Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে চক্রান্তে গরিব ও এতিমদের প্রায় ২২কোটি টাকা লোপাট হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলে

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০১৯, ৭:২৩ পিএম

কোরবানির পশুর চামড়ার আয় বঞ্চিত দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ২০ হাজার এতিমখানা ও মাদ্রাসা সংযুক্ত লিল্লাহ বোর্ডিং এবং কয়েক লাখ ছিন্নমুল অভাবী আর এতিমের এবার যথেষ্ঠ দুরবস্থা শুরু হয়েছে। এসব এতিমদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের একধিক চামড়া ব্যবসায়ী চক্র। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের উদাসীনতায় হতবাক দক্ষিণাঞ্চলের এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং সংশ্লিষ্ট সহ সুবিধা বঞ্চিত মানুষেরা।

দক্ষিনাঞ্চলের বেশীরভাগ এলাকাতেই বিগত কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রী করতে পারেননি অনেক মানুষ। এমনকি লিল্লাহ বোর্ডিং সহ এতিমখানাগুলো পর্যন্ত কোন পশুর চামড়া কিনতে সাহস করেনি ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। অনেক মাদ্রাসা ও এতিমখানা বিনামূল্যে কোরবনির চামড়া পেলেও তা বিকী করতে না পেওে মহা সংকটে পড়েছে। এমনকি অনেক দ্বীনি প্রতিষ্ঠান চমড়ায় লবন দেয়ার অর্থ সহ পরিবহন ব্যায়ের অর্থও তুলতে পারেনি। বেশীরভাগ কোরবাননিদাতাই অনেক অনুরোধ করে বিনামূল্যে এসব চামড়া এতিমখানায় দিলেও সেসব প্রতিষ্ঠানও তা নিয়ে নিয়ে বিপাকে পরে। বেশীরভাগ লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানাগুলো অনেক অনুনয় বিনয় করে ১শ টাকা দরেও একটি গরুর চামড়া আড়তে বিক্রী করতে পরেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। বিগত দিনে মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানাগুলো বিনামূল্যে বা প্রতিকিমূল্যে কোরবানির চামড়া কিনে পাইকার বা আড়তদারদের কাছে বিক্রী করে অর্জিত মুনাফা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা করত। আর এখাত থেকে অর্জিত মুনফা এতিমদের ভরন পোশনেই ব্যয় করতেন। কোরবানিদাতাগন পশুর চামড়া বা এর বিক্রীত অর্থ একাধীক এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং ছাড়াও গরীব মিসকিনদের মধ্যেই বন্টন করতেন ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী।

কিন্তু চামড়ার আরতদারগন কারসাজি করে গত আগস্টে কোরবানির দিন মাঠ পর্যায় থেকে কোথাও নামমাত্র মূল্যে আবার কোথাও বিনামূল্যে চামড়া সংগ্রহ করার অভিযোগ ছিল এতিমখানা সহ সুবিধা বঞ্চিত মহলের। কোরবানি দাতাগন বেশীরভাগ পশুর চামড়া বিনামূল্যেই দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যার পেছনে ট্যানারী মালিকদের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রাকৃত কোন তথ্য প্রশাসনের কাছে ছিলনা বলেও জানা গেছে। ফলে সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির বিষয়ে সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারেনি। সময়মত এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে হয়ত এ বিপর্যয় এড়ান যেত বলে মনে করছেন ওয়াকিবাহল মহল।

বিগত ঈদ উল আযহায় দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলাতে ৪ লাখ ৩৪ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে বলে জানিয়েছে বরিশাল বিভাগীয় প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর। যা ছিল আশাতিত এবং গত বছরের চেয়ে অন্তত ১৫% বেশী। কোরবানিকৃত পশুর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ষাড়, ২৩ হাজার গরু ও বকনা এবং ১ হাজার মহিষ ছাড়াও প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার ছাগল ও খাসি সহ প্রায় ১২শ ভেড়া ও অন্যান্য পশু কোরবানি হয়েছে। প্রানিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে, দক্ষিণাঞ্চলেও বছর জুড়ে যত পশু জবাই হয়, তার অর্ধেকই হয়ে থাকে ঈদ উল আযহার সময়ে। অধিদপ্তরের মতে দেশে প্রতিবছর সোয়া দু’কোটি পশু জবাই হয়ে থাকে। এবছর তা আরো কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিগত ঈদ উল আযহার সময়ও দক্ষিণাঞ্চলে যে প্রায় ৪.৩৪ লাখ বিভিন্ন ধরনের পশু কোরবানি হয়েছে, তার চামড়ার নুন্যতম গড়মূল্য ৫শ টাকা হিসেব করলেও এ অঞ্চলের এতিমখানা, মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিং সহ গরিব ও দুঃস্থ্য মানুষ অন্তত ২২কোটি টাকা পেতে পারতেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ গরীব-মিছকিন ও এতিমদের মুখের সে গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের এতিমখানা ও লিল্ল¬াহ বোর্ডিংগুলো সরাবছরই কোরবানির সময়ে পশুর চমড়া বা এর বিক্রিত অর্থের দানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু এবার এতিম ও গরীব আর লিল্লাহ বোর্ডিং-এর মত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সে অর্থের প্রায় পুরোটাই চলে গেছে চামড়া ব্যাবসায়ীদের পকেটে।
বিগত ঈদ উল আযহার দিন থেকে নানামুখি ফন্দি ফিকির করে কোরবানি দাতা এবং মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোর কাছ থেকে পশুর চামড়া সংগ্রহ করে তারা ট্যানারি মালিকদের কাছে সরকার নির্ধারিত দামেই বিক্রী করে। তবে দক্ষিণাঞ্চলের বেশীরভাগ আড়তদার ট্যনারি মালিকদের কাছ থেকে গতবছরের বকেয়া এখনো আদায় করতে পারেননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিগত কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে একাধীক মাদ্রাসা ও এতিমখানার পরিচালকদের তরফ থেকে, “ট্যানারী মালিক ও আড়তদারদের ‘সংঘবদ্ধ চক্রান্ত” বলে দাবী করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, ‘নানা পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরী করে কোরবানির দিন কাঁচা চামড়ার বেশীরভাগই বিনামূল্যে ও কিছু পানির দরে সংগ্রহ করে মুনাফা লুটেছে সংঘবদ্ধ চক্রটি’।

দক্ষিণাঞ্চলের চামড়ার সবচেয়ে বড় আড়ত বরিশালে। এ অঞ্চলের সবগুলো জেলা থেকে বেশীরভাগ চামড়া এখানে নিয়ে আসে মাঠ পর্যায়ের ক্রেতা ছাড়াও মাদ্রসা কতৃপক্ষ। এখান থেকে তা ঢাকার বড় আড়ত হয়ে ট্যানারীতে চলে যায়। লবন দেয়া এসব চামড়ার একটি অংশ কিছু ট্যানারীতেও সরাসরি চলে গেছে। আবার অনেক জেলা থেকে লবন দেয়া চামড়া সরাসরি ঢাকার আড়তে গেছে। এবার দক্ষিণাঞ্চলের কোন আড়তদারই বানিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋন পাননি বলে অভিযোগ করে পুজির সংকটের অজুহাতে তারা চামড়া না কেনার কথা জানিয়ে বিনামূল্যে বা নামমাত্র দরে কিনেছেন।

তবে কোরবানি দাতাদের কাছ থেকে বিনামূল্যে সংগ্রহের পরে মাঠ পর্যয়ের ক্রেতাদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে চামড়া কেনার অর্থ কিভাবে যোগান হয়, তার উত্তরে আড়তদারদের দাবী, তারা ‘বাকিতে চামড়া কিনছেন’। তবে মাঠ ক্রেতাদের দাবী পুরোটাই তারা বাকিতে বিক্রী করেন নি। লগ্নিকৃত পুজির টাকাটা তারা আড়তদারদের কাছ থেকেও পোয়েছেন’।

এদিকে গতবছর যেসব মাদ্রাসা ও এতিমখানা স্থানীয় আড়ত সহ পাইকারদের কাছে চামড়া বিক্রী করেছিলেন, তার অর্থও এক বছর পার হলেও এখনো পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ বিভিন্ন ব্যাক্তির কাছ থেকে ঋন নিয়ে ও তহবিলের টাকা খরচ করে মাদ্রাসাগুলো ঐ চামড়া সংগ্রহ করে আড়তে দিয়েছিল। একবছর পরেও লাভ দুরের কথা, চামড়া কেনার আসল টাকাও তুলতে পারেননি একাধীক মাদ্রাসা ও এতিমখানা কতৃপক্ষ। উপরন্তু সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক অসহায় ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষও এবার কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রীর টাকা থেকে কোন দান গ্রহন করতে পারেননি এসব চক্রান্তের কারনে। যা ছিল ইসলামের বিধান অনুযায়ী তাদের হক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বরিশাল

২৯ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ