকালতি পেশার সঙ্গে জড়িত তিনি তাদের সবাইকে অতিক্রম করে যাবার আশায় প্রায় মধ্যবয়সে ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ড চলে যান। কিন্তু সেখানে তিনি তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করাই তার পক্ষে দুরূহ হয়ে উঠলো। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি চলে গেলেন লন্ডন থেকে ফ্রান্সে। ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে কঠোর দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেই তাকে জীবন নির্বাহ করতে হলো। সেই সময় ইতালীয় কবি পেত্রার্ক এর অনুকরণে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা রচনা আরম্ভ করেন। ভাবতে অবাক লাগে এমন একটি বিরূপ অবস্থানে থেকেও কি করে সনেটের মত শিল্প সংযত কবিতা রচনা করেছিলেন। জীবেন্দ্র সিংহের মতে ‘মধুসূদনের এক গভীরতম উপলব্ধির দিনে চতুর্দশপদী কবিতাবলী’র সৃষ্টি। বিশ্ব সাহিত্যের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় সনেট হলো সেই কবিতা যা কবির হৃদয় উদঘাটনের একটি স্বীকৃত মাধ্যম। জীবনে যে ঢেউ উঠে, মনে যে সুর জাগে সনেটের সীমিত পরিসরে তার নিটোল রূপ রচনা করেন কবি।
‘মেঘনাদ বধ কাব্যে’র মহাকবি মধুসূদন ফ্রান্সের ভরসেল্স নগরীতে থাকার সময়ে মর্মান্তিক দুঃখের আঘাতে উপলদ্ধি করেছিলেন যে, অন্তরের দৃঢ়মূল প্রত্যয় পায়ের তলার শক্ত মাটির মতোই যা অপরিহার্য তা তিনি অর্জন করতে পারেননি। যৌবনা বেগে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন অকারণ, অবারণ উল্লাস পেতে চেয়েছেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন রঙিন জীবনের প্রজাপতি পাখা শুধুই ক্লান্তিতে ভরে উঠেছে, তাকে ঘাটের বদলে আঘাটায় পৌঁছে দিয়েছে। তাই সেদিন আপন জন্মভূমিকে যেন মধুসূদন নতুন করে দেখলেন, চিনলেন ও জানলেন। তার দৃষ্টি ফিরলো দেশের দিকে দেশের মৃণ¥য় সত্তা আর চিন্ময় ঐতিহ্যের দিকে। এই নতুন করে আত্মউপলদ্ধির পরিচয়, এই স্বদেশ আবিষ্কারের পদচিহ্ন ছাড়িয়ে আছে চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে। কবির মন যে মাতৃভূমি থেকে একদা ছিন্নমূল হয়েছিল, তাকে তিনি শুধু শিল্পের ভিতরে নয়, জীবনের ভেতরে প্রত্যয় রূপে স্বীকার করে নিলেন। তাই কাব্যটিকে আত্মজীবনীমূলক বলা যেতে পারে। পাশ্চাত্য শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এত মাস পরে মধুসূদনকে দেশ চিনিয়েছে, মাতৃভূমিকে ভালবাসতে শিখিয়েছে নতুন করে।
স্বীয় অন্তর অনুভবকে নতুন প্রত্যয়ে প্রকাশের জন্য মধুসূদন বেছে নিলেন সনেটের মত শিল্প সংযত কবিতা। ব্যক্তিগত জীবনের নানা উত্থান-পতন, ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে সনেটের চেয়ে অন্য কোন মহত্ত্বর শিল্প কৌশলে যাওয়া তখন মধুসূদনের পক্ষে প্রায় দুরূহ ব্যাপার ছিল। তার উপরে তিনি ব্যারিস্টারিতে অধ্যয়নরত ছিলেন। নিজের এই অক্ষমতার কথা কিছুটা হলেও স্বীকার করেছেন ‘সমাপ্তি’ কবিতায়। ‘সমাপ্তি’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
বিসর্জিব আজি, মাগো বিস্মৃতির জলে
(হৃদয়-মন্ডপ, হায়, অন্ধকার করি)
ও প্রতিমা। নিবাইল দেখ হোমানলে,
মনঃকুম্ভে অশ্রুধারা মনোদুঃখে ঝরি!
----    ---    ----   ---   ---  ----
                         ডুবিল সে তরী,
কাব্য নদে, খেলাইনু যাহে পদে বলে
অল্পদিন!
এতে বুঝা যায় মধুসূদন নিজের ক্ষয়িষ্ণু সৃষ্টি শক্তি ও আস্তায়মান প্রতিভা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠছিলেন। সে কারণেই তিনি বলছেন নিভে গেছে হোমানল, এ হোমানল মূলত তার সৃষ্টির হোমানল। একদা যৌবনের  অমিত তেজে অধম্য উল্লাসে অনায়াসে বিচরণ করেছেন কাব্য অঙ্গনে আজ নিয়তির অদৃশ্য আঙ্গুলি হেলনে তিনি যেন অস্তমিত সূর্য তার সৃষ্টির আবেগ স্তিমিত মনঃকু-ে অশ্রুধারা মনোদুঃখে ঝরি। এই মনোদুঃখ তাকে তুষের অনলের মত পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছে। এর পরে তিনি আর কোন পূর্ণাঙ্গ কাব্য রচনা করেননি অথবা করতে পারেননি।
শিল্পকর্ম হিসেবে তাই চতুর্দশপদী কবিতাবলীও সর্বোচ্চ প্রশংসার শীর্ষে উঠতে পারেনি ঐ দুর্বলতার কারণেই। কবির ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নিশ্চয়ই মূল্যবান কিন্তু তার চেয়েও মূল্যবান সৃষ্টি সাহিত্যিক মূল্য। সাহিত্যিক মূল্যই সাহিত্য সৃষ্টির চরম মূল্য। কবিত্ব;  কল্পনা রসানুরাগ থাকা সত্ত্বে তার সব সনেট উপভোগ্য হয়নি। সনেটের যে  আঙ্গিক তাতে মধুসূদন অত্যন্ত সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি প্রথম আট পঙ্ক্তিতে দুটোর বেশি মিল দেখাননি যেখানে দেখিয়েছেন (কাশীরামদাস) সেখানে একটু ভিন্নতর পন্থা অবলম্বন প্রবল হয়ে উঠেছে। মদুসূদনের বড় কৃতিত্ব তিনি সনেটের ছাঁচটি ধরতে পেরেছিলেন। চৌদ্দ চরণের আঁটসাঁট শক্ত-সমর্থ কায়ারূপের মধ্যে, নিটোল মুক্তরূপের মধ্যে গভীরভাবের প্রাণটি তুলে ধরার কৌশল আয়ত্ব করতে পেরেছিলেন। যেখানে ভাব তার সহায়, সেখানে (বিজয়াদশমী, সমাপ্তে, কপোতাক্ষনদ, বঙ্গভাষা, সীতাদেবী, ইত্যাদির সনেট) তিনি যথার্থই সার্থক। যেমন
“যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারা দলে!
গেলে তুমি, দয়াময়ী, এ পরাণ যাবে!
উদিল নির্দ্দয় রবি উদয়-অটলে,
নয়নের মনি মোর নয়ন হারাবে!
                         (বিজয়া দশমী)
অনুক্ষণ মনে মোর পড়ে তব কথা,
বৈদেহি! কখন দেখি, মুদিত নয়নে,
একাকিনী তুমি, সতি, অশোক-কাননে
চারিদিকে চেড়ীবৃন্দ, চন্দ্রকলা যথা
আচ্ছন্ন মেঘের মাঝে!
                             (সীতা দেবী)
হে বঙ্গ, ভা-ারে তব বিবিধ রতন,
তা সবে (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
                                (বঙ্গভাষা)
তবুও চতুর্দশপদী কবিতাবলী মধুসূদনের কবি প্রতিভার সার্থকতম সৃষ্টি নয়। পেত্রাক, মিল্টন, সেক্সপিয়ার এর সনেটে যে বিষয় গরিমা আছে, যে ভাব মহিমা আছে, মধুসূদনের অনেক চতুর্দশপদীতেই তা অনুপস্থিত।
শোক-দুঃখের তাপে মধুসূদনের মনটা ঠিক সনেট রচনার অনুকূল ছিল না তাই অনেক সনেট শুধু গদ্যাত্মক, কাব্যের ভঙ্গি আছে কিন্তু প্রাণ নেই মড়ার মুখে আল্পনা আঁকার মত কৃত্রিম।
আবার অনেক সনেট দাঁড়িয়ে আছে একটু আলঙ্কারিক মারপ্যাঁচের উপর। কাব্যে অলংকার ভালো কিন্তু তার উপর পুরোপুরি নির্ভর করা অনেক ক্ষেত্রেই শোভন হয় না।
রামগতি ন্যায় রতœ এ গ্রন্থখানি সম্পর্কে লিখেছিলেন কবি যৎকালে ইউরোপে গমন করিয়া ফরাসীদেশস্থ ভরসেলস্ নগরে অবস্থান করেন, তৎকালে এই কাব্য রচিত হয়। কবির স্বহস্ত লিখিত ইহার উপক্রমভাগ লিথোগ্রাফে মুদ্রিত হইয়াছে। তদদ্বারা তাঁহার হস্তলিপি দর্শনেচ্ছুগণ পরিতৃপ্ত হইবেন। মিত্রাক্ষর ও অমিত্রাক্ষর উভয়বিধ ছন্দের চতুর্দশ পঙ্ক্তিতে একশতটি পৃথক পৃথক বিষয় ইহাতে বর্ণিত হইয়াছে।
চতুর্দশপদী কবিতাবলী প্রকাশিত হয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট। একই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবাসী আশ্বস্ত হলেন, এত দিনে মধু কবি সত্যিকার অর্থে বঙ্গভাষা এবং বঙ্গ দেশের মর্যাদা উপলদ্ধি করেছেন, যে ভাষা যে দেশের চেয়ে তার কাছে আরাধ্য ছিল ইউরোপ অথচ সেই ইউরোপে এসেই তার ভাল লাগলো স্বদেশ, স্বদেশের প্রকৃতি, স্বদেশের মানুষ। চতুর্দশপদী কবিতা কবিকে আরেক মাত্রায় উন্নিত করলো গৌড়জনের কাছে। তবে যে আর্তি ছিল, আকুতি ছিল দেশ মাতার কাছে-রেখো মা, দাসেরে মনে তা যেন সত্যিকার অর্থেই গৃহীত হলো ধন্য করলো বাংলার শ্রেষ্ঠ মহাকবি চতুর্দশপদীর লেখক কবি মধুসূদনকে।



 

Show all comments
  • Mokbul firdous ২৬ অক্টোবর, ২০১৯, ৩:৫৮ পিএম says : 0
    Darun
    Total Reply(0) Reply
  • Gouranga Roy ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১০:০১ এএম says : 0
    খুব সুন্দর
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মধুসূদনের চতুর্দশপদী কবিতা
আরও পড়ুন