Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ২৭ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

উন্নয়নের জন্য শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখাটা জরুরি আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের নিজদেশে টেকসই প্রত্যাবাসনে বিশ^ সম্প্রদায়কে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন। গত ১১ নভেম্বর ২০১৯ রাজধানীর একটি হোটেলে ঢাকা গ্লোবাল ডায়ালগ ২০১৯ এর একটি অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর আহবান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী।

দুই বছর আগে যখন মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা সর্বস্বহারিয়ে শুধু জীবন নিয়ে টেকনাফের নাফ নদ পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল, তখন নির্যাতিত নিপীড়িত এই মানুষগুলোকে দেখে সবার হৃদয় কেঁদেছিল। কত পাষাণ, কত হিং¯্র, জঘন্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধে নিমগ্ন ছিল মিয়ানমার সরকার। বিশ^সম্প্রদায়, বিভিন্ন প্রভাবশালী এনজিও, আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো শুধু ভয়াবহতার চিত্র, বিভৎসতা দেখেই গেছে, কিন্তু তার প্রতিরোধ, আশ্রয় ও প্রত্যাবাসনের কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এগিয়ে এসেছিল কেবল বাংলাদেশ, এসেছিলেন বাংলাদেেশর প্রধানমন্ত্রী। এই নিষ্পেষিত অসহায় মানুষকে আশ্রয়ের স্থান দিয়ে বিশ^বাসীর অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেছেন তিনি। আর এটা করা হয়েছে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে। এর পেছনে অন্য কোন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। সেদিন বাংলাদেশে এভাবে মজলুমের পাশে, মানবতার ডাকে সাড়া না দিলে এই এগারো লাখেরও বেশি সহায় সম্বলহীন রোহিঙ্গা হয়তো নাফ নদীতে ভেসে যেত। কুকুর বেড়ালে মতো মরতো, মিয়ানামার সেনাদের গুলিতে মরতো। বাংলাদশের নানাবিধ অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই অসহয় জনগোষ্ঠির আশ্রয়, বসনের ব্যবস্থা করে আসছে পরম নিষ্ঠার সাথে। রোহিঙ্গাদের দুঃখ দেখে অনেক দেশ সমবেদনা জানিয়েছে। অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। আর্থিক সহায়তা ও সহানুভূতি জানিয়েছে। জাতিসংঘ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো ত্রাণতৎপরতা ও মানবিক সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দ্বারা জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ফোরামে রোহিঙ্গা প্রতাবাসনের ইস্যুটিকে তুলে ধরছে।

কক্সবাজারের লোকসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এ সংখ্যার সাথে যোগ হয়েছে দ্বিগুনেরও বেশি রোহিঙ্গা। ফলে ওই এলাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে নানাভাবে। গাছ-গাছালি কেটে আশ্রয় ক্যাম্প নির্মান, পাহাড় কেটে জায়গা বের করা, মলমূত্র ত্যাগের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা না থাকায় স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের আশংকা বেড়ে চলেছে। নানা রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মাদক ব্যবসায় রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরাও পড়ছে। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ৭৬টি মামলায় ১৫৯ রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ২০১৮ সালে এ সংখ্যাটি বেড়ে যথাক্রমে ২০৮ ও ৪১৪ হয়েছে। এ বছরে প্রথম সাত মাসে ১৮৭ টি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ৫১৫ জনকে। অন্যদিকে এক শ্রেণীর অসাধু সরকারী কর্মকর্তা ও দালালের হাত ধরে বাংলাদেশর পার্সপোর্ট নিয়ে অনেক রোহিঙ্গা বিদেশেও পাড়ি জমাচ্ছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাসহ কিছু আন্তর্জাতিক এবং এনজিওর স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও সেখানে ব্যাপকভাবে ডিপথেরিয়াসহ নানা রোগের প্রার্দুভাব, এমনকি এইচআইভি পজেটিভ রোগীও সনাক্ত হয়েছে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত পুরো এলাকায় স্থানীয়দের তুলনায় রোহিঙ্গাদের প্রভাব এত বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, স্থানীয় বাসিন্দারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। এই অতিরিক্ত লোকের প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং জীবনযাপনের আনুষঙ্গিক যোগান দিতে গিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। তাছাড়া প্রতিদিন অসংখ্য রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণসহ তাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে শুরু করেছে, সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। ভবিষ্যতের জন্য এটি অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতা গোষ্ঠী ও বিভিন্ন সাহায্য সংস্থাকে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনাদের সাহায্য দান খয়রাত দিয়ে রোহিঙ্গাদের আমাদের বোঝা করে রাখবেন না। যদি সত্যিকার অর্থে আপনারা মানবতাবাদী, মানবপ্রেমিক ও জনকল্যাণ করতে আগহী হন, তাহলে এই ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানের ব্যবস্থা করুন। রোহিঙ্গাদের ব্যাথায় ব্যথিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, কানাডাসহ অনেক দেশই মিয়ানমারের সমালোচনা করছে। কিন্তু সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কার্যকরা কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। গত ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ৩৪৫০ জনের সবাই তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যাবাসনের রাজি হয়নি। তারা ফিরবে কি ভরসায়? তাদের দাবি ছিল গনহত্যার বিচার, মিয়ামারের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং নিরাপদে নাগরিক অধিকার ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসন।

রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সবার আগে যা দরকার তা হলো, মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিক আইন পরিবর্তন। এই আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ‘রাষ্ট্রহীন’ করা হয়েছে। এই আইনের পরিবর্তন করা হলে তারা নাগরিক অধিকার ফিরে পাবে। স্বস্তিবোধ করবে। এ কাজ মিয়ানমার সরকারকেই করতে হবে। এ ব্যাপারে মিয়ানমারকে আন্তরিক হতে হবে। আন্তর্জাতিক বিশ্বকে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সফল হবে না। শুধু ভয় দেখিয়ে কিংবা জোর করে তাদের পাঠানের চেষ্টা হবে অর্থহীন। ভারত, চীন ও জাপান আন্তরিকভাবে চাইলে এবং মিয়ানমারের উপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করলে তাদের প্রত্যাবাসনের কাজটি অনেক সহজ হয়ে যাবে। চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভাল, তারচেয়েও বেশি ভারতের সঙ্গে। কিন্তু চীন বা ভারত কেউ উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। সবাই সমস্যাকে সমাধানের চেয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের নিজেদের দ্বিপাক্ষিক ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বড় করে দেখছে। অন্যদিকে শুধু চীন ও ভারতের মধ্যস্থতার উপর নির্ভর না করে সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের উপর কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যত দীর্ঘায়িত হবে সংকট তত বৃদ্ধি পাবে। ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, অত্র অঞ্চলের দেশগুলোর জন্যও তা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। সরকারকে এ সমস্যাগুলো আন্তর্জাতিক সম্পদ্রায়ের সামনে তুলে ধরতে হবে।
[email protected]

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন